টিপু সুলতান
শেখ হাফিজুর রহমান
টিপু সুলতানের পুরো নাম ‘ফতেহ আলী সাহেব টিপু। তাঁর জন্ম ২০নভেম্বর, ১৭৫০ এবং মৃত্যু ৪ মে, ১৭৯৯ । আমরা সবাই টিপুসুলতানের বিষয় পড়েছি বা শুনেছি। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের মহীশূর রাজ্যের এক যোগ্য শাসনকর্তা। তিনি প্রকৃত পক্ষে একজন বীর, সাহসী যোদ্ধাও ছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি বীরত্ব সহকারে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি তাঁর শৌর্যবীর্যের কারণে শের-ই-মহীশূর নামে পরিচিত ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতাকামীতার জন্য তাঁকে ভারতের বীরপুত্রও বলা হয়। তিনিই বিশ্বে প্রথম রকেট আর্টিলারি এবং বিভিন্ন যুদ্ধ অস্ত্রাদি তৈরী করেছিলেন। তাঁর সাহস, বীরত্ব, গভীর দেশ-প্রম, দেশ থেকে ব্রিটিশদেরকে চিরতরে তাড়াবার দৃঢ় সংকল্প ও জনপ্রিয়তা দেখে ইংরেজরা ভয় পাচ্ছিল, তাই তাদের কাছে টিপু সুলতানের নাম ছিল একটা বিভিষিকা। তারা চাইছিল কোনো রকমে টিপুকে হারাতে। তাই তারা কাম, দাম, দণ্ড, ভেদ সব অস্ত্রই ব্যবহার করেছিল। যেমন - সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দুদের মনে টিপুর প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা ঢুকিয়ে দেওয়া এবং তাদেরকে হাতে কর ছাড়া অন্য কোন বিকল্প ছিল না। এমকি ব্রিটিশ শাসকবর্গ ভারতের ভাইসরয়দেরকে আদেশ দিয়ে রেখেছিল যে তারা যেন ক্ষমতায় থাকার জন্য, তাদের নিজেদের স্বার্থে হিন্দু-মুসলীম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভেদা-ভেদ, ঘৃণা এবং নেতিবাচক অনুভূতি জাগিয়ে রাখে, পাঠ্যপুস্তকগুলিও এমনভাবে লেখে যেন এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে নেতিবাক মনোভাব আরও মজবুত হয়। ইংরেজরা সেটাই করেছিল।
1) মীর সাদিক টিপু সুলতানের বেশ বিশ্বত্ব কেবিনেট মন্ত্রী ছিল। কিন্তু ইংরেজরা তাকে অর্থ দিয়ে কিনে নিয়েছিল। তাই চতুর্থ এ্যাংলো-মহীশুর যুদ্ধে (1798-1799) সে ব্রিটিশদের আক্রমণ কালে দুর্গের মেন গেট খুলে দিয়েছিল এবং কোন আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেয়নি। তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার ফলে টিপু সুলতান প্রাণ হারিয়ে ফেলল।
2) ইংরেজরা হিন্দু নেতা বিনায়ক দামোদার সাবারকারকেও মুসলীম শাসকদের ছবি খারাপ করার জন্য অনেক ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
সূত্র : DSA News, m.youtube.com, Vinay Dubey, Video on Tipu Sultan
3) এছাড়া, ব্রিটিশপন্থী ইতিহাসবিদগণ ও মুসলীম শাসকদেরকে হিন্দু বিরোধী হিসেবে অঙ্কিত করার চেষ্টা করেছিল। যেমন - Addanda C. Cariappa, তার নতুন নাটক ‘নিজাকানাভুগালু’তে টিপু সুলতানের ছবি খারাপ করার চেষ্টা করেছে এই বলে যে টিপু যোদ্ধার মতো লড়তে লড়তে ইংরেজদের হাতে নিহত হয়নি বরং কর্নাটকের ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের নেতা উরি গাওড়া এবং নানজে গাওড়া ঐ চতুর্থ যুদ্ধে তাঁকে হত্যা করেছিল। এটা একেবারে কল্পিত মিথ্যা কাহিনী, কারণ অন্য এক ইতিহাসবিদ P.V. Nanjaraja Urs বলেছেন যে আমি আমার দীর্ঘকাল গবেষণা করে টিপু সুলতানের সংস্পর্শে আসা উরি গাওড়া এবং নানজে গাওড়া নামের কোনো ব্যক্তির কথা কোনো রেকর্ড, লোক-কাহনী বা অন্য কোন সূত্রে পাইনি। আর এক ইতিহাসবিদ Talakadu Chikkarange টিপু সুলতানের উপর অনেক পড়াশোনা করেছেন, উনিও কারিআপ্পার উল্লেখিত ঘটনাটি ভিত্তিহীন পেয়েছেন। Amateur ইতিহাসবিদ Nidhin George Olikara, ত্রিশ বছর যাবr টিপু সুলতানের ওপর গবেষণা করেছেন এবং বলেছেন এটাই সত্য যে তিনি বীরের মত যুদ্ধ করতে করতেই ব্রিটিশদের হাতেই নিহত হন, অন্য কেহ মারেনি। অতএব কারি আপ্পার দাবী মিথ্যা। কিছু ব্রিটিশ পন্থী বিদেশী ইতিহাসবিদরা ও টিপু সুলতানের ছবি খারাপ করে হিন্দুদের মন জয় করতে চেয়েছিল। যেমন 1) স্যার ওয়াল্টার স্কটের বই ‘দ্য সারজেনস ডটার’ 2) ক্যাপটেন মিডোস টেলারের বই ‘টিপু সুলতান, অ টেল অফ দ্য মহীশূর ওয়ার্স, 3) এবং জর্জ আলফ্রেড হেন্টির বই ‘দ্য টাইগার অফ মহীশূর’ বই-এ টিপুর বিরুদ্ধেই লিখেছে। এগুলো সব ষড়যন্ত্র।
সূত্র: Researchgate.net, Ayusman Chakraborty
তারা তাদের লিখনের দ্বারা হিন্দুদের মন জয় করতে চেয়েছিল এবং একটা মিথ্যে তুষ্টিকরণ করার চেষ্টা করেছিল যে তারা তাদেরকে মুসলীম শাসকদের অত্যাচার থেকে ত্রাণ দেওয়াবে। দীর্ঘদিন চলে আসা মধুর হিন্দু-মুসলীম সম্পর্ককে এবং পরিবেশকে মূলতঃ ইংরেজরাই তিক্ত করেছে। ভারতীয় ইতিহাসবিদগণ যারা রাজনৈতিক কারণেই হউক আর সত্য জ্ঞান না থাকার কারণেই হউক, টিপু সুলতানের ছবি খারাপ করার চেষ্টা করেছেন, সকলেরই মন্তব্য মিথ্যে প্রমাণ হয়েছে। এখানেই এই প্রসঙ্গে, ডাক্তার হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কথা উল্লেখ না করলে নয়। তিনি একজন বিজ্ঞ, উচ্চ শিক্ষিত অধ্যাপক এবং লেখক ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের সংস্কৃত বিভাগের হেড ছিলেন। তিনি একটা বই লিখেছিলেন তাতে তিনি লিখেছিলেন যে ‘টিপু সুলতান তাঁর শাসনকালে তিন হাজার ব্রাহ্মণকে ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত করার জন্য জবরদস্তি করেছিল বলে তারা আত্মহত্যা করেছিল।’ সেই বইটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং কলেজে পড়ানো হত।প্রয়াত অবসরপ্রাপ্ত প্রখ্যাত জ্ঞানী, ইতিহাসবিদ ও তত্কালীন উড়িষ্যার গর্ভনার প্রোফেসর বিশম্ভরনাথ পান্ডেজী হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর এই উক্তিটি যখন জানতে পারলেন, তিনি বিশ্বাস করেননি এবং আশ্চর্যিত হলেন যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতো বিদ্বান এই রূপ মিথ্যা তথ্য কি করে লিখতে পারলেন। কেননা তিনি নিজেই একজন ইতিহাসের পন্ডিত ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁকে চিঠি লিখে প্রশ্ন করেছিলেন, উত্তরে শাস্ত্রীজী সঠিক প্রমাণ দেখাতে পারেননি। অবশেষে এই মিথ্যা উক্তিটিকে পান্ডেজী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন কূলপতি স্যার আশুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে বহু চেষ্টায় পাঠ্যপুস্তক থেকে সংশ্লিষ্ট উক্তিটি তুলে দিয়েছিলেন। বোঝা যাচ্ছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিদ্বেষী লেখকগণ ও টিপু সুলতানকে ক্রুর, অত্যাচারী ও ধর্মান্ধ শাসক হিসেবে অঙ্কিত করার চেষ্টা করে গেছে। যেগুলো অবান্তর, অযথাযথ ও অপ্রাসঙ্গিক। অনেকে দাবী করে যে টিপু সুলতান হিন্দুবিরোধী, অত্যাচারী ছিল বলেই তার তরবারিতেও লেখা ছিল তাঁর তরবারি হিন্দুদেরকে/কাফেরদেরকে ধ্বংস করার জন্যই। অথচ এই উক্তিটি একেবারে কল্পিত ও মিথ্যা, কারণ আরবী শিলালিপিতে কোনো জায়গায় কাফের শব্দ লেখাই নেই। বিশেষজ্ঞরা অনুবাদ করে এরকম কাফের বিরোধী কোন কথা পাইনি। বরং তাতে আল্লাহর গুনগান, ক্ষমতার কথাই লেখা আছে। কিন্তু টিপু বিদ্বেষীরা তাঁর ছবি খারাপ করার উদ্দেশেই এইরূপ মিথ্যা ও কল্পিত অপবাদ রটিয়েছে।
সূত্র: m.youtube.com
What is written on the Sword of tipu Sultan
প্রথমতঃ হিন্দুরা বেশীর ভাগই আরবী পড়তে জানে না, তাই হিংসার বশীভূত হয়ে এইরূপ মন্তব্য করেছে।
দ্বিতীয়তঃ খুব পরিতাপের বিষয় এই যে মুসলীম সমাজে আরবী ও ধর্মের জ্ঞান রাখেন এমন জন ও কেহ আজ পর্যন্তএই উক্তিটির খন্ডন করেন নাই। ফলস্বরূপ টিপু সুলতানের বিষয়ে এই নেতিবাচক উক্তিটি নির্বিবাদ হয়ে রয়েই গেছে।আসলে টিপু সুলতান ধার্মিক ও মানবীয় ছিলেন। তিনি তাঁর শাসন কালে বেশ কয়েকটি প্রশাসনিক উদ্ভাবন চালু করেছিলেন, যেমন নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা এবং ক্যালেন্ডার সিস্টেম। পাশাপাশি, একটি নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা যা মহীশূরের রেশম শিল্পের বিকাশের সূচনা করেছিল। মহাত্মা গান্ধী তাঁর নিজস্ব পত্রিকা ‘ইয়াগ ইিন্ডয়া’তে 23 জানুয়ারী, 1930 খৃঃ 31 নম্বর পাতায় লিখেছেন যে বিদেশী ইতিহাসবিদগণ টিপু সুলতানের সম্বন্ধে ভুল-ভাল মন্তব্য করেছেন। তাঁর সম্পর্ক হিন্দুদের সাথে খুবই সুন্দর ছিল। তিনি শ্রীংগেরী মঠের জগতগুরু শংকরাচার্যকে অনেক শ্রদ্ধা করতেন এবং মহীশূর রাজ্যের, তাঁর প্রজাদের মঙ্গলের জন্য, উন্নতির জন্য প্রার্থনা করার অনুরোধও করতেন। এই প্রসঙ্গে 1793 সালে টিপু সুলতানের লেখা অনেক চিঠিপত্র কর্নাটকের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে (Archacology) department এখনও সুরক্ষিত আছে।
সূত্র: 1. toshkhana.wordpress.com
2. qrices.com, Tipu Sultan: Vision : The Seringapatam Times, Dr. Shakeel A Samdan, Nov. 10, 2021
3. ইতিহাসকে সাথ অন্যায়, লেখক - প্রোফেসর বিশম্ভর নাথ পান্ডে। প্রকাশক - মধুর সন্দেশ সঙ্গম। সংস্করণ - 2015
যেসব রাজারা টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত তাদের বিদ্রোহ দমনে যুদ্ধ হত এবং ফলস্বরূপ মানুষ মরত। সেটা ধর্মের লড়াই ছিল না, সেটা ছিল প্রশাসনিক পদক্ষেপ। অনেক সময় রাজ্য চালাতে জনগণের স্বার্থে যুদ্ধ বাঞ্ছনীয় হয়ে যায়, সেখানে মানুষের মৃত্যুও হবে। তারমানে এ নয় যে সে অত্যাচারী ছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ (হিন্দু) মারা গিয়েছিল, সেটা ছিল অধিকারের লড়াই, অসত্যের সঙ্গে সত্যের লড়াই কিন্তু সেটাকে কেন্দ্র করে যদি বলা হয় যে তারা, অত্যাচারী ও খলনায়ক ছিল তাহলে সেটা যুক্তি যুক্ত নয়। অতীতে, পল্লব রাজা নরসিংহ বর্মন (প্রথম) চালুক্যদের পরাস্ত করে তাদের গণেশ মূর্তী উঠিয়ে নিয়ে এসেছিল। চান্ডেলা রাজার লড়াই প্রতিহার রাজা হেরামবাপালার সঙ্গে হয়েছিল। পান্ডেয় রাজা শ্রীমারা শ্রীবল্লাভ শ্রীলংকা আক্রমণ করে লুটমার করেছিল। এই রকম যুদ্ধ, লুট, ইতিহাসে অনেক পাওয়া যাবে। এ সবের মূল কারণ রাজনৈতিক ঈর্ষা। এসব শাসন চালাতে গেলে জনস্বার্থে হয়েই থাকে। কিন্তু টিপুর ক্ষেত্রে, ঔরঙ্গজেবের ক্ষেত্রে বা অন্যান্য মুসলীম বাদশাহদের ক্ষেত্রে ইতিহাস লেখকগণ ঘৃণা, ঈর্ষার বশীভূত হয়ে অনুপাতের বাইরে তাঁদের চরিত্রকে নেতিবাচকভাবে অংকিত করে গেছে। টিপু সুলতান যে সব উন্নয়নমূলক, কল্যাণমূলক কাজ করে গেছে সেগুলো ইতিহাসে ঐ লেখকগণ তুলে ধরেনি। তাই এই প্রসঙ্গে ইতিহাসের অধ্যাপক, রবিরঞ্জন সেন মনে করেন অনেক সময়ই পাঠ্যপুস্তক একপেশে, এক ধরনের ইতিহাস লেখা হয়ে এসেছে, কিন্তু টিপুর জীবন আর শাসন আমলের দুটি দিকই তুলে ধরা দরকার। টিপু সুলতান যখন যুদ্ধে যেতেন রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে শাসন চালাতেন একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ, তাঁর নাম কৃষ্ণাচার্য পূর্নৈয়া। আবার মালাকার দখল করার সময় তাঁর সেনাপতি ছিলেন শ্রীনিবাস রা, একজন হিন্দু। ইতিহাসবিদ ও তিনবার স্বর্ণপদকজয়ী ডাক্তার সেবাস্টিয়ান যোসেফও বলেছেন টিপু সুলতানের পরই যার হাতে সব ক্ষমতা, সেই পূর্ণিয়া হিন্দু হয়ে কুর্গের হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করতে দিয়েছেন বা ধর্মান্তকরণ করানোতে মদদ দিয়েছেন সেটা কি মেনে নেওয়া যায়? এটা পূর্ণরূপে মিথ্যা। কারণ, যদি টিপু হিন্দু বিরোধী হত তাহলে তাঁর প্রশাসনে বিশেষ বিশেষ পদে বেশীরভাগ হিন্দুদেরই কেন রেখেছিলেন। যেমন: শাসাইয়া আয়েংগার পুলিশ বিভাগের মন্ত্রি ছিল, সূব্বাূ রাও চিফ সেক্রেটারি ছিল। তিনি তো ঐসব বিশেষ পদে কোন মুসলীমকেও নিযুক্ত করতে পারতেন। আসলে তিনি ছিলেন উদারপ্রকৃতির মানুষ।
সূত্র: www.thecitizen.in, Article by P.K. Balachandran ‘Tipu Sultan’, the Legendary warrior was not communal) লালা মেহতাব রায় সাবকাত একজন ব্রাহ্মণ হিন্দু ছিলেন। তাঁকে টিপু বিশ্বস্ত পদে রেখেছিলেন। হরি সিংহ মহীশূর দরবারে নিযুক্ত ছিল। এছাড়া, নরসিংহ রাও, রামা রাও, শ্রীনিবাস রাও, আপ্পাজি প্রভৃতি অনেক হিন্দুকে টিপু নিজের আর্মিতে, দরবারে স্থান দিয়েছিলেন।হিন্দু প্রজাদের কাছে তিনি খুব প্রিয় শাসক বলে পরিচিত ছিলেন। যে দিন টিপু যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছিলেন সেদিন তাঁর রক্ষার্থে বা সমর্থনে অনেক হিন্দুনারী ও শহীদ হয়ে গিয়েছিলেন। যখন তাঁর মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল অনেক হিন্দু নারী শোকে, দুঃখে বিলাপ করতে দেখা গিয়েছিল। ইংরেজরা তো দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। অতএব, যে সম্রাট হিন্দুদের মন্দিরে সব রকমের সাহায্য দিয়ে গেছেন, হিন্দু ধর্ম গুরুদের সম্মান করতেন, যে সম্রাট বহু হিন্দুকে দায়িত্বশীল পদে নিযুক্ত করেছিলেন, তাদের মঙ্গল কামনা করতেন এবং যার কানে মন্দিরের ঘন্টির আওয়াজ বিরক্তকর হত না, সেই টিপু সুলতান কিভাবে হিন্দু বিরোধী হতে পারত, কিভাবে গণহত্যা করতে পারত? তিনি তো হিন্দু-মুসলীম ঐক্যের এক প্রতীক ছিলেন, এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত ছিলেন।উপলব্ধ নথিপত্র থেকে প্রমাণিত হয় যে টিপু সুলতান প্রায় 156টি মন্দিরে তার তত্ত্বাবধানের জন্য প্রচুর পিরমানে জমীন ও আর্থিক দান দিয়ে থাকতেন, তার মধ্যে শ্রীভেংকটরমন, শ্রীনিবাস, শ্রীরঙ্গনাথ এবং শ্রীংগেরী মঠের নাম বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। যখন মারাঠা মহীশুর দখল করতে এসেছিল, তখন তারা অতি পবিত্র হিন্দু তীর্থস্থান শৃংগেরী মঠ ধ্বংস করেছিল। সেই শৃংগেরী মঠের পুনর্নিমানের অর্থ দিয়েছিলেন টিপু সুলতান। এগুলোকে ধর্মীয় নিপীড়ন বলা যায় না, ব্যাখ্যা করেছেন অধ্যাপক যোসেফ। এছাড়া, ননজানগুড় তালুকায় কালালে অবস্থিত লক্ষ্মীকান্ত মন্দিরে এবং মেলকোটে অবস্থিত নারায়ণা স্বামী মন্দিরেও দান দিয়েছিলেন। আমাদের সকলের টিপু সুলতানকে মনে রাখা উচিত কারণ তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীত, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সহনশীলতা, দেশ-প্রেম ও ঐক্যের শিক্ষা এবং বার্তা দিয়ে গেছেন। হিন্দু মুসলীম সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘদিন চলে আসা মধুর সম্পর্ককে দুষিত করেছে ইংরেজরাই। তাদের বিছানো বিষাক্ত জালে জড়িয়ে যারা একজন অপরের প্রতি বিষন্ন হয়ে আছে তাদের একবার ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা উচিত যে সত্যিই কি মুসলীম বাদশাহরা নিষ্ঠুর, অত্যাচারী ও হিন্দুবিদ্বেষী ছিল। যদি তাই হত তাহলে হলদীঘাটির যুদ্ধে মহারানা প্রতাপের দলে কি করে শত শত মুসলীম সৈন্য ছিল, আবার সম্রাট আকবরের দলে শত শত হিন্দু সৈন্য ছিল, মারঠা সম্রাট শিবাজী মহারাজের সৈন্য দলে প্রায় ষাট হাজার মুসলিম সৈন্য ছিল? এতটাই নয়, সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল পদে মহারানা প্রতাপ হাকিম খাঁন সূবী পাস্তুনকে মুখ্য সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন, শিবাজী মহারাজের, বডিগার্ড এবং বারুদ ঘরের ইনচার্জ ছিলেন মুসলমান, তাঁর নাম ছিল মৌলানা হায়দার আলি। সম্রাট আকবরের মুখ্য সেনাপতি ছিলেন একজন হিন্দু, তাঁর নাম ছিল রাজা মানসিংহ। এই রকম ভুরি ভুরি ঘটনার উল্লেখ নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে পাওয়া যায়। এতে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে হিন্দু-মুসলীম সম্পর্ক ভালো ছিল। হিন্দু রাজারা মুসলমানদের উপর বিশ্বাস করত, মুসলীম রাজারা মুসলমানদের উপর বিশ্বাস করত, মুসলীম রাজারাও হিন্দু প্রজাদের উপর বিশ্বাস করত। আমরা ভালই ছিলাম কিন্তু হিন্দু-মুসলীম ফিলিং, বিদ্বেষ মনোভাব ব্রিটিশরাই তৈরী করে গেছে। যেমন: 1872 খৃঃ পর্যন্ত বেঙ্গলে হিন্দু-মুসলীম সম্প্রদায় জানতই না যে কারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বা কারা সংখ্যালঘু। কিন্তু 1872 সালে ব্রিটিশ একটি জনগণনা সার্ভে করেছিল তাতে হিন্দুরা বুঝতে পারল যে ওরা পূর্ববঙ্গে সংখ্যালঘু এবং পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারপরই 1905 সালে সোজাসাপ্টা ভাবেই বঙ্গ-বিভাজন ঘটাল। এতেও ব্রিটিশ ক্ষান্ত হয়িন, তারা আবার মুসলীম সম্প্রদায়ের জন্য একটা আলাদা নির্বাচনমণ্ডলী গঠন করল। এইসব কারণেই হিন্দু-মুসলীম বিদ্বেষ মানুষের মনে বাসা বাঁধতে রইল। তাই আমাদের প্রত্যেককেই উন্মুক্ত মনে, নিরপেক্ষভাবে এই বিষয়টিকে বুঝতে হবে, তাহলেই তিক্ততা দূরীভূত হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct