আগে বইমেলা হত ময়দানে। কিন্তু দূষিত হচ্ছে বলে হাইকোর্টে পিআইএল করেন পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত। হাইকোর্ট মেলা অন্যত্র সরানোর নির্দেশ দেয় পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডকে। এদিকে যাদের জায়গা সেই সেনাবাহিনীও ময়দানে মেলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তারপর পার্ক সার্কাস ময়দানে মেলার পরিকল্পনা করলে সেখানকার নাগরিকরা প্রবল আপত্তি জানান। তখনকার মুখ্যমন্ত্রী মেলাকে স্থায়ী জায়গা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষা করতে পারেননি। এ নিয়ে লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। শেষ কিস্তি।
সংগঠনের সংবিধান তৈরি হবার পরে সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড’। সভাপতি শ্রীশ কুণ্ডু, সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত মানিকতলা, যুগ্ম সম্পাদক বিমল ধর, কোষাধ্যক্ষ জয়ন্ত বসু, সদস্যবৃন্দ : নীল ওব্রায়েন, শ্রীহরি গণেশ, এন ডি মেহেরা, রথীন মুখোপাধ্যায়, সুশীল মুখোপাধ্যায়, মানব দত্ত, অশোক বারিক, সুপ্রকাশ বসু, প্রবীর দাশগুপ্ত, হারাধন বসাক, সুপ্রিয় সরকার, জে সিনহা ।কলকাতা বই মেলার ব্যাপারে বিমলবাবু ও গিল্ডের উৎসাহের আরও একটি কারণ ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত কলকাতা তথ্যকেন্দ্রে একটি বইমেলার আয়োজন করেন ইউ এস ইনফরমেশন সার্ভিস ও গিল্ড যৌথভাবে। সে মেলায় প্রায় ১৫ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলেন ।তথ্যকেন্দ্রে মেলার মাস দুই আগে বিমলবাবু একদিন আমাকে বললেন, ‘আমার একটা পত্রিকা করার ইচ্ছে আছে। সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে পারবেন ? পারিশ্রমিকওপাবেন।’আমি জানতে চাই, ‘কি রকম পত্রিকা ? সাহিত্য বিষয়ক ?’-‘না, পত্রিকাটি হবে শুধু বইএর খবর, বইএর আলোচনা নিয়ে। নামও আমি ঠিক করে রেখেছি। গ্রন্থপরিচয়।’
১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘গ্রন্থপরিচয়ের’ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, ‘পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশনা জগৎ সম্পর্কে প্রকাশকদের ও পাঠকবর্গকে সচেতন করা। ’ প্রথম সংখ্যায় যে সব নিবন্ধ ছিল সেগুলি হল। ১৯৭৪ সালের কাগজ সংকটের কয়েকটি দিক , শিবরাম চক্রবর্তীর ‘বইপাড়ার পুরানো পড়া’, ‘জিজ্ঞাসা’র ত্রিশ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে শ্রীশকুমার কুণ্ডের সাক্ষাৎকার, ড. অরুণ বসুর ‘বাংলা বইএর বাজার :রচনাবলি’, সংবাদ, গ্রন্থসমালোচনা এবং এ মাসের বই। বই সংক্রান্ত সংবাদের মধ্যে দেশের খবর যেমন ছিল তেমনি ছিল বিদেশের খবরও। এর পরের সংখ্যাগুলিতে আমরা ডি মেহেরা (রূপা), গোপালদাস মজুমদার (ডি এম লাইব্রেরি ), মহেন্দ্রলাল দত্ত ( সাহিত্য সংসদ) সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছি। পত্রিকাটিতে কিছু ইংরেজিতে লেখা প্রবন্ধও প্রকাশিত হত। বই সংক্রান্ত সংবাদ বিভাগটি ছিল খুব উন্নতমানের। কিন্তু একটা কথা আমাকে বলতেই হবে। যে আন্তরিকতা নিয়ে বিমলবাবু পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিলেন, সে আন্তরিকতা আমি প্রকাশকদের মধ্যে দেখতে পাই নি। গ্রন্থসমালোচনার জন্য তাঁদের কাছ থেকে বই আনতে গিয়ে অনেক অপ্রিয় অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। বিজ্ঞাপন তো পাওয়া যায় নি বললে চলে। পত্রিকার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতেন বিমলবাবু। এ সব কারণে এমন সর্বাঙ্গসুন্দর পত্রিকাটি দীর্ঘজীবী হয় নি। এই পত্রিকার দ্বিতীয়বর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যায় ( ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬) ‘প্রথম কলিকাতা গ্রন্থমেলা’র বিজ্ঞাপন আছে। পরের সংখ্যায় প্রথম কলকাতা বইমেলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও কিছু দুর্লভ ফটোগ্রাফ আছে। ১৯৭৬ সালের ৫ মার্চ থেকে ১৪ মার্চ বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের উল্টোদিকের মাঠে হয় প্রথম কলকাতা বইমেলা। তখনকার রাজ্যপাল মাননীয় এ এল ডায়াস উদ্বোধন করেন মেলার। পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতে এ ধরনের মেলা এই প্রথম। কলকাতার ডিসি হেডকোয়ার্টাসের অর্চিষ্মান ঘটক মাঠের ভাড়া মকুব করে দেন। মেলার প্রবেশদ্বারের নকশা এঁকে দিয়েছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী শুভাপ্রসন্ন। মেলায় যোগ দিয়েছিলেন ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, সাহিত্য আকাদেমি, দিল্লির প্রকাশন সংস্থা। মেলায় মোট ১,১০,০০০ জন দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন বলে কর্মকর্তারা জানান। বিক্রিবাটা হয় ১৫ লক্ষ টাকার মতো। মেলা উপলক্ষে শিশু সাহিত্য বিষয়ে দুদিনের সেমিনারের আয়োজন করেন কর্তৃপক্ষ। সে সেমিনারে বক্তৃতা করেন লীলা মজুমদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, স্যামুয়েল ইজরায়েল, মোহিনী রাও, পূর্ণেন্দু পত্রী, শৈল চক্রবর্তী, শৈলেন গুহরায়। শ্রেষ্ঠ প্যাভিলিয়ন, স্টল, অংশগ্রহণকারীদের পুরস্কার লাভ করেন যথাক্রমে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কোয়ালিটি বুক কোম্পানি, দ্য স্টেসম্যান লিমিটেড এবং ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট। পুরস্কার বিতরণ করেন ডি এম লাইব্রেরির গোপালদাস মজুমদার। সংবাদপত্র, বেতার ও দূরদর্শনে মেলার খবর প্রচারিত হয়। ফলে প্রকাশকদের মধ্যে উৎসাহ বাড়ে। দ্বিতীয় মেলায় ১,৯৬, ০০০ দর্শক সমাগম হয়, বিক্রি হয় ১ কোটি টাকারও বেশি। ১৯৭৮ সালে হয় তৃতীয় কলকাতা বইমেলা। একই মেলা থেকে সমৃদ্ধির সূচনা। তৃতীয় মেলায় ১১২টি প্রকাশক সংস্থা অংশগ্রহণ করেন। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয় নি। ১৯৮৪ সালে জেনিভার ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স অ্যাসোশিয়েশনের সদস্য হয়ে বইমেলার আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারে স্থান করে নেয় কলকাতা বইমেলা। (সমাপ্ত)
লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct