সত্যিকার অর্থে, আজকের পৃথিবী আগের চেয়ে অনেক বেশি কানেকটেড তথা পরস্পর সম্পৃক্ত-সংযুক্ত। ইতিহাসকে যদি বলা হয় ‘পথপ্রদর্শক’, তবে বিশ্বায়ন তথা কানেকটিভিটিকে বলতে হবে ‘সময়ের সংযোগ’, যা পিছিয়ে যায় না বা যাবে না কোনোক্রমেই। এটা সত্য যে, বিশ্বযুদ্ধ বা মহামারির মতো বড় ধাক্কা ঘড়ির কাঁটা ধীর করে দিতে পারে, কিছু সময়ের জন্য স্থবিরতার জন্ম দিতে পারে, কিন্তু বিশ্বায়নের চাকা থামিয়ে দিতে পারে না এতটুকু। বাস্তবতা এটাই। এ নিয়ে লিখেছেন আফশিন মোলাভি। আজ প্রথম কিস্তি।
একাবিংশ শতাব্দীর গ্লোবালাইজেশন তথা বিশ্বায়নের যুগে বাস করছি আমরা। বর্তমান বিশ্বে সংঘটিত নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে যুক্তি দাঁড় করিয়ে বলছেন, ‘বিশ্বায়নের মৃত্যু ঘটেছে’! এই দাবি বিশ্বব্যাপী মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি হতে দেখছি আমরা। করোনার ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই ইউক্রেনের মাটিতে বোমা ছুড়ে যুদ্ধের অবতারণা ঘটান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এর মধ্যেই বেড়েছে মার্কিন-চীন উত্তেজনা। এসব পর্যবেক্ষণে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ‘বিশ্বায়নের মৃত্যু ঘটেছে বা ঘটছে।’ এসব বিশ্লেষক দাবি করছেন, পৃথিবীর চালিকাশক্তি তথা পণ্যসামগ্রী, মানুষ, পুঁজি-মূলধন ও তথ্যপ্রবাহের ঝিমিয়ে পড়া ভাবের কারণেই মূলত বিশ্বায়নের এই অচল অবস্থা। খুব শিগিগর বিশ্বায়ন ‘অতীত ইতিহাস’ হয়ে পড়লেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না বলে বলছেন এসব বিশেষজ্ঞ। তাদের মতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর সংশ্লিষ্ট ভূরাজনৈতিক ভাঙন বিশ্বায়নকে এতটাই জোরে ধাক্কা দিয়েছে যে, বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার অবকাশ থেকেই যাচ্ছে! তবে যে যাই বলুক না কেন, বাস্তবতা হলো, বিশ্বায়নের মৃত্যু বা পতন ঘটেনি। গ্লোবালাইজেশন বস্তুত এমন এক ধারণা, যার যবনিকাপাত ঘটে না বা ঘটবে না। সত্যিকার অর্থে, আজকের পৃথিবী আগের চেয়ে অনেক বেশি কানেকটেড তথা পরস্পর সম্পৃক্ত-সংযুক্ত। ইতিহাসকে যদি বলা হয় ‘পথপ্রদর্শক’, তবে বিশ্বায়ন তথা কানেকটিভিটিকে বলতে হবে ‘সময়ের সংযোগ’, যা পিছিয়ে যায় না বা যাবে না কোনোক্রমেই। এটা সত্য যে, বিশ্বযুদ্ধ বা মহামারির মতো বড় ধাক্কা ঘড়ির কাঁটা ধীর করে দিতে পারে, কিছু সময়ের জন্য স্থবিরতার জন্ম দিতে পারে, কিন্তু বিশ্বায়নের চাকা থামিয়ে দিতে পারে না এতটুকু। শেষ পর্যন্ত সবকিছু অব্যাহত সংযোগের পথ ধরেই চলতে থাকে আবারও। বাস্তবতা এটাই।
‘আমরা কোন পথে হাঁটছি’—বাণিজ্য ও উন্নয়নসংক্রান্ত জাতিসংঘ সম্মেলনের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। উক্ত আংকটাডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৩২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের নতুন রেকর্ড স্পর্শ করেছে বিশ্ব বাণিজ্য। বছরটিতে পণ্য বাণিজ্য হয়েছে ২৫ ট্রিলিয়ন ডলারের, যা এক মাইলফলক—২০২১ থেকে ১০ শতাংশ বেশি। রেকর্ড ছাড়িয়েছে পরিষেবা বাণিজ্যও। এই খাতে বছরটিতে বাণিজ্যের পরিমাণ ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। আগের বছরের চেয়ে এই হার ১৫ শতাংশ বেশি। এসব চিত্র বিবেচনায় আংকটাড উল্লেখ করেছে, ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ইতিবাচক বৃদ্ধির হার এটা নির্দেশ করে যে, বৈশ্বিক চাহিদায় স্থিতিস্থাপক অবস্থা বিরাজ করছে।’ অর্থাত্ সবকিছুই চলেছে বা চলছে অনেকটা স্বাভাবিক গতিতেই। সাপ্লাই চেইনের মাধ্যমে কফি বা চা, জ্বালানি-যানবাহন, প্রোটিন-শস্য, ওষুধ-ভ্যাকসিনসহ সবকিছুই ঘরে বসে পেয়েছি আমরা। বৈশ্বিক শিপিং বিপ্লবের কারণেই ইউরোপীয়রা ফাস্ট-ফ্যাশনের শার্ট পরে, আফ্রিকান ও আরবরা তথ্য খুঁজতে স্মার্টফোনে আঙুল স্পর্শ করে, ব্রাজিলের সয়াবিনে পুষ্ট হয় চিনা শূকর। এই যে বাণিজ্যের আন্তঃসংযুক্ত চিত্র, যা গোটা বিশ্বের মানুষকে এক শামিয়ানার নিচে সমবেত করেছে—এ এক চরম আশ্চর্যের বিষয়! এই অবস্থায় কোনো একটি-দুটি বিষয়কে বিচার করে বিশ্বায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা অনুচিত। মহামারির আগে বিমান ভ্রমণশিল্প এক বিলিয়নেরও বেশি আন্তর্জাতিক যাত্রী পরিবহন করে রেকর্ড গড়ে। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএটিএ) তথ্য অনুসারে, আমরা এখন প্রাক-মহামারি পর্যায়ে ফিরে আসার খুব নিকটে আছি। ২০২৩ সালে এয়ারলাইনস আবার লাভজনক হওয়ার পথে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী নানা সংকট সত্ত্বেও ঘুরে বেড়ানো বন্ধ রাখেনি মানুষ।
লেখক: জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ফরেন পলিসি ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct