নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম স্বাধীনতাকামী নেতা। যিনি আপোষ আলোচনা ও তাবেদারি করে নয় সরাসরি বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ভারতকে স্বাধীন করার অঙ্গীকার করেছিলেন। তিনি নেতাজি নামেই বিশেষভাবে অভিহিত হয়ে থাকেন। সুভাষ চন্দ্র বসু ফরওয়ার্ড ব্লক নামক একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের পূর্ণ ও সত্বর স্বাধীনতাকে তরান্বিত করতে চেয়েছিলেন। নেতাজির শুভজন্মলগ্নে আজকের এ আলোচনা করেছেন ফৈয়াজ আহমেদ...
ঐতিহাসিকদের মতে, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট, সুভাষচন্দ্র বসুকে বহনকারী জাপানি বিমান, জাপান শাসিত ফোরমোসায় বর্তমান তাইওয়ানে বিধ্বস্ত হওয়ার পর, আগুনে দগ্ধ হয়ে সুভাষ চন্দ্র বসুর মৃত্যু ঘটে। তবে এই তথ্য নিয়ে এখনো অনেক বিতর্ক রয়েছে মানুষের মনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর পূর্ব রণাঙ্গনে জাপানি সেনাবাহিনীর মনোবল একেবারে তলানিতে ঠেকেছিল। সেই সময়েই সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুর থেকে ব্যাংকক হয়ে সাইগনে পৌঁছেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুর থেকে ব্যাংকক হয়ে সাইগনে পৌঁছেছিলেন কিন্তু সেখান থেকে এগোনোর জন্য একটাও জাপানি বিমান ছিল না। অনেক চেষ্টার পরে একটা জাপানি বোমারু বিমানে জায়গা পেয়েছিলেন তিনি। বিমানঘাঁটিতে তাকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের যেসব সহকর্মী, তাদের সঙ্গে করমর্দন করে ‘জয় হিন্দ’ বলে অভিবাদন জানিয়ে কিছুটা লাফিয়েই বিমানের সিঁড়িগুলো বেয়ে উপরে উঠে গিয়েছিলেন তিনি। তিনি বিমানে ওঠার পরেই অন্যদের ‘জয়-হিন্দ’ অভিবাদন জানিয়ে তার এডিসি কর্নেল হাবিবুর রহমানও বিমানে উঠে গিয়েছিলেন। মি. বসুর ওপরে ‘লেইড টু রেস্ট’ নামের বইটির লেখক, সিনিয়র সাংবাদিক আশিস রায় বলছিলেন, “ওই বিমানটিতে ক্রুসহ ১৪ জন ছিলেন। পাইলটের ঠিক পিছনেই নেতাজী বসেছিলেন। তার সামনে পেট্রোলের বড় বড় জেরিক্যান রাখা ছিল। নেতাজীর পিছনেই ছিলেন কর্নেল হাবিবুর।” “বিমানে চড়ার সঙ্গে সঙ্গেই জাপানিরা নেতাজীকে সহ-পাইলটের আসনে বসার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সেই অনুরোধ তিনি বিনম্রভাবে ফিরিয়ে দেন। ঘটনা হল, সহ-পাইলটের আসনটি তার মতো লম্বা মানুষের জন্যে বেশ ছোট ছিল,” বলছিলেন মি. রায়। তার কথায়, “পাইলট আর লেফটেন্যান্ট জেনারেল শীদে ছাড়া বাকি সকলেই বিমানের মেঝেতেই বসেছিলেন। নেতাজীকে একটা ছোট কুশন দেওয়া হয়েছিল। কারও কাছেই সীট বেল্ট ছিল না।”ওই বোমারু বিমানের ভেতরে ভীষণ ঠাণ্ডা লাগছিল সবার। তখনকার দিনে যুদ্ধবিমানে এয়ার কন্ডিশনার লাগানো থাকত না। প্রত্যেক হাজার মিটার ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বিমানের তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি করে কমে যেত।ঠাণ্ডা আটকাতে সুভাষচন্দ্র বসু তার এডিসি কর্নেল হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে তার জ্যাকেটটা চেয়ে নিয়েছিলেন। দুপুর দুটো ৩৫ মিনিটে বোমারু বিমানটি জমি ছেড়ে আকাশে উড়েছিল। শাহনওয়াজ কমিশনে (বিমান দুর্ঘটনায় মি. বসুর মৃত্যু হয়েছিল কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে ভারতের গঠিত প্রথম সরকারি কমিটি) দেওয়া সাক্ষ্যে কর্নেল হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, “বিমান তখনও বেশি উপরে ওঠে নি। বিমানঘাঁটির চৌহদ্দির মধ্যেই ছিল। সেই সময়েই বিমানের সামনের দিকে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। পরে জেনেছিলাম বিমানের একটা প্রোপেলার ভেঙ্গে নীচে পড়ে গেছে। বিমানটা নীচে পড়ে যেতেই সামনের দিকে আর পেছনের দিকে আগুন লেগে গিয়েছিল।” “বিমান ভেঙ্গে পড়তেই নেতাজী আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম, সামনের দিক দিয়ে বের হওয়ার জন্য। পেছনের দিকে যাওয়ার জায়গা নেই। সামনের দিকেও আগুন জ্বলছিল। তার মধ্যে দিয়েই তিনি বাইরে বেরিয়ে যান। কিন্তু তিনি যেখানে বসেছিলেন, তার সামনে রাখা পেট্রল ভর্তি জেরিক্যান থেকে তেল বেরিয়ে তার কোট পুরো ভিজে গিয়েছিল,” শাহনওয়াজ কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জানিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কর্নেল হাবিবুর রহমান। তিনি আরও বলেছিলেন, “আমি বাইরে এসেই দেখি নেতাজী ১০ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। পশ্চিমের দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি। ততক্ষণে তার পোশাকে আগুন লেগে গেছে। আমি তার দিকে দৌড়ে গিয়ে অনেক চেষ্টার পরে তার ‘বুশর্ট বেল্ট’টা খুলতে পারলাম। তারপরে তাকে মাটিতে শুইয়ে দিই আমি। তার মাথার বাঁদিকে প্রায় ৪ ইঞ্চি লম্বা একটা গভীর ক্ষত।” “একটা রুমাল দিয়ে ওই ক্ষত থেকে রক্তপাত বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম। তখনই নেতাজী আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমার বেশি চোট লাগে নি তো?’ বলেছিলাম যে আমি ঠিক আছি,” জানিয়েছিলেন কর্নেল রহমান। “উনি বলেছিলেন মনে হচ্ছে আমি আর বাঁচব না। আমি ভরসা দিয়েছিলাম, ‘আল্লাহ আপনাকে বাঁচাবে’। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে না। দেশে ফিরে গিয়ে সবাইকে জানিও যে আমি শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলাম। তারা যেন এই লড়াই জারি রাখে। ভারত নিশ্চয়ই স্বাধীন হবে,” এভাবেই সেই ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন তিনি।
দশ মিনিটের মধ্যেই উদ্ধারকারী দল বিমানঘাঁটিতে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনো অ্যাম্বুলেন্স ছিল না। তাই সুভাষচন্দ্র আর বাকি আহতদের সেনাবাহিনীর একটা ট্রাকে করেই তাইহোকু সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মি. বসুকে প্রথম যে চিকিৎসক পরীক্ষা করেছিলেন, তার নাম ছিল ডাক্তার তানইয়াশি ইয়োশিমি। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু যখন কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হন, তখন সুভাষচন্দ্র তার অধীনে কর্মরত ছিলেন ডাক্তার ইয়োশিমি বলেছিলেন, “গোড়ায় সব আহতদের একটা বড় ঘরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরে মি. বোস আর মি. রহমানকে একটা অন্য ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। দুর্ঘটনায় আহত অন্য জাপানি সৈনিকরা ব্যথায় চিৎকার করছিল তখন। তাই ওদের দু’জনকে আলাদা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। মি. বসুর ভীষণ জলপিপাসা পেয়েছিল। তিনি জাপানি ভাষাতেই জল চাইছিলেন বার বার - মিজু, মিজু করে। সেখানে যে নার্স ছিলেন, আমি তাকে বলি একটু জল দিতে।” সুভাষচন্দ্রের আঘাতের বর্ণনা করতে গিয়ে ডাক্তার ইয়োশিমি বলেছিলেন, তিনটের সময়ে এক ভারী চেহারার মানুষকে সেনাবাহিনীর ট্রাক থেকে নামিয়ে স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হয়। তার মাথা, বুক, পিঠ, হাত, পা, এমনকি তার হৃদযন্ত্রও - সব সাংঘাতিকভাবে পুড়ে গিয়েছিল। তার চোখগুলো ফুলে গিয়েছিল। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু চোখ খুলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। জ্বর ছিল গায়ে, ১০২.২ ডিগ্রি। পালস রেট হয়ে গিয়েছিল প্রতি মিনিটে ১২০। তাকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার জন্য বিটা-ক্যাম্ফোর-এর চারটে আর দুটো ডিজিটামাইন ইনজেকশন দিয়েছিলাম। তারপরে ড্রিপ চালু করি। এছাড়া সংক্রমণ যাতে না ছড়ায়, তার জন্য সালফানামাইড ইনজেকশনও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি বুঝতেই পারছিলাম, এত কিছুর পরেও বোস আর বেশিক্ষণ জীবিত থাকবেন না। হাসপাতালেই হাজির ছিলেন আরেক চিকিৎসক ডাক্তার ইয়োশিও ইশি। তিনিও সুভাষ বসুর অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন। আহত দু’জন দুটো আলাদা খাটে শুয়ে ছিলেন। একজন এতটাই লম্বা ছিলেন যে তার পা খাটের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। একজন নার্স ডাক্তার ইয়োশিমিকে ডেকে বলেছিলেন, ‘ডক্টর, ইনিই ভারতের চন্দ্র বোস। রক্ত দিতে হবে উনাকে। আমি শিরা খুঁজে পাচ্ছি না, প্লিজ একটু সাহায্য করুন আমাকে। জখন রক্ত দেওয়ার জন্য ডাক্তার ইয়োশিমি তার শিরায় সুচ ফোটালেন, কিছুটা রক্ত সুচ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। রক্তের রঙটা ছিল গাঢ়। মৃত্যুর কিছুটা আগে থেকেই রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যেতে থাকে আর রক্তের রঙ পাল্টাতে থাকে। বেশ খানিকটা অবাকও হয়েছিলেন তিনি। পাশের ঘরে দুর্ঘটনায় আহত জাপানি সৈনিকরা ব্যথায় চিৎকার করছিল, কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসুর মুখ থেকে একটা শব্দও বের হয়নি। ১৮ অগাস্ট, ১৯৪৫, রাত প্রায় ন’টার সময়ে সুভাষ চন্দ্র বসু শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
আশিস রায়ের কথায়, “জাপানে মৃতদের ছবি তোলার প্রথা নেই। কিন্তু কর্নেল রহমান বলেছিলেন যে তিনি জেনে-শুনেই সুভাষচন্দ্রের ছবি তুলতে দেন নি। কারণ তার শরীর তখন বেশ ফুলে গিয়েছিল।” “জাপানি সেনাবাহিনীর মেজর নাগাতোমোর কথা অনুযায়ী, তার গোটা শরীরেই ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল। ওর পার্থিব শরীরটা ঘরের এক কোনে রেখে দেওয়া হয়েছিল। চারদিকে একটা পর্দা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সামনে কয়েকটা মোমবাতি জ্বলছিল। ফুলও ছিল কিছু। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জানুয়ারি, বর্তমান ভারত-এর উড়িষ্যার কটক শহরে জন্মগ্রহণ করেন সুভাষ চন্দ্র বসু। তার পৈত্রিক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কোদালিয়া নামক গ্রামে। তার পিতা জানকীনাথ বসু ছিলেন সেসময় এর দক্ষ আইনজীবী। কর্মক্ষেত্রে ছিল কটক। তার মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী। তিনি ছিলেন পিতামাতার চোদ্দ সন্তানের মধ্যে নবম। সুভাষের জন্মের সময় তার পিতামাতা কটক শহরে ছিলেন। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত তিনি কটকের একটি ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করেন। বর্তমানে এই স্কুলটির নাম স্টিওয়ার্ট স্কুল। এরপর তাকে ভর্তি করা হয় কটকের র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে এই স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত এই পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রেসিডেন্সি কলেজ-এ ভর্তি হন। এই কলেজের ইংরেজি অধ্যাপক ওটেন ভারত-বিদ্বেষী কথাবার্তার জন্য সুভাষ চন্দ্র বসু এর সরাসরি বিরোধীতা করেন। ফলে অধ্যাপক ওটেন-এর সমর্থকদের দ্বারা তিনি প্রহৃত হন। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ কয়েকজন ছাত্রসহ সুভাষ বসুকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। এরপর তিনি স্যার আশুতোষ চৌধুরী সহায়তায় স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে লেখাপড়ার সময় তিনি ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর-এ যোগ দেন এবং সমরবিদ্যার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে তিনি থেকে দর্শনে বি.এ (সম্মান) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর অভিভাবকরা তাকে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য বিলাত পাঠান । ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে ইংল্যান্ডে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই কলেজের পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন এবং মরাল সায়েন্স কেম্ব্রিজ ট্রাইপস অধিকার করেন। ইতিমধ্যে ভারতে নানা রকমের ঘটনা ঘটে যায়। যেমন ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে রাউটাল বিল বাতিলের জন্য গান্ধীজী দরখাস্ত করেন। এপ্রিল মাসে সর্বভারতীয় সত্যগ্রহ আন্দোলন শুরু হয় এবং সারা ভারতবর্ষে হরতাল পালিত হয়। এরপর পাঞ্জাবে তার প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে, গান্ধীজী পাঞ্জাবে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এই কারণে দিল্লী যাওয়ার পথে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
১৩ই এপ্রিল তারিখে জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকাণ্ডের পর গান্ধীজী সবরমতী আশ্রমে ৩ দিনের উপবাস করেন। ১৪ই এপ্রিল তারিখে নদীয়াতে স্বীকার করেন যে, সত্যাগ্রহ করে তিনি হিমালয়তূল্য ভুল করেছেন। গান্ধীজী’র এই আন্দোলন এবং জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর পরই সুভাষ চন্দ্র বসু তীব্র বৃটিশ বিরোধী হয়ে উঠেন।ফলে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা প্রত্যাখ্যান করে তিনি ভারতে ফিরে আসার উদ্যোগ নেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল তা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়া”। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই জাহাজ থেকে নেমেই সরাসরি গান্ধীজী’র সঙ্গে দেখা করেন সুভাষ চন্দ্র বসু। গান্ধীজী’র নির্দেশে তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে দেখা করেন। উল্লেখ্য এই সময় চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন সবার রাজনৈতিক গুরু। কলকাতায় ফিরে তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের অনুপ্রেরণায় স্বরাজ নামক সংবাদপত্রে লেখালিখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু যখন কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হন, তখন সুভাষচন্দ্র তার অধীনে কর্মরত ছিলেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতাদের সঙ্গে তাকেও বন্দী করা হয় এবং মান্দালয়ে নির্বাসিত করা হয়। উল্লেখ্য ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের রেগুলেশন দ্বারা তিনি বন্দী হয়েছিলেন। এখানে তিনি অত্যন্ত নিন্মমানের পরিবেশের কারণে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। সুভাষচন্দ্র পরপর দু-বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত এবং কংগ্রেসের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করার জন্য তাকে জাতীয় কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করতে হয়। সুভাষচন্দ্র মনে করতেন গান্ধিজির অহিংসার নীতি ভারতের স্বাধীনতা আনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। এই কারণে তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের পক্ষপাতী ছিলেন। সুভাষ চন্দ্র বসু ফরওয়ার্ড ব্লক নামক একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের পূর্ণ ও সত্বর স্বাধীনতকে তরান্বিত করতে চেয়েছিলেন। তার বিখ্যাত উক্তি “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।” এজন্য তিনি এগারো বার কারাভোগ করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরেও সুভাষ চন্দ্র বসুর মতাদর্শের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি; বরং এই যুদ্ধকে ব্রিটিশদের দুর্বলতার সুবিধা আদায়ের একটি সুযোগ হিসেবে দেখেন। যুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি লুকিয়ে ভারত ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি ও জাপান ভ্রমণ করেন ভারতে ব্রিটিশদের আক্রমণ করার জন্য সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে। জাপানিদের সহযোগিতায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন এবং পরে তার নেতৃত্ব দান করেন। এই বাহিনীর সৈনিকেরা ছিলেন মূলত ভারতীয় যুদ্ধবন্দি এবং ব্রিটিশ মালয়, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে কর্মরত মজুর। জাপানের আর্থিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় তিনি নির্বাসিত আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বদান করে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে বর্তমান মায়ানমার যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নাৎসি ও অন্যান্য যুদ্ধবাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের জন্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ সুভাষচন্দ্রের সমালোচনা করেছেন; এমনকি কেউ কেউ তাকে নাৎসি মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বলে অভিযুক্ত করেছেন। তবে ভারতে অন্যান্যরা তার ইস্তাহারকে রিয়েল পোলিটিক নৈতিক বা আদর্শভিত্তিক রাজনীতির বদলে ব্যবহারিক রাজনীতি -এর নিদর্শন বলে উল্লেখ করে তার পথপ্রদর্শক সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করেছেন। উল্লেখ্য, কংগ্রেস কমিটি যেখানে ভারতের অধিরাজ্য মর্যাদা বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পক্ষে মত প্রদান করে, সেখানে সুভাষচন্দ্রই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে সরাসরি মত দেন। জওহরলাল নেহরু সহ অন্যান্য যুবনেতারা তাকে সমর্থন করেন। শেষপর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রস পূর্ণ স্বরাজ মতবাদ গ্রহণে বাধ্য হয়। ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি ও তার জীবন রক্ষায় কংগ্রেস নেতাদের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ সুভাষচন্দ্র গান্ধি-আরউইন চুক্তি বিরোধী একটি আন্দোলন শুরু করেন। এর ফলে সুভাষ চন্দ্র বসুকে কারারুদ্ধ করে ভারত থেকে নির্বাসিত করা হয়। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তিনি ভারতে ফিরে এলে আবারও তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct