মিশরের বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং সরকারি অব্যবস্থাপনাসহ বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ সমস্যার ফল- যা সাম্প্রতিক বাহ্যিক সঙ্কট কোভিড-১৯ মহামারী, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্বমন্দার হুমকির সাথে মিলিত হয়েছে। এই পরিস্থিতির মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। কোভিড মহামারী দেশটির অন্যতম অর্থ উপার্জনকারী পর্যটন শিল্প ধ্বংস করেছে। তারপর ইউক্রেনের যুদ্ধ যেমন সেদেশকে ধ্বংস করছে, তেমনি ক্ষতির মুখে লেবানন, মিশর। এর পর কে, তা নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ শেষ কিস্তি।
লেবানন বিদেশী নগদ অর্থের জন্য তার প্রবাসী সম্প্রদায় থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিল; বর্তমান সঙ্কটের আগে, এটি লেবাননের জাতীয় আয়ের এক-চতুর্থাংশের সমান ছিল।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘তবে সম্ভবত মিশর এবং লেবাননের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো যে মিশরকে সাধারণত ‘ব্যর্থ হওয়ার জন্য খুব বড়’ হিসেবে দেখা হয়। প্রায় ১০.৭ কোটি বাসিন্দা নিয়ে এটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে জনবহুল জাতি। এর সাথে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী। যা মিশরকে ভাগ্যবান করে তোলে তা হলো যে যতই খারাপভাবে পরিচালিত হোক না কেন বাইরের সমর্থকরা রাষ্ট্রের কার্যকারিতাকে আরো বেশি গুরুত্ব দেয় ।’
আইএমএফের খড়গ
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল মিশরের জন্য ৩-বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্যাকেজ অনুমোদন করে। এটি ২০১৬ সাল থেকে আইএমএফের সাথে দেশের তৃতীয় এ ধরনের ব্যবস্থা। আর এটি মিশরকে বিদেশ থেকে আরো বিনিয়োগের পাশাপাশি আরো আর্থিক সহায়তা আকর্ষণ করতে সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে। চুক্তিটি সম্পন্ন করতে মিশরীয় সরকারকে আইএমএফের কাছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছাড় দিতে হয়েছে। এর একটি হল, বৈদেশিক মুদ্রার হারকে আরো নমনীয় করা যা মিশরীয় পাউন্ডের রেকর্ড-ব্রেকিং অবমূল্যায়নের দিকে পরিচালিত করে। আইএমএফের আরেকটি চাহিদা এই মাসের শেষের মধ্যে ৫০ লাখ হতদরিদ্র মিশরীয় পরিবারে সরাসরি নগদ স্থানান্তর পাঠানোর প্রতিশ্রতি বন্ধের সাথে জড়িত। কায়রোর আরো একটি প্রতিশ্রুতি ছিল মিশরীয় সামরিক বাহিনীর বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের লাগাম টেনে ধরা। অনেকের মতে, ‘এটি হতে পারে, শ্বাসরুদ্ধকর। কিন্তু, এটি বিশুদ্ধ মেক-বিলিভও হতে পারে।’ গত অক্টোবরে অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলার লক্ষ্যে আয়োজিত এক অর্থনৈতিক সম্মেলনে আল-সিসি অঙ্গীকার করেন যে, জাতীয় প্রকল্পগুলো অব্যাহত থাকবে এবং সামরিক বাহিনী তাতে সক্রিয় থাকবে। তার এ বিবৃতি ১০ জানুয়ারি প্রকাশিত আইএমএফের রিপোর্টের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক, যেখানে বলা হয়, মিশর সরকারি বিনিয়োগ কমিয়ে দিতে এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা সীমিত করতে সম্মত হয়েছে। কালদাস বলেছিলেন, ‘নতুন আইএমএফ বেলআউট মিশরকে আবারো দুর্দশার দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে তবে এটি নাগরিকদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী সত্যিকারের স্বস্তি দিতে পারে কি না বলা কঠিন। মিশরের পরবর্তী লেবানন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবে দুর্দশাগ্রস্ত অনেক মিশরীয় আগামী বছরে আরো দরিদ্র হতে চলেছে। অনাগত বছরে মিশরীয়দের জন্য ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক কষ্ট রোধ করতে কিছুই হবে না।’
মিশরের এখনকার বাস্তবতা হলো, অনেক আমদানী করা পণ্য আর পাওয়া যাচ্ছে না। কায়রোর একটি জনপ্রিয় স্ট্রিট ক্যাফেতে একজন গ্রাহক বলেছেন, ‘দেশটি মুক্ত পতনের মধ্যে রয়েছে।’ সঙ্কটের জন্য দায়ী হিসেবে অনেক মিশরীয় রাষ্ট্রপতি আল-সিসির দিকে আঙুল তুলছেন। আল-সিসি অবশ্য অর্থনীতির সমস্যার জন্য ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করেছেন। মিশরীয় ইনিশিয়েটিভ ফর পার্সোনাল রাইটসের অর্থনীতিবিদ ওয়ায়েল গামাল জাতীয় প্রকল্পগুলোকে বর্ণনা করেছেন ‘শ্বেতহস্তি’ হিসেবে। তারা টাকা খায়, কিন্তু তাদের প্রকৃত মূল্য নেই। তারা মহিমান্বিত দেখায়, কিন্তু ভেতর থেকে ধ্বংস করে।’ গামালের মতে, ‘জাতীয় প্রকল্পগুলো যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। এসব নেয়ার পেছনে খুব দুর্বল অর্থনৈতিক যুক্তি আছে এবং টেকসই চাকরি এসবে তৈরি হয় না।’ সরকার অবশ্য বলছে, মেগাপ্রকল্পগুলো মিশরের উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক, আল-সিসি গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ব্যাপারে তার আপত্তি প্রকাশ করেন, কারণ তা প্রকল্পের গতি বাধাগ্রস্ত করবে। এই মাসের শুরুর দিকে, তিনি স্বীকার করেন যে, মিশর একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিশরীয়দের তিনি সতর্কও করে দেন যে, তারা শুধু অর্থনীতির বিষয়ে কথা শুনবে এবং রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হয়েছে এমন ‘অসত্য’ কথায় বিশ্বাস করতে পারবে না। সিসির বৈধতার একটি বড় অংশ মেগাপ্রকল্পগুলোর ‘ওয়াও ফ্যাক্টর’ থেকে উদ্ভূত। অর্থনীতিবিদ রবার্ট স্প্রিংবর্গ গত বছর এক নিবন্ধে বর্ণনা করেছেন, মেগাপ্রকল্পগুলো জনগণকে বিশ্বাস করাবে যে আল-সিসি একটি নতুন, সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী মিশর তৈরি করছেন। প্রশ্ন হল, মিশর যদি আইএমএফ-নির্ধারিত সংস্কারগুলো অনুসরণ না করে এবং সামরিক কোম্পানিগুলো সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে মেগা প্রকল্পগুলোতে অর্থ ঢালতে থাকে তাহলে কী ঘটবে? সালেম বিশ্বাস করেন, আইএমএফের শর্তগুলো তত্ত্বগতভাবে ভালো, কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য নয়, কারণ সেগুলো বাস্তবায়ন করা যায় না। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কিভাবে নিশ্চিত করতে পারেন যে সামরিক বাহিনী অর্থনীতির বাইরে চলে যাবে? বাস্তবে আইএমএফের সেই ক্ষমতা কি আছে? অন্য দিকে কালদাস বিশ্বাস করেন যে আইএমএফের লিভারেজ আছে। তার মতে, ‘মিশরকে উপসাগরীয় এবং আইএমএফ থেকে অর্থায়নের ওপর নির্ভর করতে হবে। তবে আইএমএফকে সত্যিকার অর্থেই জোর দিতে হবে।’
কায়রোর পথে ঢাকা!
লেবাননের সাথে অনেকে মিশরের তুলনা করেছেন। মিশরে বাংলাদেশে একের পর এক মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এটি করতে গিয়ে মিশরে ১০ বছরে বিদেশী ঋণ চার গুণ হয়েছে। সিসির মেগা প্রকল্পে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, প্রকৃত অর্থনীতি বা কর্মসংস্থানের কোনো উন্নয়ন হয়নি। রাষ্ট্রের অবকাঠামো বিক্রি বা বন্ধক রেখে বিদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সিসি উন্নয়ন দেখিয়েছেন জাতিকে। কায়রোর তাহরির স্কয়ারের কাছে, রাস্তার ধারে আল-সিসির প্রতিকৃতিসহ অসংখ্য সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় থাকা বছরগুলোকে উল্লেখ করে তাতে ঘোষণা করা হয়েছে : ‘আট বছরের অর্জন : নতুন সেতু, রাস্তা, রেলপথ এবং শহর।’ ঢাকার সাথে এর অনেক ক্ষেত্রে হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। সিসি তার শক্তিধর সেনা বাহিনীকে নিরাপত্তা রক্ষার মূল কাজ থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বাণিজ্যে আরো বেশিভাবে টেনে এনেছেন। আইএমএফ মিশরে এ ধরনের সম্পৃক্ততা বন্ধের শর্ত দিয়েছে। মিশরে লেবাননের মতো ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের টাকা উত্তোলনে সিলিং করে দেয়া শুরু হয়েছে। সেখানে ব্যাংকে গ্রাহকরা আমানতের টাকা প্রয়োজনে তুলতে পারছেন না। মিশরে আইএমএফের চাপে বিনিময় হার মুক্ত করতে গিয়ে পাউন্ডের দাম ডলারের বিপরীতে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। অদূরভবিষ্যতে ডলারের দাম এ হারের দুই বা তিন গুণ বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। (সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct