এবারে বালুরঘাটে শান্তিনিকেতন
সনাতন পাল
আমাদের প্রাণের শহর বালুরঘাট। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠে উল্লিখিত সেই ‘আত্রাই’অর্থাৎ আমাদের প্রিয় আত্রেয়ী। আর শান্তিনিকেতনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কোপাই নদী।যার বর্ণনায় রবি ঠাকুর লিখে গেছেন-” আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে.....”। দুই জায়গার নদীতেই রবীন্দ্রনাথের স্পর্শ,এ এক অদ্ভুত মিল। বালুরঘাট শহরের সংকেত ক্লাব দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত। পুজো থেকে আরম্ভ করে সব ভাবনা গুলোই কেমন যেন আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। শহরবাসীকে আলাদা একটা দৃষ্টি কোণ থেকে দেখতে বাধ্য করে। এবারে পৌষের শীতে সেই সংকেত ক্লাবের আয়োজনে শান্তিনিকেতনের সোনাঝুড়ির হাটের আদলে বসেছে পৌষ মেলা। এই মেলাতে যেমন মেয়েরা পিঠে-পুলির স্টল নিয়ে বসেছেন, বসেছে জয়নগরের মোয়া, বাংলাদেশের শের পুরের দই, মুর্শিদাবাদ ও বাংলাদেশের নলেন গুড়ের দোকান, জামাকাপড় থেকে আরম্ভ করে মোবাইলের দোকান,রয়েছে লিটিল ম্যাগাজিনের স্টল। বিভিন্ন রকম চিত্র থেকে আরম্ভ করে মুখা কি নেই! অনেক কিছুই রয়েছে এই মেলায়। মাঘের আগে ভরা পৌষের বিকেল হতেই জমছে ভিড়। শহরবাসী উপভোগ করছেন,লোকসংস্কৃতি বাউলের সেই এক তারার সুর আর বাউল গানের সেই সুর যেন কুয়াশা ভেদ করে হৃদয়কে স্পর্শ করছে,যার ভাবকে ধরা যায় না,ছোঁয়া যায়না শুধুই হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায় গানের সার মর্মকে। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই রবি বাউলের কথা। সবে-তেই যেন রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া। এ যেন বালুরঘাট শহরে রবীন্দ্র সংস্কৃতির আদলে সংস্কৃতির মুকুটে নতুন পালক। যার টানে শহরবাসী গভীর ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে প্রতিদিন হাজির হচ্ছেন সংস্কৃতির স্বাদ গ্রহণ করতে এবং মেলাকে উপভোগ করতে ।আর রবি ঠাকুরের ভাবনার স্পর্শ পেতে। শান্তিনিকেতন নামটার মধ্যেই কেমন যেন একটা সংস্কৃতির মাধুর্য লুকিয়ে আছে। সেই মাধুর্যকে ঘন কুয়াশা আর হাড় কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যেও বালুরঘাট-বাসী খুঁজতে সেখানে হাজির হচ্ছেন।
উদ্যোগতাদের মধ্যে বালুরঘাটের বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী তথা সঞ্চালক আমার স্নেহের ভাই সঞ্জয় কর্মকার এমন আপন ভাবে আদর করে আমাকে একদিন টেলিফোনে বলল-” দাদা, তুমি আমাদের এই মেলাতে একদিন অবশ্যই এসো,তোমার আমন্ত্রণ রইল।” সঞ্জয়ের এমন মধুর কন্ঠ আর বাচনভঙ্গী ঈশ্বর ওকে দিয়েছেন,যে কারো ভীষণ রাগ হলেও ওর কথায় সব রাগ যেন নিমেষেই জল হয়ে যায়। মনে মনে ভাবলাম এমন আত্মীয়তার আদলে আমাকে যেতে বলল,না গেলে ভীষণ খারাপ হবে। ও বলেছিল-” তুমি আসার আগে আমাকে অবশ্যই জানিয়ে এসো”। তখনই মনে পড়ে গেল সেই ছেলেবেলার কথা। সে বার আমি শান্তিনিকেতনে গিয়ে না বুঝেই খানিকটা রবি ঠাকুরের আকর্ষণে মাটির ঘরে রাখা ইজি চেয়ারে বসে পড়েছিলাম। যে চেয়ারে একটা সময় রবি ঠাকুর বসতেন। বসার সঙ্গে সঙ্গেই দুজন পুলিশ এসে আমাকে চেপে ধরল। বললেন,” তুমি জানো এ চেয়ারে কে বসতেন!” বললাম-” জানি,এই চেয়ারে রবি ঠাকুর বসতেন।” পুলিশ কাকুরা বললেন,” জেনেও বসেছো! তোমাকে জেলে,দেবো।” আমি বললাম, বেশ তো,তাই না হয় দাও , রবি ঠাকুরের একটু ছোঁয়া পাওয়ার অপরাধে জেলে যেতে আমার কোনো কষ্ট নেই। আর আমার জন্য কাঁদারও কেউ নেই গো, চলো চলো, তোমরা আমাকে জেলেই দাও।” পুলিশের বিরুদ্ধে মানুষ কত কথা বলেন,কখনও রাগ হলে আমিও বলি। সেই দিনের ঐ দুজন পুলিশকে আমার আজও মনে আছে,তাঁরা কিন্তু সেদিন আমাকে জেলে দেন নি। বলেছিলেন,” তুমি রবি ঠাকুরকে এতো ভালোবাসো!” তখন আমার মুখে কথা নেই,শুধু চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে। তখন পুলিশ কাকুরাই আবার আমার সেই জল মুছে দিলেন। তারপরে আমার আর কখনও শান্তিনিকেতনে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। তাই গতকালকে সংকেত ক্লাব শান্তিনিকেতনের আদলে যে পৌষ মেলার আয়োজন করেছে,সেখানে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি সঞ্জয় নেই। ওকে ফোন করলাম, অন্য একটা জায়গায় ব্যস্ত ছিল। আমি এসেছি শুনে ঐ গভীর ঠান্ডার মধ্যে ভাই আমার ছুটে এসে,বলছে-” দাদা,আমি এসেছি”। আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল,সঞ্জয় হয়তো বুঝতেও পারেনি। মনে মনে ভাবলাম আমি হলেও বোধহয় এই গভীর ঠান্ডার মধ্যে সঞ্জয়ের জন্য ছুটে আসতে পারতাম না। হার মেনে গেলাম। আর ভাবলাম এমন ছেলেরা সংকেত ক্লাবের সাথে যুক্ত আছে বলেই হয়তো তাঁদের চেতনা থেকে এমন ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে।
সঞ্জয় মাটির ভাঁড়ে চা খাওয়াচ্ছে,এমন সময় চোখে পড়ল জয়জিৎ মাস্টারমশাই এবং তাঁর স্ত্রী।তাঁদের সাথে কথা হলো। তাঁরাও খাওয়ার কথা বললেন। বাড়ীতে যাওয়ার কথাও বললেন। অনেক বন্ধুর সাথেও সেখানে দেখা হলো।এক বন্ধুর সাথে বহুদিন পরে দেখা । দেখেই হাতটা চেপে ধরে বলল,” একদিন বাড়ীতে আয়,তোর নেমতন্ন থাকল”। খানিকক্ষণ পরেই দেখা হলো- শিক্ষক রবীন সাহা এবং শিক্ষিকা তৃপ্তি সাহা। দুজনকে কাকু- কাকিমা বলে বহুদিন থেকেই ডাকি। বেকার অবস্থায় উনাদের বড় মেয়েকে আমি বাড়িতে গিয়ে পড়াতাম। মনে মনে খুব ভয় করতাম- দুজনেই শিক্ষক তাঁদের মেয়েকে পড়ানো,যদি কিছু ভুল করে ফেলি! কিন্তু সমস্যা কিছুই হয়নি। তাঁরা সবাই ভীষণ ভালো মনের মানুষ। এই মেলাতে গিয়ে অনেক বছর পরে তাঁদের সাথে দেখা হলো। অনেক গল্প হলো, ভীষণ যত্ন করে বাড়ীতে যাওয়ার কথা বললেন। বললাম,” নিশ্চয়ই যাবো”। মনে মনে ভাবলাম যেখানকার মানুষের মন এতোটা ভালোবাসা এবং মমতায় ভরা,সেই শহরের কোনো এক প্রাঙ্গণকে শান্তিনিকেতন করে তোলার ভাবনা সত্যিই সার্থক। সংকেত ক্লাবের এই নব ভাবনা আমার মনকে যেমন ছুঁয়ে গেল। আমার বিশ্বাস যাঁরা এই মেলাতে একবার গেছেন,তাঁদের সবার মনকেই ছুঁয়ে গেছে। এই জন্য ক্লাবের প্রতিটা সসস্যকে ব্যক্তিগত ভাবে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। পাশাপাশি তাঁদের কাছে অনুরোধ করবো,এটা যেন প্রতি বছরই হয়।প্রশাসনের কাছেও অনুরোধ,ওঁদের আপনারাও সাহায্য সহযোগিতাতার হাত বাড়িয়ে দেবেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct