আপনজন ডেস্ক: কাশ্মীরে এ বছর মে-জুন মাসে ভোট করানো নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কংগ্রেসের ভারত জোড়ো যাত্রা উপদ্রুত এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে যে সাড়া ফেলেছে, সেটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে কেন্দ্রের দ্বিধার কারণ। যাত্রার এই প্রভাবের মধ্যে ভোট হলে তৃণমূল স্তরে তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, এই মুহূর্তে কেন্দ্র সেই বিষয়ে বিভিন্ন মহলের অভিমত খতিয়ে দেখছে। ঘোষণা না করলেও সরকার মোটামুটি ঠিক করে রেখেছে, চলতি বছরের গ্রীষ্মে কয়েক দফায় উপদ্রুত এই নতুন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিধানসভার ভোট করিয়ে ফেলবে। সে জন্য যা যা করার দরকার, তা ইতিমধ্যে প্রায় শেষ। যেমন বিধানসভা ও লোকসভা কেন্দ্রগুলোর সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ শেষ। লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করার পর জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার আসনসংখ্যা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯০। এর মধ্যে হিন্দুপ্রধান জম্মুর আসন বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪৩, কাশ্মীর উপত্যকার ৪৭। সীমান্ত পুনর্নির্ধারণ এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে জম্মুতে হিন্দুপ্রধান এলাকার গুরুত্ব বাড়ে; কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন্দ্রের চিন্তা বাড়িয়েছে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা, যা জম্মু ও কাশ্মীর উভয় এলাকাতেই বিপুল সাড়া ফেলেছে বলে স্থানীয় প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার শুরু থেকেই চায়নি রাহুল গান্ধী অন্যান্য যাত্রীর সঙ্গে হেঁটে জম্মু থেকে শ্রীনগর যান। সে জন্য প্রথমে কোভিডের ভয়, পরে নিরাপত্তার বিষয়টি বড় করে তুলে ধরা হয়। সরকার থেকে এই পরামর্শও দেওয়া হয়, জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়কে হাঁটার বদলে রাহুলরা যেন বাসে চেপে যান। কিন্তু রাহুল সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। সরকারের বিভিন্ন মহল সেই যাত্রার যেসব ছবি ও প্রতিবেদন কেন্দ্রকে জমা দিয়েছে। তাতে দেখা গেছে, জম্মুতেও বিভিন্ন এলাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। অনেকে মিছিলে হেঁটেছেন। শুধু তাই নয়, রাহুলের যাত্রাকে সমর্থন জানিয়েছেন উপত্যকা থেকে উৎখাত হয়ে জম্মুতে জড় হওয়া কাশ্মীরি পণ্ডিত সমাজও। সেখানে রাহুলের সঙ্গে পণ্ডিতদের এক প্রতিনিধিদলের বৈঠকও হয়েছে।
রাহুল গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি চিঠি লেখেন। তাতে জম্মুতে পন্ডিতদের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না করে সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত পণ্ডিতদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে যেন উপত্যকার বিভিন্ন জেলায় কাজে পাঠানো না হয়। এখনো সেখানে বাছাই হত্যা বন্ধ হয়নি। পণ্ডিতদের সেখানে জবরদস্তি পাঠালে জঙ্গিরাই উৎসাহিত হবে। জম্মু-কাশ্মীরের উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহার সমালোচনা করে রাহুল লিখেছেন, আন্দোলনরত কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ‘ভিখারি’ বলা অত্যন্ত নিন্দনীয়। ভিটামাটি ছাড়া কাশ্মীরি পণ্ডিতেরা সরকারের কাছে ভিক্ষা নয়, সুবিচার চান। পুরো জম্মুতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের আন্দোলন হিন্দুদের ওপর এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে বিজেপির আঞ্চলিক নেতৃত্ব পর্যন্ত সরকারকে জোরজবরদস্তি কিছু না করার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং তো সরাসরিই বলেছেন, প্রয়োজনে সরকারি দপ্তর বন্ধ করে দিতে হবে; কিন্তু একজন পণ্ডিতকেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে উপত্যকায় পাঠানো যাবে না। এই অসন্তোষের মধ্যে রাহুল তাঁদের সমর্থনে দাঁড়িয়ে পড়ায় কেন্দ্র সচকিত। কারণ, জম্মুতে কংগ্রেসও যথেষ্ট শক্তিশালী। জম্মু অঞ্চলে কংগ্রেসকে শক্তিহীন করতে বিজেপি নেতৃত্ব হাতিয়ার করেছিল প্রবীণ কংগ্রেসি গুলাম নবি আজাদকে। আজাদের দলত্যাগ বিজেপিকে উৎসাহিত করেছিল। কিন্তু ভারত জোড়ো যাত্রা আজাদকে বন্ধুহীন করে দিয়েছে। তাঁর সঙ্গে দলত্যাগী অধিকাংশ কংগ্রেস নেতা শুধু ফিরেই আসেননি, আজাদও সম্মানজনকভাবে দলে ফেরার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এই বিষয়ও কেন্দ্রকে চিন্তায় রেখেছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের দুশ্চিন্তার অন্য কারণও রয়েছে। উপত্যকায় মুসলমানদের সমর্থনে ভাগ বসাতে বিজেপি ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ ও রাজ্য দ্বিখণ্ডিতকরণের পর পিডিপির প্রবীণ নেতা আলাল বুখারিকে উৎসাহ দিয়ে নতুন এক দল গড়িয়েছিল। নাম জম্মু-কাশ্মীর আপনি পার্টি। ভারত জোড়ো যাত্রা সেই দলের হালও খারাপ করে দিয়েছে বলে কেন্দ্রের কাছে রিপোর্ট এসেছে। বিজেপির দলীয় রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারত জোড়ো যাত্রা উপত্যকায় গুপকর জোটের শরিকদের উজ্জীবিত করে তুলেছে। ২০১৪ সালের পর যে রাজ্যে বিধানসভার ভোট হয়নি, টানা আট বছর যেখানে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন করতে দেওয়া হয়নি, সেখানে এই যাত্রা জনমনে এক নতুন প্রাণসঞ্চার করেছে। রাজ্যের গোয়েন্দারা মনে করছেন, রাহুলের এই যাত্রা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে উপত্যকার মানুষদের স্বাভাবিক ক্ষোভ গণতান্ত্রিক উপায়ে উগরে দেওয়ার এক সুযোগের সন্ধান দিয়েছে। উপত্যকার দুই প্রধান দল ন্যাশনাল কনফারেন্স ও পিডিপি তাই এভাবে রাহুলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সমর্থন জুগিয়েছে অন্যরাও। মে-জুন মাসে ভোট হলে এই সমর্থন নিশ্চিতভাবেই বিজেপির বিরুদ্ধে গুপকর জোটের দিকে ঝুঁকে যাবে। বিজেপির চিন্তা, উপত্যকার এই প্রবল সমর্থনের সঙ্গে জম্মুর হিন্দু সমর্থনের একাংশ হাত মেলালে জম্মু-কাশ্মীরে বিজেপি ও সহযোগীদের সরকার গড়ার সম্ভাবনা ধাক্কা খাবে। অথচ রাজ্য দ্বিখণ্ডিত ও বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একাধিকবার বলেছিলেন, জম্মু-কাশ্মীরকে তিনি তিন পরিবারের (আবদুল্লাহ, সঈদ ও গান্ধী) শাসনের হাত থেকে মুক্ত করবেন। এতকিছুর পরেও পাকিস্তান ও চীন–লাগোয়া এই সাবেক রাজ্যের ভার অন্য কোনো দলের হাতে ফের চলে যাক বিজেপি তা চায় না। কেন্দ্রীয় সরকারের আরও এক চিন্তা জি-২০ সম্মেলনকে ঘিরে। সরকার ভেবে রেখেছে, মে-জুনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ‘জাতীয়তাবাদী’ এক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে সম্মেলন চলাকালে বিশ্বের দরবারে ভারতীয় গণতন্ত্র ও জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের জাতীয়তাবাদী চরিত্রের ‘শো কেস’ ভালোভাবে করা যাবে। তাতে দুটি বিষয় প্রমাণ করা যাবে। পাকিস্তানের যাবতীয় উসকানি সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ ভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরে গণতন্ত্রের জয় তুলে ধরা যাবে। পাশাপাশি করা যাবে প্রধানমন্ত্রী মোদির দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের জয়গান। কিন্তু মে-জুনের ভোটে এতকাল যাদের ‘দেশদ্রোহী’ বলা হয়েছে তারা ক্ষমতায় এলে জি-২০ সম্মেলনের আসরে সেটা সরকারের বিরাট ব্যর্থতা বলে চিহ্নিত হবে। জম্মু-কাশ্মীরের ভোট নিয়ে কী করবে সরকার? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের এই মুহূর্তের চিন্তা ও দ্বিধা এটাই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct