কোথায় মা
তাপস কুমার বর
রাস্তার মধ্যিখানে একটা নীরব শ্রোতা দাঁড়িয়ে কাঁদছে। সামনে একটা বটগাছ। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে গাছপালা একফোঁটা জলের জন্য ধুঁকছে। একটা ভিখারী বুড়িমা, পরনে ছেঁড়া বস্ত্র,মাথার চুল উস্কো-খুস্কো। হাঁপাতে হাঁপাতে বীরুদাদুর চায়ের দোকানের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। চায়ের দোকানে বসে থাকা নিরু, স্বপন দাদা, পরমেশ্বর কাকা ও আব্দুল চাচা সকলে ভিখারী মায়ের দিকে তাকিয়ে এক সুরে বললো,.... “কিছু বলবেন,কাউকে খুঁজছেন?”- ভিখারী মা, বললো না না কাউকে খুঁজছিনা। আমাকে কিছু খাবার কিনে দেবেন বাছা সব, আজ সারাদিন কোথাও কিছু খাবার জোটেনি, জল খেয়ে আর কতদিন চালবে! আব্দুল চাচা বীরুদাদুকে বললো, বীরু উনাকে একটা চা, বিস্কুট ও একটা রুটি দাও তো,আমি পয়সা দিয়ে দিচ্ছি। নিরু,স্বপন দাদা ও পরমেশ্বর কাকা বললো, আব্দুল চাচা খুব দয়ালু মানুষ,কষ্ট দেখলে মায়ায় পড়ে যায়। নিরু বললো, এই জন্য তো আব্দুল চাচার একটা “বৃদ্ধাশ্রম” আছে। উনি ওখানে কত বৃদ্ধ মা বাবাকে স্থান দিয়েছেন তাঁর বৃদ্ধাশ্রমে,....“তুমি আমাদের পাড়ার গর্ব আব্দুল চাচা। কত হারিয়ে যাওয়া মানুষ,তোমার স্পর্শে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে”!
- বৃদ্ধা মায়ের দিকে তাকিয়ে, আব্দুল চাচা বললো, কোথা থেকে আসছেন মা। বৃদ্ধা বুড়িমা, চোখের অশ্রু ফেলতে ফেলতে বললো, বাবা তোমরা কত ভালো। আমার কাছে সব থেকেও আমি আজ পথের ভিখারী বাবা! সকলে বৃদ্ধা মায়ের কথা শুনে খুব মায়া হলো। সকলে তাঁর জীবনের ঘটনা শুনতে চায়। বৃদ্ধা মা বললো, আমার জীবনের ঘটনা খুব দুঃখের। তাই কাউকে বলিনা। কেউ শুনে হাসে, কেউ বা উপহাস করে। পরবেশ্বর কাকা বললো না বুড়িমা আপনি বলুন,আপনার কষ্ট আমরা ও ভাগ করে নিতে চাই। বৃদ্ধা বুড়িমা বলা শুরু করলো জীবনের ঘটনা। বুড়িমার বাড়ি মহেশপুর গ্রামে। বুড়িমার নাম বিমলা দেবী। বিমলা দেবীর বিয়ে হয়েছিল এক কৃষক পরিবারে। তারা মধ্যবৃত্ত পরিবার। তাদের সম্পতি ভালোই ছিল। কিন্তু হঠাৎ কয়েক মাস যেতে না যেতেই বিমলা দেবীর স্বামী পরেশ বাবু ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এদিকে তাদের এক ছেলে অমল ও এক মেয়ে শ্রুতি তারা খুব ছোট্ট ছোট্ট। পরেশ বাবু এতোটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে পরিবারের জায়গা বিক্রি করে ও বিমলা দেবী স্বামীকে শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারলেন না,.....“জীবনের গতি স্তব্ধ। হারিয়ে গেছে আনন্দ! থমকে যেতে যেতে একদিন সব হবে স্তব্ধ!”- স্বামীর কাজ সেরে উঠতে গিয়ে বিমলা দেবী বেশ দেনাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। এদিকে ছোট্ট দুটো ছেলের পড়াশোনার খরচ, সংসার খরচ চালাতে না পেরে, অন্যের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করা শুরু করলো। ওখান থেকে টাকা নিয়ে দেনাশোধ করলেন বিমলা দেবী। এই ভাবে অনেক পরিশ্রম করে ছেলে-মেয়ে দু’জনকেই মানুষের মতো মানুষ করে তুললো। ছেলে অমল ও মেয়ে শ্রুতি দুজনে পড়াশোনা করে আজ তারা সরকারি চাকুরীজীবি। ছেলে অমল সরকারী অফিসার ও মেয়ে প্রাইমারি শিক্ষিকা। আজ যে মায়ের জন্য তারা জীবনে সফল। আজ সেই মায়ের জীবন একটা যাযাবরের মতো,.....
“ধুঁকে ধুঁকে রাস্তায় চলি। বুকের বামপাশে ভীষণ ব্যথা। মৃত্যু যদি এসে যেতো,হয়তো শান্তি পেয়ে যেতাম। ”- এই কথা শুনে সকলে নীরব সকলে বললো তারপর কি হলো বুড়িমা। বুড়িমা বললো, ছেলে-মেয়েদের কাছে অনেক বার গেছি,ওরা রাখতে চায়’না। বৃদ্ধা মা’কে ওদের কাছে রাখলে, ওদের সম্মানে “চাঁদকলঙ্কের মতো দাগ লেগে যাবে”। বাড়িতে ছেলে বৌ’মা ঠিক মতো খেতে দেয়’না। বার বার অপমান করে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা এখনো “বিনোদনে মজে গেছে, নিজের মা’কে সঙ্গে নিয়ে যেতে ও তাদের লজ্জা লাগে। ” মেয়ে শ্রুতির বাড়িতে কয়েকমাস আগে গিয়ে ছিলাম। কিন্তু মেয়ে বললো,.....“মা এই নাও দুই’শো টাকা। তুমি অন্য কোথাও চলে যাও। আমাদের তো এই অবস্থা দেখতেই পাচ্ছো। তার উপর একজন জুটলে আমাদের সংসারটা চলবে কি করে?” সেদিন ও বিমলা দেবী অবাক হয়েছে। মনে পড়ে যায়,সেই ছোট্টবেলার “সেই শ্রুতি কি আজকের সেই শ্রুতি? আজ তারা স্বার্থপরের মতো নিজেদের ভাবে। নিজের মাকেও ভুলে গেছে,......“আমি স্বপ্ন দিয়ে গড়েছি তিলে তিলে স্বপ্ন। আজ সেই স্বপ্ন আমাকে স্বার্থের আগুনে ভুলে গেছে”!- সেদিন বীরুদাদুর চায়ের দোকানে সকলে নীরব। যে মা তার সন্তানের জন্য নিজের জীবন ও শেষ করে দেয়। সেই সন্তান-সন্ততিরা কেন এই মায়ের জন্য,...”খোলা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়”! আজ এই বিমলা দেবীর মতো আরো কত বিমলা, আজও অত্যাচারিত। এইভাবে কেন তাদের ছুঁড়ে ফেলা হয়? এই প্রশ্ন বীরুদাদুর চায়ের দোকানে নিরু, পরমেশ্বর কাকা,স্বপন দাদা ও আব্দুল চাচার মনে বার বার প্রশ্নগুলো দাগ কেটে গেছে। আজও এই প্রশ্ন নীরবতার গুপ্তগুহায় কখনো কখনো স্বার্থপর হয়ে ওঠে। আব্দুল চাচার,চোখের কোনে বিমলা দেবীর এই কথা শুনে চোখে জল এসে গিয়েছিল। চাচা বললো,....“এই সমাজকে শিক্ষা দিতে গেলে নিজেকে নীরব থাকলে হবে না। প্রতিবাদ করতে হবে, এই রকম অত্যাচারীর স্বার্থের বিরুদ্ধে”!- মা তো একটা পবিত্র শব্দ। যে কখনো নিজেকে ভাবে’না। অন্য সন্তানের জন্য ও বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একদিন এই অমল ও শ্রুতি তারা ভুল বুঝতে পারবে। যেদিন ওরা ও একদিন মা, বাবা হবে। মা বাবার যন্ত্রণা,ব্যথা,অনুভব করতে জানবে। সেদিন ওদের চোখের সামনের কালো পর্দাটা সরে যাবে। আব্দুল চাচা, বৃদ্ধা ভিখারী বিমলা দেবীকে আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে দেবে না। তিনি তার “বৃদ্ধাশ্রমে” বিমলা দেবীকে নিয়ে যান। সেখানে অনেক বৃদ্ধা মা-বাবা আনন্দে খেলছে, আবার কেউ নীরবতায় বসে আছে একাভাবে। সকলে বিমলা দেবীকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে বলছে,....“এ সমাজ কি এখনো মা’কে বুঝে উঠতে পারেনি? কেন তাদের জন্য শেষ বয়সে আসতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে”! চোখের কোনে অশ্রু ফোঁটাগুলো বিন্দু বিন্দু হয়ে ঝরে পড়ছে,....“যেদিন তোমাদের ঘুম ভাঙবে, সেদিন জানবে! পৃথিবীতে তোমার সবচেয়ে কাছের আপন “তোমার মা-ই ছিল সবচেয়ে কাছে!”
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct