ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি আইনত নিশ্চিত হওয়া উচিত। দিল্লিতে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের আগে কয়েকজন কৃষক নেতা এবং বিশেষজ্ঞ ছাড়া অধিকাংশ চাষি এমএসপি’র নামও শোনেননি। কিন্তু এখন এমএসপি-র কথা প্রত্যেক চাষি ও স্থানীয় কৃষক নেতাদের মুখে মুখে। সাধারণ কৃষক জানেন না এমএসপি কী এবং কীভাবে এটি অর্জন করা যায়, তবে তিনি জানেন যে তাঁর কিছু অধিকার রয়েছে যা তিনি পাচ্ছেন না। এই ইস্যুতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এটাই যথেষ্ট।। এ নিয়ে লিখেছেন যোগেন্দ্র যাদব।
এ বছর রসুন চাষির সর্বনাশ হয়েছে। এক কেজি রসুন রোপণ করলে চাষির খরচ হয় ১২ থেকে ১৫ টাকা। কিন্তু এ বছর বাজারে তিনি পাচ্ছেন মাত্র ৩ থেকে ৫ টাকা। মান্ডিতে নিয়ে যাওয়ার খরচ উঠছে না। একটা সময় ছিল যখন রসুন বিক্রি করে সেই টাকায় মোটর সাইকেল বা গাড়ি কিনতেন চাষিরা। এ বছর ঋণও শোধ করতে পারেননি”। এই গল্পটি পশ্চিম মধ্যপ্রদেশের এক কৃষকের। রাজস্থান ও গুজরাত সংলগ্ন এই এলাকায় রসুন ছাড়াও চাষিরা পেঁয়াজ চাষ করেন। এ বছর তাতেও লোকসান হচ্ছে। খরচ প্রতি কেজি ৬ থেকে ৭ টাকা, কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১ টাকা কেজি। সমস্যা শুধু এবছরের বা মধ্যপ্রদেশের নয়। এই পর্যন্ত ভারত জোড়ো যাত্রায় আমি ৭টি রাজ্যের কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছি। একেক জায়গার সমস্যা একেক রকম। কিন্তু একটি যন্ত্রণা দেশের প্রত্যেক কৃষককে এক করে দেয়: বাজারে ফসলের সঠিক দাম পাওয়া যায় না। পেঁয়াজ এবং রসুনের মতো শাকসবজি বা ফলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নেই, তবে যে সব ফসলের সহায়ক মূল্য ঘোষণা করা হয়েছে তাও পাওয়া যায় না। মুগ, ছোলা, অড়হরের মতো ডালের জন্য কাগজে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করা হয় কিন্তু বিক্রি হয় না। ফলে বাজারে ঘোষিত ন্যূনতম মূল্য থেকে এক হাজার বা দুই হাজার টাকা ক্ষতি হয় কৃষকের। ধান ও গমের সরকারি ক্রয় সত্ত্বেও অধিকাংশ জায়গায় কৃষক লোকসানের মুখে পড়ে ব্যবসায়ীর কাছে ফসল বিক্রি করেন।
সেই কারণে সারা দেশের কৃষক আন্দোলনে নানা মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, একটি দাবিতে ঐক্যমত রয়েছে: এমএসপি আইনত নিশ্চিত হওয়া উচিত। দিল্লিতে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের আগে কয়েকজন কৃষক নেতা এবং বিশেষজ্ঞ ছাড়া অধিকাংশ চাষি এমএসপি’র নামও শোনেননি। কিন্তু এখন এমএসপি-র কথা প্রত্যেক চাষি ও স্থানীয় কৃষক নেতাদের মুখে মুখে। সাধারণ কৃষক জানেন না এমএসপি কী এবং কীভাবে এটি অর্জন করা যায়, তবে তিনি জানেন যে তাঁর কিছু অধিকার রয়েছে যা তিনি পাচ্ছেন না। এই ইস্যুতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এটাই যথেষ্ট। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কৃষক নেতা ও সংগঠন বিভিন্নভাবে ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের আইনি গ্যারান্টির দাবি তুলে ধরেন। এই প্রশ্নে স্পষ্টতা থাকা প্রয়োজন। এমএসপি-র আইনি গ্যারান্টি মানে হল প্রত্যেক কৃষককে সম্পূর্ণ ফসলের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাওয়ার আইনি গ্যারান্টি দেওয়া হবে। এই একটি বাক্যে চারটি দাবি রয়েছে। প্রথমত, সব ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করা হবে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার মাত্র ২৩টি ফসলের (প্রধানত খাদ্যশস্য, ডাল এবং তৈলবীজ) এমএসপি ঘোষণা করেছে। কৃষক আন্দোলনের দাবি – সব মোটা শস্য, বনজ পণ্য, ফলমূল, শাকসবজি এবং দুধ, ডিম এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কৃষকের জীবিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই সব ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করতে হবে। দ্বিতীয় দাবি হল এমএসপি নির্ধারণ করা হবে লাভজনক মূল্যের নীতির উপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ, স্বামীনাথন কমিশনের প্রস্তাবিত সূত্র অনুসারে, সম্পূর্ণ খরচের (সরকারি ভাষায় সি২ খরচ) কমপক্ষে ৫০ শতাংশ লাভ অনুসারে এমএসপি নির্ধারণ করা হবে। তৃতীয় দাবি হল, সরকার শুধু এমএসপি ঘোষণা করবে না, সমস্ত কৃষককে সম্পূর্ণ ফসলের জন্য অন্তত এমএসপি দেওয়ার দায়িত্বও নেবে। সরকার নিজে ফসল কিনুক বা অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করুক, কিন্তু কৃষকদের ওই দাম পাইয়ে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। এই দাবির শেষ এবং চতুর্থ অংশটি হল যে এমএসপি প্রদান শুধুমাত্র একটি সরকারি প্রকল্প হবে না, এটিকে মনরেগা (MGNREGA)-এর মতো একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে। অর্থাৎ, কৃষক যদি এমএসপি’র থেকে কম দাম পান, তাহলে অধিকার এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করতে তিনি আদালতে যেতে পারবেন।
এমএসপি-র আইনি গ্যারান্টির দাবি যখন এভাবে পেশ করা হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে যে এটি কীভাবে সম্ভব হবে? রাজনীতিবিদরা প্রশ্ন করেন এটা কি আদৌ বাস্তবায়িত হতে পারে? কর্মকর্তারা প্রশ্ন তোলেন এর প্রয়োগ কেমন হবে? অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন করেন, সরকারের কাছে কি এত টাকা আছে? সরকার ও দরবারি লোকেরা বারবার এই বিভ্রম ছড়াচ্ছে যে দেশের সমস্ত ফসল সরকার কর্তৃক সম্পূর্ণ ক্রয় বাস্তবে অসম্ভব। সেজন্য এটা পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার যে এমএসপি’র আইনি গ্যারান্টির জন্য সরকারকেই সমস্ত ফসল কিনতে হবে এমন নয়। কৃষকদের এমএসপি সুনিশ্চিত করতে সরকার অনেক উপায় অবলম্বন করতে পারে। প্রথমত, সরকারি ক্রয়ের বর্তমান মাত্রা বাড়াতে হবে, যদিও সব ফসল কেনার প্রয়োজন নেই। সরকারকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে গম ও ধান ইত্যাদির সরকারি ক্রয়ের বর্তমান মাত্রা কমবে না। পাশাপাশি মোটা শস্য, ডাল ও তৈলবীজ পর্যাপ্ত সরকারি ক্রয় করা হবে। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হল ‘ভাবান্তর’, অর্থাৎ বাজারে দাম কম হলে এমএসপি এবং বাজার মূল্যের মধ্যে পার্থক্যের জন্য ক্ষতিপূরণ দেবে সরকার। এই পরীক্ষাটি মধ্যপ্রদেশে ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু যখন পরিবর্তিত আকারে হরিয়ানায় বাজরার জন্য গুরুত্ব সহকারে প্রয়োগ করা হয়েছিল, তখন সাফল্য পেয়েছে। তৃতীয়ত, বাজারের দাম এমএসপি’র নিচে নেমে গেলে সরকার কিনবে এবং দাম ঠিক করবে। এটা কোনো নতুন ধারণা নয়। তুলোর মতো ফসলের ক্ষেত্রেও সরকার একই কাজ করে। এই উদ্দেশ্যে সরকারেরও একটি পরিকল্পনা আছে। কিন্তু বাজেটে এর জন্য পর্যাপ্ত তহবিল রাখা হয় না। এই প্রকল্পটি গুরুত্ব সহকারে বাস্তবায়ন করতে হবে। চতুর্থত, আমদানি-রপ্তানি নীতির মূল্যহ্রাস রোধ করতে হবে। আজকে সরকারের কৃষিপণ্যের আমদানি-রপ্তানি নীতি ব্যবসায়ীদের স্বার্থে প্রণীত। কৃষক যখন ফসলের ভালো দাম পায়, তখন আমদানি ছাড় দেওয়া হয় বা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এই নীতি এখন কৃষকদের স্বার্থে চালাতে হবে। পঞ্চম এবং শেষ হাতিয়ারটি একটি আইনি বিধান হতে পারে যে বাজারে এমএসপির চেয়ে কম নিলামের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে। কিন্তু মনে রাখবেন যে এই পঞ্চম বিধানটি অকেজো এবং বিপজ্জনক হতে পারে যদি প্রথম চারটি পদক্ষেপ না নেওয়া হয়। এই পাঁচটি হাতিয়ার বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করলে কৃষকের পরিশ্রমের পুরো মূল্য পাওয়ার স্বপ্নপূরণ হতে পারে। এই দাবি ও কৃষকদের অন্যান্য দাবি নিয়ে ২৬ নভেম্বর থেকে দেশব্যাপী আন্দোলনের ঘোষণা করেছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। অন্যান্য কৃষক সংগঠনগুলোও এ দাবিতে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা করেছে। আশা করা উচিত, বিভিন্ন কৃষক সংগঠন তাদের ছোট ছোট মতপার্থক্য ভুলে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে এমএসপির আইনি গ্যারান্টি নিয়ে একটি নির্ণায়ক লড়াই লড়বে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct