ভেলা
হাবিবুর রহমান
অবিভক্ত গোসাবা থানার বড়বাবু হেমেন মন্ডল।সহজে ওসব থানায় কেউ পোস্টিং হতে চাইতনা । নদীনালা, বনজঙ্গল আর ছোট বড় দ্বীপ অনেকগুলি। সাপখোপ, বাঘ কুমিরে ভর্তি। নৌকোয় লোকে যাতায়াত করে। মিন বাগদা, জঙ্গলের কাট, মধু আর নদীর মাছ ভরসা। এক কথায় কষ্টের জীবন। হেমেনের দাদামামা নেই ধরাকরার। তাই, বাধ্য ছেলের মত জয়েন করলোঐ থানায়। যতটা খারাপ ভেবেছিলো, ততটা খারাপ নয়। থানায় দুখানা লঞ্চ, আর একটা নৌকা। তাছাড়া, লাশ বোয়ার জন্যে ডিঙিনৌকা মজুদ।সঙ্গে লাশ বোয়ার ফরাস মন্টু। যাতায়াতের অসুবিধার কারণে সাহেবসুবোদের খবরদারি কম। থানায় ওসি সর্বেসর্বা। আবার বিপদে পড়লে সামলাতে হয় নিজেকে। বিদায়ী বড়বাবু যাবার সময় হেমেনকে সাবধান করে গেছে - ভাইটি, লক্ষ্য রেখে নৌকা-ডাকাতি না হয়। হইচই খুব হয়।তুমি জানার আগে মিডিয়ায় প্রচার হয়। সাহেবরা তড়পায়। হেমেন বলে, দাদা, নৌকোয় ডাকাতি, সেটা আবার কী? ওসি হাসলো, রিভার পাইরেসি বোঝো না। দস্যুরা অস্ত্র দেখিয়ে নৌকা যাত্রীর টাকা পয়সা, মালামাল কেড়ে নেয় । মার ধোর করে। হেমেন বলে, ওরে সর্বোনাস! ওসি বললে, আরো আছে ভাই,বরষায় চাষ, আর ধান কাটার মরসুমে অনেক সময় দলে -দলে দাঙ্গা -লাঠালাঠি, খুনখারাবি হয়। হেমেন আঁতকে উঠল, তাই? ওসি বললে, ইয়েস ব্রাদার্!সে ক্ষেত্রে পার্টির লিডারদের সঙ্গে সৌহাদ্য রেখো।হেমেন বলে, হায় ভগবান। হাসতে হাসতে হ্যান্ড সেক করে ওসি বিদায় নিলো। যতটা ভয় ওসি দেখিয়ে গেল, হেমেনের পরিচিত ছোটবাবু ততটা অভয় দিলে, স্যার, মোটেই ঘাবড়াবেন না।এলাকার লোকজন বড় অনুগত। আর নেতা লিডার, প্রধানরা আপনাকে ছাড়া চলবেনা। শুধু একটু চোখ কান খাড়া রেখেন। বাকি নদী ডাকাতি? আমি চিনি সব শালাকে। আপনি তো এমনিতে কড়া। দুএকটাকে ধরে আচ্ছা করে ধোলাই দিন। দেখবেন বাকিরা পালাবে।মনমরা হেমেন বলে, মান সম্মান রেখো ভাই। ছোটবাবু বলল, কোন চিন্তা নাই স্যার। সত্যিই, টনিকের মতন কাজ হলো। এলাকায় চাউর হলো, বড়বাবুটা বড় কড়া। নদী ডাকাতি বন্ধ, নেতা লিডাররা অনুগত। এলাকা কন্ট্রোলে। এসপি সাহেব তারিফ করলেন। সাহেব সুবোদের বেড়াবার নিরাপদ জায়গা হয়ে গেল। দুটো লঞ্চ প্রায়ই অতিথিদের কাজে লাগে। যষ্টিমাস। দুটো লঞ্চই বাইরে।
বড়সাহেবের ফোন, হেমেন, কুমিরমারি দ্বীপের জঙ্গল লাগোয়া চরে একটা বডি ফুলে ঢোল হয়ে চরে আটকে আছে। এখনি তুমি নিজে যাও। যেমন করে পার লাশ নিয়ে এসো। ওপারের জোগেশগঞ্জের নামী লোক নিখোঁজ। চাউর হলে লাশ আর আনতে পারবেনা। আমাকে জানিও রেজাল্ট। রিমোর্ট থানা। ফোর্স হাতে গোনা। বিভিন্ন ডিউটিতে ফোর্স অলরেডি আউট। ছোটবাবু আর লাশ বোয়ার মন্টু। তাই সই। ওসি রওনা দিল নৌকায়, তাতে বাঁধা লাশ বোয়া পানসে নৌকা। ঐ বাওড়ে পড়িমরি করে পৌঁছেও গেল প্রবল ঢেউয়ের ধাক্কা সামলে। অঞ্চল প্রধান বন্ধু লোক । গোপনে খবর দিলে, সাহেব, যে করে হোক লাশ নিয়ে চলে যান। এপারে চাউর হচ্ছে। আপনি মিনিট দশেক সময় পাবেন। না হলে আটকা পড়ে যাবেন। চরে লাশ। নৌকো যাবেনা। হেঁটেই গেল হেমেনরা । ও বাবা! লাশ ফুলে ঢোল, আর তেমনি বীভৎস। দুর্গন্ধও বেজায়। কী করা যায় !লোকতো মাত্র তিনজন -ছোটবাবু, লাশবোয়া মন্টু আর ওসি । কাতর কণ্ঠে ওসি বলল, ভাইরে, চল ধরাধরি করি।ছোটবাবু দ্বিধা করলো। কিন্তু, শেষে এগিয়ে এল। চোখকান বুঝে তিনজন বয়ে লাশ পানসে ডিঙিতে তুললো। নৌকার সঙ্গে ডিঙি নৌকা বাঁধা। নৌকো ছাড়ল। কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয়। কিছুদূর যাবার পর নৌকার ইঞ্জিন হল বিকল। অনেক চেষ্টা হল,কিছুতেই ইঞ্জিন স্টার্ট নিলো না । নৌকার হেলপারও আজ নেই। ওসি ছোটবাবুকে তেলালো, সোনা ভাই আমার!মন্টুর সাথে পানসে নৌকায় বডি নিয়ে আগাও। নৌকা সারিয়ে আমরা ধরে নিচ্ছি তোমাদের। ছোটবাবু লাফিয়ে উঠল, পাগল নাকি স্যার !যা হয় হবে, করবো না এ চাকরি।এই বাওড়ে ঢেউয়ের মধ্যে লাশের সঙ্গে লাশ হবো নাকি? বড়বাবু চুপ হয়ে গেল। শেষে বললো, মন্টুরে, চল ভাই যাই । কপালে যা আছে হবে। ছোটবাবু আর মাঝি মিনতি করলো, স্যার, লাশ আগে না জীবন আগে? যাবেননা স্যার, যাবেননা এই বাওড়ে। দোহাই আপনার।
কোন উত্তর না দিয়ে বড়বাবু পানসে নৌকায় উঠল। মন্টু নৌকার হাল ধরল। জীবন মরণের মাঝে মন্টু আর ওসি। একটা একটা ঢেউ আসছে, আর ওসির মনে হচ্ছে এই শেষ! না নৌকা আবার ভাসলো। ধড়ে প্রাণ এল। আর ঢেউ গেলে নজর পড়লো লাশের বীভৎস মুখআর দুর্গন্ধ। ভয় ভয় ভয় !বাঁচার ভয়, মরার ভয়।ভয়ে সর্বাঙ্গ হিম । মৃত্যুভয় কী জিনিস তা মালুম হল ওসির। একবার ভাবলে ঐ ঢেউয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।এ সময় মন্টু অর্ডার করলে, সাহেব,নৌকোর জল সেঁচে দেও , না হলে নৌকা ডুবে যাবে। মনে মনে ওসি আউড়াল, শালা মন্টুরে, তুইও আদেশ চালাচ্ছিস ! চালা, বাবা চালা।বাঁচার তাগিদে জল সেঁচে নৌকো হালকা করল ওসি ।আবার পাহাড় প্রমান ঢেউ। ভয়ে চোখ আপনা থেকে বুজে এল।অনেকক্ষণ লড়াইয়ের পর আর কিছু মনে পড়লোনা। ঘুমিয়ে গেল, না লাশের ওপর সেন্সলেস হল, আর কিছু মনে নেই ওসির। বাঁচানোওয়ালার মালিক ওপরওলা। মন্টুই বাঁচালে ওসিকে। ঐ ভয়ঙ্কর বাওড়, বিভৎস লাশ আর ঢেউয়ের কেউটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পানসে নৌকা থানার ঘাটে ভেড়ালো মন্টু।ওদিকে পুলিশ নৌকা আর ঠিক হলনা। পিলপিল করে লোক এসে গেল অন্য নৌকা করে। আটকালো পুলিশ নৌকো। গালাগাল হল শুরু। তল্লাশিতে লাশ না পেয়ে ক্ষিপ্ত মানুষ বলল, পুলিশই লাশ নদীতে ফেলে দিয়েছে। শালারা এখন ন্যাকা সাজছে। শুরু হল ধোলাই। ছোটবাবু আর মাঝির অবস্থা গুরুতর।পরে তাদের রেসক্যুই করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কথায় আছে না,ডোবার সময় মানুষ খড় কুটো আঁকড়ে বাঁচতে চায়, প্রবাদটা আজ হাড়ে হাড়ে অনুভব করলো ওসি হেমেন মন্ডল। খড়কুটো ধরে এ যাত্রায় রক্ষা পেলো ওসি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct