সম্প্রতি তালিবান শাসিত আফগান সরকার ঘোষণা করেছে, উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ মহিলাদের। তাই বিদ্বজ্জনরা বলছেন আফগান মহিলাদের পড়াশোনায় নিষেধাজ্ঞা মৌলিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকেও এর তীব্র প্রতিবাদ এসেছে। মিশরের আল আজহার মসজিদের গ্র্যান্ড ইমাম শেখ আহমেদ আল-তায়েব, যাকে সুন্নি ইসলামের সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ বলে মনে করা হয়, এক বিবৃতিতে বলেছেন, আফগানিস্তানে মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত তালিবান নিয়েছে, তা ইসলামী শরিয়াহ আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, শরিয়াহ আইনে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারী ও পুরুষকে জ্ঞানার্জন করতে বলা হয়েছে। তা নিয়ে লিখেছেন সরদার সিরাজ। আজ শেষ কিস্তি।
এটা মানবাধিকার সনদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। নারীরা বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে বলেছে, নারী শিক্ষার্থীরা ক্লাসে না ফেরা পর্যন্ত তাঁরা বর্জন কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের এক বৈঠকে আফগান মানবাধিকার বিষয়ক সক্রিয়বাদী মাহবুবা সিরাজ বলেছেন, আমাদের মুছে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে আফগানিস্তানে মানবাধিকারের কোনো অস্তিত্ব নেই। তালিবানের কাছে আফগানিস্তানের নারীদের অস্তিত্ব নেই। আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়তা মিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধানও তালিবানকে এনজিওতে নারীকর্মী নিয়োগের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও দেশটিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী ও মেয়েদের পূর্ণ, সমান ও অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য দেশটির কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ওআইসিও একই অনুরোধ করেছে। সর্বোপরি জাতিসংঘ কিছু কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করার পাশাপাশি অন্য অনেক কার্যক্রমও স্থগিতের বিষয়ে সতর্ক করেছে। এর পর হয়তবা দেশটির সব এনজিও তাদের কর্ম বন্ধ করে দেবে। এমনকি বিভিন্ন দেশ যে সাহায্য দিচ্ছে, তাও বন্ধ হতে পারে। এসব হলে সাহায্যনির্ভর আফগানিস্তানে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হবে!
ইতোপূর্বেও তালিবান নারীর উন্নতিবিরোধী নানা কর্ম করেছে, যার অন্যতম হচ্ছে, গত বছরের মার্চে নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে, মেয়েদের জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া। তাতে প্রায় ৩৫ লক্ষ শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এর পর গত এপ্রিলে হাজার হাজার সরকারি নারী কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছে। একই মাসে একজন পুরুষ অভিভাবক ছাড়া প্রত্যেক নারীকে কাবুল বিমানবন্দরে বিমানে উঠতে এবং পুরুষ আত্মীয় ছাড়া নারীদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। গত মে মাসে টেলিভিশনে উপস্থিত হওয়ার সময় প্রত্যেক নারীকে মুখ ঢেকে রাখার নির্দেশ দিয়েছে, ১৩ বছরের বয়সী মেয়েদের যে কোনও বয়সের পুরুষের সাথে বিয়ে দেওয়ার নিয়ম চালু ও সব নারীকে জনসম্মুখে তাদের মুখ ও শরীর ঢেকে রাখার নির্দেশ এবং গত জুলাই মাসে কাবুলে গ্র্যান্ড অ্যাসেম্বলি থেকে নারীদের বাদ দিয়েছে। তালিবানের ক্ষমতা গ্রহণের এখনও এক বছর অতিক্রান্ত হয়নি। এর মধ্যে মার্কিনসৃষ্ট খাদ্য সংকট আরো তীব্রতর হয়েছে। শত চেষ্টা সত্ত্বেও বিশ্বের একটি দেশেরও স্বীকৃতি মিলেনি। বৈশ্বিক সাহায্যও প্রয়োজনমত পাওয়া যায়নি। দেশটিতে আইএস নির্মূল হয়নি। তারা প্রায়ই বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হামলা চালিয়ে জানমালের ক্ষতি করছে। গত ১ জানুয়ারি কাবুলের সামরিক বিমানবন্দরে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে বহু হতাহত হয়েছে। এনআরএফও সক্রিয় আছে। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বও রয়েছে। পাকিস্তানের সাথে মধুর সম্পর্কের মধ্যেও প্রায়ই সীমান্তে সংঘর্ষ হচ্ছে। প্রায় ৪ কোটি জনসংখ্যার দেশটির পুনর্গঠনের কাজও শুরু হয়নি। সে অর্থও নেই। গত বছরের ১১ জানুয়ারি জাতিসংঘ বলে, ২০২২ সালে আফগানিস্তানে মানবিক বিপর্যয় ঠেকানো ও বিধ্বস্ত দেশটি পুনর্নির্মাণে তাদের ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের তহবিল দরকার, যার বিন্দুমাত্রও সংগৃহীত হয়নি। ফলে মানবিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। যুদ্ধ করে যারা দেশটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে, তাদের দায়িত্ব দেশটি পুনর্গঠন করার। কিন্তু তারাও ফিরে তাকায়নি। বরং তাদের ব্যাংকগুলো আফগান রিজার্ভ জব্দ করেছে, যা তালিবান ছাড় করাতে পারেনি। বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগও নেই। ফলে মানুষের জীবনমানের উন্নতি তো হয়ইনি, বরং অনেক অধোগতি হয়েছে। সম্প্রতি সেফ দ্য চিলড্রেন বলেছে, আফগান শিশুদের অধিকাংশই অর্ধাহার ও অনাহারের মুখে পড়েছে। এই অবস্থায় নারীর উন্নতিবিরোধী নানা কর্মের কারণে আফগানরা চরম অসন্তুষ্ট হয়েছে। (সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct