প্রতিবন্ধী হয়েও নিজ নিজ প্রতিভার বিকাশ ঘটান বর্তমান শতাব্দীর শারীরিক প্রতিবন্ধী শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, জন্মান্ধ ফরাসি সাহিত্যিক রোদাকি, খঞ্জ লর্ড বায়রন, আধুনিক আরবি কবিতার জনক অন্ধ বাশ্শার বিন বোরদ, আধুনিক আরবি সাহিত্যের অন্যতম জনক অন্ধ ড. তাহা হোসাইন, আরবি ভাষার মহান কবি এবং যুক্তিবাদী দার্শনিক অন্ধ কবি আবুল আলা আল মা’আরি, শারীরিক সমস্যাগ্রস্ত হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিন, মহান সুরস্রষ্টা বধির বিটোভেন, বিখ্যাত আমেরিকান অন্ধ গায়ক রে চার্লস প্রমুখ। এই সাফল্য বা সফলতা শুধু স্বাভাবিক মহামানব বা মনীষীরাই নয়, অস্বাভাবিক শারীরিক গঠন বা প্রতিবন্ধীরাও এর থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। তা নিয়ে লিখেছেন কায়সার আলি। আজ শেষ কিস্তি।
প্রবল ইচ্ছাশক্তি, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি মত্তা তাকে ৫ বছরে টেলিফোন আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল পরীক্ষা করে দেখেন যে, আর কোনোদিন তিনি চিরসবুজ ধরণি দেখতে, তার প্রিয়তমা মাকে ‘মা’ বলে ডাকতে এবং প্রাণ প্রিয় বাবার কথা শুনতে পাবেন না। তার জীবন এখন শেষ, নতুন করে শুরু। ৮ বছর বয়সে হাতের আঙুলে দিয়ে দাগ কেটে লেখা, ব্রেইল পদ্ধতিতে শব্দ ও বাক্য উচ্চারণ অর্থাৎ লেখাপড়া পুনঃরায় শুরু করলেন। এই সাফল্যে সবাই অবাক হয়ে যায়। শিক্ষকের মুখের কম্পন ঠোঁট ও জিহ্বার নড়াচড়া হাত দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করতেন। ১৪ বছর বয়সে আমেরিকার নিউইয়র্কের রাইট হুমার্সন নামে স্কুলে ভর্তি হন। ১৯০৪ সালে তিনির্ যাডক্লিক কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ঙয! যার নাম না লিখলে হেলেনের জীবন অসম্পূর্ণ থাকবে- তিনি হলেন তার শিক্ষিকা অ্যান স্যালিভান। তাদের দু’জনের জীবন একসূত্রে গাঁথা হয়ে এক অবিভাজ্য আত্মায় পরিণত হয়েছিল। হেলেন নিজেই লিখেছেন ‘তিনি যে বিশ্বের মানুষের সামনে দাঁড়াতে পেরেছেন তার সবটুকু কৃতিত্ব তার পারকিন্স ইনস্টিটিউশনের ভুবন জয়ী মহতী শিক্ষিকার জন্য। ছাত্রীর হাতের উপরে নির্দিষ্ট আঙুল সঞ্চালন করে তাকে শিক্ষা দেন এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে। হেলেন প্রশ্ন জেনে টাইপ মেশিনে টাইপ করে বা হাতের আঙুলের ইশারায় উত্তর দিতেন। হেলেন ৩৬ ও ৪২ বছর বয়সে দুজনের সঙ্গে পরিচিত হলেও পারিবারিক জীবনে প্রবেশ করেননি। তাদের প্রস্তাবের উত্তরে বলতেন, “আমাদের জীবন হবে ঘনকুয়াশার মধ্যে নদীতে চলা দুটো নৌকার মতো। তিনি ইংরেজি, ল্যাটিন, ফরাসি, জার্মান ও গ্রিক ভাষা জানতেন এবং বই লিখেছেনও বই পড়েছেন অনেক জ্ঞানী লোকের চেয়েও বেশি। তিনি নিজে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, সঙ্গীত উপভোগ করতেন বাদ্য যন্ত্রের উপর হাত রেখে। হাতের ছোঁয়া দিয়ে শ্রবণের কাজ করতেন, মানুষের সঙ্গে করমর্দন করলে বলে দিতে পারতেন আগের পরিচিত কিনা? সাঁতার কাটা, নৌকা চালানো, দাবা খেলা, তাস খেলা এবং ঘরে বসে নকশিকাঁথা সেলাই করতে পারতেন। কম্পনের অনুভূতি থেকে বলে দিতে পারতেন ছুতোর মিস্ত্রি করাত দিয়ে কাঁটছে, না রাঁদা চালাচ্ছে, না হাতুড়ি পেটাচ্ছে। ফুলের পাপড়ি স্পর্শ করে ফুলের রং বলে দিতে পারতেন। তিনি নারী ও কালো মানুষের অধিকারে সর্বদা সচেতন ছিলেন। তিনি রাজনীতি করেছেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর পর্বে যোগদান করতেন। তিনি আমাদের মতো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলতেন ‘আমি অন্ধ- তোমরা যারা দেখতে পাও, তাদের আমি একটা কথা বলে যেতে চাই- চোখ দু’টোকে তোমরা এমনভাবে ব্যবহার করো যেন আগামীকালই তুমি অন্ধ হয়ে যাবে- আর দেখবে না। তোমার অপর সব ইন্দ্রিয়ের বেলায়ও এমন করে ভাবতে শেখো। সুরের আওয়াজ, পাখির গান, বাদ্যকারের বাজনা এমনভাবেই শুনবে, যেন কালই তুমি বধির হয়ে যাবে। প্রতিটি জিনিস এমন ভাবে ছুঁয়ে দেখবে, যেন তোমার স্পর্শ শক্তি অবলুপ্ত হবে আগামীকালই। এমনভাবে নেবে ফুলের ঘ্রাণ আর খাদ্যের স্বাদ যেন আগামীকাল আর তোমার গন্ধ কিংবা স্বাদের অনুভূতি অবশিষ্ট থাকবে না। সব ইন্দ্রিয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার কর- প্রকৃতির সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ কর’। পৃথিবীর কয়েকটি দেশ তাকে সম্মানসূচক ডিগ্রি, নাইট উপাধি এবং ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক বিশেষ সম্মানে ভূষিত করে। তিনি মনে করতেন, সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা বুদ্ধির জড়তা আর উপভোগ হলো বাধা জয় করার আনন্দ। পরিশেষে মনে করছি যে, তার সম্পর্কে যত লিখা হতো তত কম েলখা হবে। এই মহীয়সী অন্ধ-বধির ও মূক প্রতিবন্ধী নারী ১৯৬৮ সালে পরপারে পাড়ি দেন। তিনি খবমবহফ হয়ে বেঁচে ছিলেন, বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের ভাঁজে ভাঁজে, অন্তরের পরতে পরতে ভালোবাসার ছোঁয়ায় আর অসীম প্রেরণায়। (সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct