২০২২ সাল শেষেও বিশ্বের যে ক’টি অঞ্চলে অস্থির পরিস্থিতি বজায় থাকার ইঙ্গিত রয়েছে তার মধ্যে একটি হল মধ্যপ্রাচ্য। এই অঞ্চলে বিশ শতকের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে যে ভারসাম্য ছিল তা ভেঙে পড়ে নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকে। দ্বিতীয় দশকে সম্পর্কের নতুন সমীকরণ তৈরি হতে থাকে। তৃতীয় দশকের প্রথম দুই বছর ছিল নতুন এক মধ্যপ্রাচ্যের ভিত্তি তৈরির সময়। ২০২৩ সাল এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নতুন এক সময়কালের সূচনার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বছর হতে পারে। এ নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ শেষ কিস্তি।
আঙ্কারা এবং বাকু, উভয়ই আজারবাইজানীয় রাজধানী থেকে তুর্কিয়ে শহর কার্স পর্যন্ত একটি পরিবহন রুট স্থাপন এবং প্রসারিত করতে চায়। এই রুটটি জাঙ্গেজুর করিডোরের ওপর দিয়ে যায়। এর প্রবক্তারা বলেন যে, এই ধরনের একটি প্রকল্প দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের জন্য অনেক অর্থনৈতিক সুযোগ ও দীর্ঘমেয়াদি শান্তি উন্মুক্ত করবে। আর এটি প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে সবচেয়ে ছোট স্থল পরিবহন রুট হিসেবে কাজ করবে, সেই সাথে এশিয়ার মধ্যে ইউরোপের সাথে একটি নতুন সংযোগ সৃষ্টি করবে। তুরস্কের জন্য, এটি অবশ্যই হবে একটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা। আঙ্কারা এর মাধ্যমে কাস্পিয়ান সাগরের প্রবেশদ্বার হিসেবে এবং মধ্য এশিয়ার রাজ্যগুলোর সাথে সংযোগের একটি সংক্ষিপ্ত রুট পাবে। তারা ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের মধ্যে ইউরোপে প্রবেশের জন্য একটি অতিরিক্ত রুট খুঁজছে। এটি দৃশ্যত এত গুরুত্বপূর্ণ যে, আঙ্কারা ইয়েরেভানের সাথে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য এটিকে একটি মূল শর্ত বানিয়েছে। এ দিকে তেহরান ব্যাপকভাবে এর বিরোধিতা করে চলেছে; কারণ এটি সরাসরি তুরস্ককে মূল ভূখণ্ড আজারবাইজানের সাথে সংযুক্ত করবে, আজারবাইজানিদের আর নাখিচিভানে যাতায়াতের জন্য ইরানের মধ্য দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না এবং ইরান-আর্মেনিয়ান সীমান্তটি একধরনের অবরুদ্ধতার মধ্যে পড়ার আশঙ্কা থাকবে। ইরানের জন্য এটি নেতিবাচক হলেও তুরস্কের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অগ্রগতি হবে এবং এর প্রভাবকে বাড়িয়ে তুলবে দক্ষিণ ককেশাসে। সিরিয়ায় তুর্কিয়ে-সমর্থিত বাহিনী এবং ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য ও সঙ্ঘাতের সাথে এটি দু’দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আরো গভীর করতে পারে। যদিও এর অর্থ আঙ্কারা এবং তেহরানের মধ্যে সামরিক সঙ্ঘাত নয়, তবে এর অর্থ হতে পারে, দুই আঞ্চলিক শক্তির নেতৃত্বে প্রভাব বিস্তারে বৃহত্তর অক্ষের গঠন। জিসিসি পরিবারের পুনর্মিলন সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ যারা কাতারকে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২১ সালের প্রথম পর্যন্ত অবরোধ করেছিল, তারা ২০২২ জুড়ে দোহার সাথে তাদের সম্পর্ক উন্নত করেছে। জিসিসি পরিবারের দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের এই সামগ্রিক উষ্ণতা ২০২৩ সালেও অব্যাহত থাকতে পারে। রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্র এবং মানুষ থেকে মানুষ স্তরে এই সম্পর্ক বাড়তে পারে। কাতারে শেষ হওয়া বিশ্বকাপটি একটি উদ্দীপক হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্বকাপ চলাকালে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান- এমবিএস এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ-এমবিজেড যেভাবে দোহায় কাতারের আমিরের সাথে দেখা করেছিলেন তা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২১ সালের শুরুর দিকে কাতারের অবরোধের সময় দোহায় এই তিন নেতার মধ্যে এ ধরনের আনন্দদায়ক বৈঠক অকল্পনীয় ছিল। নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে, ইয়েমেনে ‘কোনো যুদ্ধও নেই, শান্তিও নেই’ এর বিবর্তন জিসিসি সদস্যদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। ২০২৩ ইয়েমেনিদের জন্য একটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং বছর ছাড়া অন্য কিছু হবে বলে আশা করার কারণ নেই। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বিশ্বাস করেন যে, শান্তির দিকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিছু বিশ্লেষক উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, ইয়েমেনে স্থায়ী শান্তি আনার একমাত্র বাস্তবসম্মত উপায় উত্তর-দক্ষিণ লাইনে দেশকে বিভক্ত করা এবং ১৯৯০ সালের পুনঃএকত্রীকরণের আশা ছেড়ে দেয়া যদিও বিভাজন অগণিত চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে এবং এর সমস্যাযুক্ত নানা দিক রয়েছে। নতুন বছরেও ইয়েমেনে হুথিরা সম্ভবত প্রভাবশালী থাকবে। এ সময় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার তার ঐক্য বাড়াতে ব্যর্থ হবে এবং তাই একটি শক্তিশালী হুথি বিরোধী ফ্রন্ট গড়ে তুলতে হবে। এই সময়ে সৌদি আরব এবং আমিরাত কিভাবে ইয়েমেনে তাদের বিরোধপূর্ণ স্বার্থের মোকাবেলা করে তা দেখা গুরুত্বপূর্ণ হবে। বিশেষ করে যদি ২০২৩ সালে রিয়াদ এবং আবুধাবির পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে আরো লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তখন পরিস্থিতি জটিল হবে। এখন পর্যন্ত, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত বেশির ভাগ ইয়েমেনে তাদের মতবিরোধ নিষ্পত্তি করতে সফল হয়েছে। তবুও, এটি সম্ভবত আগামী বছর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরোধের একটি উৎস থেকে যাবে। (সমাপ্ত...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct