দারিদ্রতা ও স্বাস্থ্য যে নিবিড়ভাবে যুক্ত সে বিষয়ে সমাজ বিজ্ঞানী, আর্থিনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কোনো সন্দেহ নেয়। উন্নত স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামো প্রদানের জন্যে সময়ের সাথে সাথে অনেক প্রকল্প রূপায়ণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা বেশ প্রশংসিত। কিন্তু এই উন্নত স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার মধ্যেই চোরাবালির মতো বিরাট একটা ভাঙ্গন প্রস্ফুটিত, সেটি হল সিজারিয়ান প্রসব বা সি সেকশন। এই প্রসব মাধ্যমে মুনাফা-লোভী সম্পর্কে সজাগ করেছেন মোঃ সাহিদুল ইসলাম। আজ শেষ কিস্তি।
সিজারিয়ান প্রসবের ফলে আর্থিকভাবে অনেক পরিবার পিছিয়ে পড়ে এবং অনেক সময় দারিদ্রতার জালে ফেঁসে যায় । স্বাস্থ্য-পরিষেবা বাজার ব্যবস্থায় আজকাল বিভিন্ন প্রকার ‘দরকষাকষি’ মূল্য দেখা যায়। উদাহরণ স্বরূপ, বহরমপুর (মুর্শিদাবাদ জেলার সদর দপ্তর) শহরে, বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিং হোম গুলিতে প্রসব-মূল্য প্রায় ১৫ হাজার থেকে শুরু করে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ধার্য্য করা হয়। এই সূত্রে, শহরের অনেক নার্সিং হোমে আগত পরিবাবের সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে যেটা বোঝা যাই , অধিকাংশ পরিবারগুলি খুব সাধারণ দরিদ্র পরিবার এবং তাঁদের ‘প্রসব-খরচ’ অর্থ যোগানের উৎস হিসেবে যেটা সামনে আসে সেটা হলো- সুদে নেওয়া, কিছু গহনা বিক্রি করা, ঋণ করা ও অনেক সময় অল্প সংখ্যক সঞ্চিত অর্থ। এরফলে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো বেশি ঝুঁকি পূর্ণ হয়ে পড়ে। সুতরাং, শারীরিক ভাবে একজন মা এর যেমন কষ্টের অন্ত থাকেনা, সেরকম আর্থিক দিক থেকে দরিদ্র হয়ে যাই। এই প্রসঙ্গে অনেক পরিবার ও এরকম মন্তব্য করে থাকেন যে COVID-১৯ এর পর থেকে অনেক আর্থিক ভাবে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি, প্রসব-খরচা যেন ‘গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া’। এই স্বল্পবিস্তর আলোচনার পরিপেক্ষিতে, আমাদের মনে একটা প্রশ্ন থেকেই যাই যে, কেন সিজারিয়ান প্রসব দিন দিন বাড়ছে? শুধু কি মুনাফা লোভী বেসরকরীকরণ দায়ী ? বিভিন্ন গবেষণা পত্র দেখিয়েছে যে, মানুষের জীবনোন্নয়ন আর্থিক ও সামাজিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাহলে স্বাস্থ্যের দিক থেকে মানুষ মূলত একজন ‘মা ‘ কেন শিকার হচ্ছে ? প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের (Institutional Delivery) নামে কি এই প্রহসন ও মহিলা-স্বাস্থ্য বাণিজ্যকরণ? প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের যদি মূল উদ্দেশ্য হয় শিশু এবং মায়ের স্বাস্থ্য ও প্রাণ রক্ষা (IMR ও MMR), তাহলে সিজারিয়ান প্রসব কি উদ্দেশ্য প্রনোদিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া?
অতএব, সিজারিয়ান প্রসব যতটা সম্ভব খুব শীঘ্রই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা খুব প্রয়োজন কেননা মহিলা-স্বাস্থ্য-বাণিজ্যকরণ ও পরিবার আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়তে, এটা একটা গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ ও সরকার দুজনের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে হবে। সাধারণ মানুষ হিসেবে, আমরা আধুনিকরণ জীবন-বাসনার নামে আমাদের জীবন শৈলী পরিবর্তন করে ভিন্ন ধরণের খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি এবং বিধি সম্মত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে রুচি হারিয়ে ফেলছি। অন্যদিকে, জনকল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে, সরকার বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রদান করেছে কিন্তু সেগুলি যথেষ্ট নয়। সরকারে বিশেষ ভাবে ক্রমবর্ধমান সিজারিয়ান প্রসব কে নিয়ন্ত্রণ করতে বিশেষ পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। এই প্রসঙ্গে, সেইসব বেসরকারি হাপাতালের জন্যে কড়া নজরদারি ও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত যেখানে নিয়ম বহিরভিত কার্যকলাপ চলছে। স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো ও সাধারণ মানুষের সাথে সরকারি ব্যবস্থা ও সুবিধার সঙ্গে সমন্বয় সাধনের জন্যে বেসরকারি প্রাতিষ্ঠান (Civil Society) গুলোকে সঙ্গে নেওয়া উচিত। যেসব কারণে, সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালের প্রতি বিমুখ, তার দিকে একান্ত নজর দেওয়া উচি , যেমন সরকারি হাসপাতালের গুণগতমান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন কেননা সরকারি হাসপাতাল গুলি যেমন একদিকে খুব কম, তেমনি উপযুক্ত পরিকাঠামো ও মানব সম্পদ নেয়। উদাহরণ যেমন, বেলডাঙা গ্রামীণ দুটো হাসপাতাল আছে, সেখানে পরিকাঠামো ও ডাক্তার ও সেবিকা যথেষ্ট পরিমাণ নেয়। সুতরাং, রাজ্যব্যাপী, গ্রামীণ হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দিকে নজর দেওয়া উচিত কেননা এগুলোই গ্রামীণ মানুষের নিকটতম দুয়ার। (সমাপ্ত...)
লেখক গবেষক, ইনস্টিটিউট অফ রুরাল ম্যানেজমেন্ট আনন্দ, গুজরাত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct