অপরাধী
মোহাম্মদ আবদুর রহমান
সাহিদ প্রাইভেট পড়ার জন্য রোজ সকালবেলা ইকবাল মাস্টারের বাড়ী যায়। আজও সে প্রতিদিনের মত প্রাইভেট পড়ার জন্য রাস্তায় হাঁটছে। আজ প্রচুর শীত পড়ছে। রাস্তা ঘাট ভালো করে দেখা যায় না। শীতের রানী যেন তাকে আদর করে শিশির দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে। আর তার এই রকম পরিবেশের মধ্যে নিজেকে মেলে ধরতে ভীষণ ভালো লাগছে। যেহেতু সে শীতের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পোশাক পরে আছে। তাই সে কুয়াশার সাথে খেলতে খেলতে মনের সুখে গুনগুন করে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এই শীত যে কত অসহায় মানুষের বুকের উপর নাচানাচি করছে। কেড়ে নিয়েছে তাদের সুখের অনুভূতি গুলি। তারা এই শীতের কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রভুর কাছে প্রার্থনা করে। তার নিষ্পাপ হৃদয়ে এই রকম অনুভূতি কোন দিন সৃষ্টি হয়নি। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর সাহিদের সুখের পরিবেশ এক নিমিষে পাল্টে গেল। পাল্টে গেলো তার সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কিত ধারণা। সে নীরবে সমাজের সকল হিসেব মিলাতে লাগল তার অনুসন্ধানী চোখ দিয়ে। কিছুতেই মেলেনা হিসেব। তার বুকের ভেতর প্রতিফলিত হতে থাকে শুধু একটি দৃশ্য। যা সে একটু আগে দেখেছে। মূত্র ত্যাগ করার জন্য সে রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে একটা বাড়ির পাশে যায়। শুনতে পায় সেই বাড়িতে বসবাস করা এক মা ছেলের কথপকথন। সেই ছেলেটির কথা যে তার মাকে বার বার বলছিল একটি নতুন শীতের পোশাক কিনে দেওয়ার জন্য। তার মা করুন সুরে বলল - আমরা গরীব বাবা। প্রতি বছর তো তোকে নতুন পোশাক কিনে দিতে পারব না। ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে বলল- এই পোশাকটা তো আমার নয়। দাদার পোশাক আমি পরছি। আমি বেশিরভাগ সময় দাদার পরিত্যক্ত পোশাক পরিধান করি। আর যেভাবে এই পোশাকটি মেরামত করার জন্য সেলাই করা হয়েছে তাতে একটি পোশাক দুটি পোশাকের ওজনের সমান। আমার কি নতুন পোশাক পরার অধিকার নেই! - অবশ্যই আছে। তবে পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কথা ভেবে বাঁচার জন্য ছেড়া পোশাক পরতে হবে বাবা। বিনেদন করার মত পরিবেশ আমাদের নেই। আমরা লুপ্তপ্রায় প্রাণীর মত অস্তিত্বহীনতায় ভুগছি। দারিদ্রতার বাতাস বইতে শুরু করলে মনে হয় আজ হয়তো জীবনের শেষ দিন। -আমরা গরিব হলেও তো মানুষ। অন্যান্য মানুষের মত আমারও সমাজের সাথে অভিযোজন করতে চাই। - তা ঠিক। তবে জানিস বাবা আমাদেরও মনে হয় তোকে উন্নত বাতির মত সমাজের নক্ষত্র তৈরি করি। যাতে তোর দিকে তাকিয়ে জীবনের সকল আঁধার মুছে ফেলতে পারি। কিন্তু তা করতে পারি না বাবা। ফলে তোদের দিকে দেখলে বুকের ভেতর সৃষ্টি হয় ব্যথার কালবৈশাখী ঝড়। বারবার মনে হয় আমরা তোর অযোগ্য বাবা মা। তাই বলছি বাবা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দেও। - এমন কথা বলো না মা। তুমি তো আমার জীবনের সেরা উপহার। তোমার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি মা। -আমাদের উচিত তোদের আলোকিত করে রাখার। কিন্তু আমরা নিজেরা অন্ধকারে ডুবে আছি আর তোদের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। -আমরা পশু হয়ে জন্মালে বেশি ভালো হত। পশুদের তে কোন পোশাক লাগেনা। আর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানবদের সৃষ্টি বৈষম্যমূলক সমাজে বসবাস করতে হত না। আর তোমাকে কোনো কষ্ট পেতে হত না।
-ঠিক বলেছিস বেটা। সমাজের বিত্তশালী মানুষেরা যেভাবে অপচয় খরচ করে তার কিছু অংশ আমাদের মত অসহায় মানুষদের জন্য ব্যবহার করলে তোর মত আর কাউকে কাঁদতে হতো না বাবা। সমাজের বিত্তশালী মানুষেরা অপচয় করতে যতটা আনন্দ পায় অসহায় মানুষদের দেখলে তার থেকে বেশি ঘৃণা করে। অর্থ তাদের অন্ধ করে রেখেছে। তাই অসহায় মানুষের আর্তনাদ তাদের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছায় না। ফলে তাদের থেকে দূরে সরে থাকাই ভালো। এই সব দৃশ্য সাহিদ জানালা দিয়ে দেখছিল। সে অনুমান করছে ছেলেটির বয়স তার বয়সের কাছাকাছি। সেই ছেলেটি মায়ের কষ্ট পাওয়ার কথা শুনে কান্না বন্ধ করে দিল। কিন্তু সে কিছুতেই ভুলতে পারেনা সেই দৃশ্য। সে মনে করছে এরকম পরিস্থিতির জন্য সমাজের বিত্তশালী মানুষ গুলো দায়ী। তারা যদি এই সব অসহায় মানুষ গুলির পাশে দাঁড়াত তাহলে হয়তো ছেলেটি তার মত শীতের আনন্দ উপভোগ করতে পারত। কিন্তু বিত্তশালী তা না করে নিজের সম্পদ আর কি ভাবে বাড়ানো যায় তাই ভাবে। অথচ এই সম্পদ মৃত্যুর পর আর কাজে আসবে না। এই সব হিসেব মেলাতে মেলাতে প্রাইভেট পড়ার জন্য ইকবাল সাহেবের বাসা পৌঁছাল। নীরব হয়ে বসে পড়ে এক কোণে। অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা আস্তে আস্তে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু সে অন্যান্য দিনের মত সহপাঠীদের সাথে হাসি ঠাট্টায় অংশগ্রহণ না করে গালে হাত দিয়ে ভাবছে। তা দেখে অন্যান্যরা আশ্চর্য। যে সাহিদ সারাক্ষণ হাসি আর হাসি নিয়ে ব্যস্ত তার মুখে এরকম নীরবতার জয় লাভ শোভা পায় না। কেউ কেউ তাকে এর কারণ জানতে চাইলে সে কোন উত্তর না করে নিরবতার জয় গান গাইতে থাকে। এর মধ্যে ইকবাল মাস্টারমশাই প্রাইভেট রুমের ভিতরে প্রবেশ করলেন। পড়াতে শুরু করলেন আগের দিনের মতো।
কিছুক্ষণ পর ইকবাল মাষ্টারের নজর পড়ে সাহিদের দিকে। তিনি আশ্চার্য হয়ে যান। তিনি মনে করেন কেউ তাকে কোন না কোন ভাবে আঘাত করেছে?না হয় তার কোন অসুখ হয়েছে ?কেন না এমন ভাবে নীরবতা পালন করার মত সে ছেলে নয়। দুই দিন আগে তার দুষ্টুমির জন্য রাগ করে ইকবাল সাহেব তাড়াতাড়ি প্রাইভেট শেষ করে দেন। আসলে সাহিদ এর বাবা ইকবাল সাহেবের নিকট আত্মীয় তাই তাকে পড়াচ্ছেন। তা না হলে কোন আগেই তাকে প্রাইভেট থেকে বের করে দিতেন। ইকবাল সাহেব তার নীরবতা ভঙ্গ করতে চাননি। আজ অন্তত কিছুটা শান্তি পাওয়া যাবে এমনি ভাবছেন। তাই তিনি সকল প্রশ্ন বুকের ভেতর সঞ্চিত রেখে পড়াতে থাকলেন। পড়ানোর এক্কেবারে শেষে ইকবাল সাহেব সাহিদের কাছে গিয়ে বলেন- আজ তোমার কি হয়েছে?তোমার বিষণ্ন মন কি খুঁজছে? নীরবতার ভঙ্গ করে বলেন-আসলে স্যার আমাকে অপরাধী মনে হচ্ছে। ইকবাল সাহেব মনে মনে ভাবছেন- সে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে এত দিন সে অপরাধ করেছে। অবাধ্য ছেলের মত নিজেকে গড়ে তুলে ছিল সে। তবে সে মনের ভেতরেই রেখে বললেন -কেন? -আসলে এসব কথা বলা ঠিক হবেনা। সকল ছাত্রছাত্রীরা বলে না তোকে বলতেই হবে। আমরা জানতে চায় কেন তুই অপরাধী। ইকবাল সাহেব মনে মনে বলছেন ছেলে মেয়েরা ঠিক বলেছে। তিনি চাইছেন সাহিদ নিজের সকল ভুল স্বীকার করুক। তাই তিনি বললেন-বল সাহিদ তোমার মনের কথা। সাহিদ বলতে শুরু করল আজকের দেখা তার করুন দৃশ্যটি। শিক্ষক সহ সকল ছাত্রছাত্রী স্ট্যাচুর মত নীরব হয়ে শুনল। সেই দৃশ্যের জন্য সে নিজেকে থেকে সকল বিত্তশালী মানুষদের অপরাধী বলল। তা শুনার পর সকলের বুকের ভেতর অনুসুচনার ঝড় সৃষ্টি হল। আসলে সবাই অপরাধী। কারণ প্রায় সবাই বিত্তশালী পরিবারে জন্মেছে। আর তারা প্রত্যেকেই অত্যাধিক অপচয় খরচ করে। ইকবাল মাষ্টার একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষকতা করেন। তাছাড়া অনেক জমির মালিক। তাই ইকবাল সাহেবর বুকের ভেতরও আমি অপরাধী শব্দটি প্রতিফলিত হতে থাকলো।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct