নিষ্প্রাণ সন্ধ্যা
মোঃ আব্দুর রহমান
“এতো সকালে দরজাটা খুললো কে? কইগো হৃদয়ের মা, আমি অফিসে গেলাম দরজাটা লাগিয়ে দিয়ো।” মহিমা বেগম আসছি বলে, হৃদয়ের বাবাকে বিদায় দিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। এবার এসে একটু নকশি কাঁথাটা সেলাই করার জন্য হাতে নিলো। কিন্তু অবাক কান্ড! কাঁথার মধ্যেই সুতাসহ যেই সুইটা গুজে রাখা ছিলো সেটা নেই! অনেক খুঁজলো। কিন্তু, কিছুতেই পেলোনা! এদিকে পাশের ঘর থেকে গুনগুন গানের শব্দ আসছে। মহিমা বেগম বুঝতে পারলো নিশ্চই তার ছেলে হৃদয় গান গাইছে। হৃদয় তাঁদের একমাত্র সন্তান। গতকাল ওর চাকুরি হয়েছে। ওর ছোট বেলা থেকেই ব্যাংকার হওয়ার খুব শখ। হয়েছেও তাই। আর কয়েকদিনের মধ্যেই যোগদান করবে। তাই আজ ওর মনটা বেশ ফুরফুরে। কিন্তু হৃদয়তো ঘুম থেকে এতো সকালে ওঠেনা! আজকে ঘুম থেকে উঠে গানগাওয়ার কারণটাই বা কি? আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে গিয়ে পর্দাটা উঁচু করলো। পুরো বকুলের মিষ্টি সুবাস এসে প্রাণটা জুড়িয়েগেলো মহিমা বেগমের। বিছানায় বসে একটি একটি করে বিছানা থেকে ফুল তুলে, সুইদিয়ে মালা গেঁথে চলেছে হৃদয়। আর মুখে চলছে গান। এবার মহিমা বেগম বুঝতে পারলো, সুই না পাওয়ার রহস্যটা কি এবং দরজাটাই বা সকালে কেন খোলা ছিল। তার মানে দু’টোই হৃদয়ের কাজ। আর কার জন্যই যে, তার সোনামানিক বকুল তলা থেকে ফুল কুড়িয়ে এনে মালা গাঁথছে, এটাও বুঝতে একটুও বাকী রইলোনা মায়ের। কারণ নুপুর কথা দিয়েছিল, যেদিন হৃদয় চাকুরি পাবে, সেদিন ও হৃদয়কে ভালোবাসবে এবং বিয়েও করতে রাজি আছে। আজ তাঁর ছেলের আশা পূরণ হতে চলেছে। আহারে,কতো ভালো ছাত্র এই হৃদয়। আর কতো মেয়েই যে ওর পিছনে ঘুরলো। কিন্তু, কারো দিকে ওর মন টানলোনা। ওর হৃদয়ে শুধু ঐ একজনেরই স্থান;সে হলো শুধুই নুপুর। আর এর নামই বুঝি ভালোবাসা! হঠাৎ মায়ের চোখে চোখ পড়লো হৃদয়ের। এবার মাকে দেখে মালাটা লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করলো। কিন্তু মা ভিতরে না যেয়ে পিছনে ফিরে এলো। তিনি যে বিষয়টা জানেন, সেটা ছেলেকে বুঝতেই দিলেন না। তবে তাঁর মা তো ঠিকই ছেলের ডায়েরিটা লুকিয়ে লুকিয়ে রোজ পড়ে এবং সব খবর রাখে।এবার ঘড়িটা দেখে নাশতা না সেরেই বাহিরে চললো হৃদয়। মা পিছন থেকে ডাকলো- নাশতা করে বের হওয়ার জন্য । হৃদয় দাঁড়িয়ে বললো,” মা, এখন আর সময় নেই! পরে এসো খাবো। আর মা কয়টা টাকা দাও না। রাগ করোনা, এই কয়দিন পরে বেতন পেলে আর চাইবোনা।” মা হাসলো এবং দাড়া বলেই ছেলের হাতে কিছু টাকা এনে দিলো। ছেলেও মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “মা তুমি বড় লক্ষী। তার পর হৃদয় বেরিয়ে পড়লো। মাও তাকিয়ে রইলো। মায়ের বুঝতে বাকী রইলোনা, আজ সে অবশ্যই নুপুরের কাছেই যাচ্ছে।” কলেজের শহীদ মিনারের সামনে সবুজ ঘাসের উপর বসে নুপুর ওর বান্ধবীদের সাথে কথা বলছে। পিছনে দাঁড়িয়েই নুপুরকে লুকিয়ে দেখতে লাগলো হৃদয়। নুপুরকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। একটি গোলাপী জামা তার সাথে একটি কালো ওড়না পড়েছে নুপুর। চুলগুলো মৃদু বাতাসে উড়ছে। শ্যাম্পুও করেছে নিশ্চই। এবার বাঁ দিকটায় আম গাছের আড়ালে গিয়ে দেখলো, কপালে একটি ছোট্ট টিপ এবং ঠোঁটটায় হালকা লিপিস্টিক দিয়েছে। তবে মোটেই মেকাপ করেনি। কিন্তু ওর কাছে যেতে সাহস পাচ্ছেনা হৃদয়।
হঠাৎ ওরা সবাই উঠে দাঁড়ালো। পিছনে ফিরে নুপুরের চোখে চোখ পড়লো হৃদয়ের। নুপুর ওর বান্ধবীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হৃদয়ের কাছে এলো। “ও আমি আপনাকেই খুঁজ ছিলাম হৃদয় ভাইয়া। আপনাকে একটি জিনিস দেওয়ার জন্য। এই নিন ধরুন।” এটা কি নুপুর? এটা আমার বিয়ের কার্ড। কি বিয়ের কার্ড! তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে নুপুর। নুপুর বললো, আপনি থামুন। আগে আমার কথা শুনুন। আমি জানি, আপনি বলবেন আপনার ব্যাংকে চাকুরি হয়েছে। তবে আমি যাকে বিয়ে করছি, সে একজন ইতালি প্রবাসী। বিয়ে করার পর আমাকে ইতালি নিয়ে যাবে। কোন মেয়েই নিশ্চয়ই চাইবেনা এমন একটা সুযেগ নষ্ট করতে। আরও বলবেন, আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম যে, আপনি চাকুরি পেলে আমি আপনার হবো, তাই না? এটা আমি আপনাকে একটি অপশন হিসেবে রেখেছিলাম মাত্র। যদি ভালো কোন সুযোগ না আসতো, তখন দেখতাম। যাহোক আশারাখি বিয়ের দিন আসবেন। আর হ্যাঁ, বকুলের মালাটা নিশ্চয়ই আমার জন্য এনেছিলেন। শুধু শুধু টাকাটা খরচ না করলেও পারতেন। তারপর নুপুর চলেগেলো। দুইটি কালো কাক মাথার উপর দিয়ে কা কা করে উড়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু হৃদয় নুপুরকে ডাকতেও পারলোনা, একটু কাঁদতেও পারলোনা। শুধু বকুলের মালাটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো! সপ্তাহ খানেক পর নুপুর কলেজে এলো। ওর বান্ধবী রীনা আজও ঠিক শহীদ মিনারের সামনেই বসে আছে। ওতো রীতিমতো অবাক!
নুপুর বললো,” শোন, হৃদয় ভাইয়াদের বাসা চিনিস? ওনার সাথে আমার বিশেষ দরকার।” রীনা বললো, কেন? আর তাছাড়া আগামীকাল না তোর বিয়ে? আমার বিয়েটা কাল হচ্ছেনারে। কারণ ওরা অনেক টাকা যৌতুক চেয়েছে। বাবার পক্ষে এতো টাকা দেওয়া সম্ভবনা। তাই বিয়েও হচ্ছে না। ছেলেটা অলরেডি অন্য জায়গায় আজকেই বিয়ে করছে। কথা না বাড়িয়ে চলনা- আমাকে একটু হৃদয় ভাইয়াদের বাসায় নিয়ে চল। রীনা বললো, আমিওতো দোস্ত বাসাটা চিনিনা। তবে..ঠিক আছে আগে আমার সাথে বাসায় চল, তারপর বিকেলে একটা ব্যবস্থা হবে। বিকেল বেলা বের হয়ে, হৃদয়দের বাসা খুঁজে পেতে পেতে ওদের সন্ধ্যা হয়েগেলো। বাহিরের গেটটা খোলা।পাশেই একটি বকুল ফুলের গাছ। খুব সুন্দর সুবাস আসছে। বাড়ীটা একদম থমথমে পরিবেশ। কেউ আছে বলে মনে হলোনা। এবার ভিতরের গেটের কাছে গিয়ে কলিং বেল চাপ দিতেই, কাজের মেয়েটা বেরিয়ে এলো। মেয়েটা বললো, ভিতরে যান আম্মায় আছে। কিন্তু, ভিতরে হৃদয়ের মা একটি ছবি বুকে নিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে! আর তার হাতে একটি শুকনো বকুলের মালা! ওরা দু’জন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েটা জানালো, ছোট সাহেব ব্রেন স্ট্রোক কইরা হাসপাতালে এক সপ্তাহ ভরতি আছিল। আর ঐ বকুলের মালাটা উনি নিজে ঐ বকুল তলাত্তে কুড়ায়া মালাটা গাঁতছিল। নুপুরের বুকটায় যেন কেউ আগুনের ছেঁকা দিলো! কারণ এটাতো সেই মালাটা, যেটা নুপুর ফেরৎ দিয়েছিল!এবার নুপুর বললো, হৃদয় ভাইয়া কোথায়? গতরাইতে, গতরাইতে ছোট সাহেব মারা গেছে বলেই কাজের মেয়েটা হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো! শুনেই গেটের বাহিরে শিরিতে এসে ধপাস করে বসে পড়লো নুপুর! আর সেই শব্দে দুইটি কালো কাক বকুল গাছটা থেকে কা কা শব্দ করে, সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে পালাতে লাগলো শহরের অন্য কোন ঠিকানায়...!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct