সত্যিকার অর্থে, আজকের পৃথিবী আগের চেয়ে অনেক বেশি কানেকটেড তথা পরস্পর সম্পৃক্ত-সংযুক্ত। ইতিহাসকে যদি বলা হয় ‘পথপ্রদর্শক’, তবে বিশ্বায়ন তথা কানেকটিভিটিকে বলতে হবে ‘সময়ের সংযোগ’, যা পিছিয়ে যায় না বা যাবে না কোনোক্রমেই। এটা সত্য যে, বিশ্বযুদ্ধ বা মহামারির মতো বড় ধাক্কা ঘড়ির কাঁটা ধীর করে দিতে পারে, কিছু সময়ের জন্য স্থবিরতার জন্ম দিতে পারে, কিন্তু বিশ্বায়নের চাকা থামিয়ে দিতে পারে না এতটুকু। বাস্তবতা এটাই। এ নিয়ে লিখেছেন আফশিন মোলাভি। আজ শেষ কিস্তি।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যমতে, বিগত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী অভিবাসনের হার বেড়েছে। আমরা ক্রমাগত অভিবাসন বৃদ্ধির সাক্ষী হচ্ছি বছরের পর বছর ধরে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অভিবাসী প্রায় ২৮১ মিলিয়ন, যা নিঃসন্দেহে বড় চিন্তার বিষয়। যদিও এই সংখ্যা বিশ্বের জনসংখ্যার অনুপাতে এখনো ততটা অসহনীয় নয়। তবে আসল সত্য হলো, অভিবাসনের প্রশ্নে উন্নয়নশীল বিশ্বের ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতার অন্য একটি বিশেষ দিক আছে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের গবেষণা অনুসারে, বিশ্বব্যাপী পুঁজি প্রবাহের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বেশ স্থিতিস্থাপক ও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। পাবলিক স্টক মার্কেট থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ঋণ ইস্যু, বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ—সবকিছুতেই এর অবাদনকে উপেক্ষা করা যায় না। এখন আঙুলের এক চাপেই আমরা চিলির তামার খনি থেকে শুরু করে চীনা বৈদ্যুতিক-যান প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সবকিছু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারি। এতে করে জনশক্তির হাত ধরে গতি পায় পুঁজির প্রবাহ। মূলত এভাবেই বিশ্ব স্টক মার্কেটের বাজার মূলধন আজ ১০০ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
‘বিশ্বায়নের মৃত্যু ঘটছে’—এই ধারণার অবতারণা ঘটেছে প্রধানত পশ্চিমা বিশ্লেষক ও শিল্পনেতাদের মাধ্যমে। বলতেই হয়, চারপাশে ভালোভাবে লক্ষ করা উচিত এই গোষ্ঠীর। এটা সবার জানা, মার্কিন স্টক মার্কেট বিশ্বের বৃহত্ ও সক্রিয় স্টক মার্কেটগুলোর মধ্যে অগ্রগণ্য। এর লাভের আসল খাত হলো বিদেশি বিনিয়োগকারী, যা প্রায় ১৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ইক্যুইটির হোল্ডিং। এই বিদেশি হোল্ডিংগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমুদয় স্টক মার্কেট মূলধনের প্রায় ৩০ শতাংশের জোগানদাতা। উপরন্তু, মার্কিন কর্মসংস্থান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। এটা সম্ভব হয়েছে বিশ্বায়নের কারণে। যদি ধরা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৫ মিলিয়ন চাকরি হয়েছে বিশ্বায়নের সুযোগে, একে ভুল বলা যাবে না কোনোভাবেই। কাজেই ‘বিশ্বায়ন মারা যাচ্ছে’—এমন কথা ভাবা সম্পূর্ণ অমূলক। প্রকৃতপক্ষে জ্বালানি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, খাদ্য ইত্যাদির প্রশ্নে বিশ্বের দেশগুলো এখন পরস্পরের প্রতি অনেক বেশি নির্ভরশীল। আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ—সবার ক্ষেত্রেই এ কথা সমভাবে প্রযোজ্য। দেশে দেশে সরকার ও জনগণও বিশ্বব্যাপী বিশেষভাবে সংযুক্ত। এই সংযুক্তি বিশ্বায়নকে শক্তি জোগায়। বিশ্বায়নের সংযোগস্থলে বসে পণ্য, মানুষ, পুঁজি ও পরিষেবার প্রবাহ ঘটাচ্ছে বিশ্ব। বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী আন্তঃসংযোগ গড়ে তোলার মাধ্যমে বিশ্বায়ন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। বহু দেশ ও জাতি নানা উপায়ে সাম্রাজ্যকে যুক্ত করছে বিশ্বের সঙ্গে, যা অকল্পনীয় ছিল কয়েক বছর আগেও। আন্তঃসংযোগের এমন এক ধারাবাহিক সংস্কার লক্ষ করার পর ‘বিশ্বায়ন মারা যাচ্ছে’ এমন ধারণা করা নিতান্তই ভুল। বিভিন্ন দেশ বিশ্বায়নের সুযোগ কাজে লাগিয়ে যেভাবে ভূ-অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাচ্ছে, তাতে আগামীর বিশ্বে বিশ্বায়নের অব্যাহত যাত্রার বিষয়টিই কেবল স্পষ্ট হয়। যে দেশগুলো কানেক্টিভিটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করছে, তারা সফল হচ্ছে; আর যারা পারছে না, তারা পিছিয়ে পড়ছে। অর্থাত্, সব পরিস্থিতিতেই বিশ্বায়ন দাঁড়িয়ে আছে নিজের জায়গাতেই। করোনা মহামারি আমাদের দেখিয়েছে, বিভিন্ন কারণে বিশ্বব্যবস্থায় নাটকীয় ধাক্কা লাগলেও বিশ্বায়নের অব্যাহত প্রবাহকে থামনো যায় না। আধুনিক বিশ্বে গ্লোবালাইজেশন এমন এক পোক্ত জায়গায় অধিষ্ঠিত যে, কোনো কিছুতেই এর অগ্রযাত্রা থামানো যাবে না। বিশ্বায়ন সত্যিকার অর্থেই একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া।
(সমাপ্ত...)
লেখক জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ফরেন পলিসি ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct