মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তিবিদ (আল জাজারি)
সাইফুল ইসলাম
ইসলামের স্বর্ণযুগ বলে পরিচিত মধ্যযুগ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দেখা যায় সে সময়কার অধিকাংশ পণ্ডিতগণ হয় জ্যোতির্বিজ্ঞান, নয় গণিতে সাফল্য লাভ করেছেন। আলকেমি নিয়ে গবেষণা করা মুসলিম বিজ্ঞানীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তবে যা মধ্যযুগে খুব একটা দেখা যেত না, তা হচ্ছে মেকানিক্স বা যন্ত্রবিজ্ঞান। মধ্যযুগের ইতিহাস পড়তে গেলে তাই মনে হতেই পারে যে মুসলিমরা প্রযুক্তিতে বেশ পিছিয়ে ছিল। কিন্তু আসলেই কি তা সঠিক? মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে কি একদমই প্রযুক্তির চর্চা ছিল না? ইসমাইল আল জাজারির জীবনী ও কাজ পড়বার পর প্রশ্নগুলোর উত্তর নিজেই বের করতে পারবেন পাঠক। তৎকালীন আরবের অনেকেই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র তৈরির চেষ্টা করছিলেন। অনেকের মাঝে সফলতা ধরা দেয় কেবল আল জাজারির কাছে। চাকার শ্যাফটে একধরনের ঘূর্ণায়মান যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, যাকে ক্যামশ্যাফট বলা হয়। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র তৈরির জন্য আল জাজারি তৈরি করেন পৃথিবীর প্রথম ক্যামশ্যাফট। এই ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন নিজের তৈরি জলঘড়ি, অটোম্যাটা আর পানি উত্তোলন যন্ত্রেও। বেশ সহজ গঠনের এই যন্ত্রাংশটি তৈরির সাথে সাথেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ১৪ শতকে ইউরোপে এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। খাদ্যশস্য গুঁড়ো করার জন্য সে সময় পাথরের যাঁতাকলের প্রচলন ছিল। এই জাঁতাকলের কৌশল কিছুটা আধুনিক ক্র্যাংকের মতোই। যাঁতাকলে রডের ব্যবহার এর কাজকে কিছুটা হলেও সুবিধাজনক করেছিল। তবে এর ব্যবহার আরো সুবিধাজনক করার জন্য কাজ শুরু করলেন আল জাজারি। তিনি পাথুরে যাঁতাকলের ধারণা থেকে বেরিয়ে একটি পুরোদস্তর ক্র্যাংক বসিয়ে দিলেন ঘূর্ণায়মান শ্যাফটের মধ্যে। ব্যস, হয়ে গেল চমৎকার এক যন্ত্রাংশ ক্র্যাংকশ্যাফট। এই যন্ত্রাংশটি একইসাথে দু’ধরনের জটিল গতি উৎপন্ন করতে পারতো- ঘূর্ণায়মান ও সম্পূরক গতি। শিল্পবিপ্লবের সূত্রপাত করা বাষ্প ইঞ্জিন থেকে আধুনিককালের দহন ইঞ্জিন এবং স্বয়ংক্রিয় গাড়িতেও ব্যবহার করা হচ্ছে এই যন্ত্রাংশ। এর কলাকৌশল একটি সরল অ্যানিমেশনের মধ্যমে নিচের ছবিটিতে দেখানো হলো। পেন্ডুলাম ঘড়িতে পেন্ডুলামের দোলন নিয়ন্ত্রণের জন্য চমৎকার এক যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার করা হয়, যার নাম ‘এস্কেপম্যান্ট অ্যাংকর’। আল জাজারি এই এস্কেপম্যান্টের কৌশল কাজে লাগিয়ে চাকার গতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের যান্ত্রিক কৌশল আবিষ্কার করে ফেলেন! আধুনিককালের গাড়ির ব্রেকের ধারণার একটি প্রাথমিক রূপ ছিল জাজারির আবিষ্কার! ‘চেইন পাম্প’ হচ্ছে পানি উত্তোলনের একধরনের সরল যন্ত্র, যার মধ্যে একটি বড় পাইপের ভেতরে একটি চেইনের সাথে সংযুক্ত একাধিক ডিস্ক বসানো থাকে। চেইন ঘুরতে শুরু করলে পানির ডিস্ক দ্বারা আটকা পড়ে এবং ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসে। পৃথিবীর প্রাচীনতম চেইন পাম্প আবিষ্কার করেছিলেন আর্কিমিডিস। বহু শতাব্দী পর আল জাজারি একটি নয়, দুটি নয়, পাঁচটি ভিন্ন কৌশলের চেইন পাম্প তৈরি করলেন! তার তৈরি এই পাম্পগুলো একটি সাধারণ নাম, ‘সাকিয়া চেইন পাম্প’ নামে পরিচিত। চেইন পাম্পে ক্র্যাংকশ্যাফটের ব্যবহারও সর্বপ্রথম জাজারির যন্ত্রেই দেখা যায়। আর আধুনিক যুগের অত্যাধুনিক যন্ত্রগুলোতে প্রয়োগ করা ‘ইন্টারমিটেন্সি সিস্টেম’ এর ধারণাও প্রথম আসে জাজারির এই সাকিয়া পাম্প থেকেই। অন্যদিকে, ‘হাইড্রোপাওয়ার’ দ্বারা পরিচালিত একটি সাকিয়া পাম্পও তৈরি করেছিলেন জাজারি, যা দ্বারা পানি উত্তোলনে মানুষের কায়িক পরিশ্রমের কোনো প্রয়োজন ছিল না। পুরো মধ্যযুগ জুড়ে আরবে জাজারির যন্ত্রগুলো পানি উত্তোলনে ব্যবহৃত হয়েছে। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের অনেক স্থানে এখনো এই যন্ত্র ব্যবহৃত হয়।
১২০৬ সালে আল জাজারি আধুনিক প্রকৌশলবিদ্যার জন্য অমূল্য এক যন্ত্র তৈরি করেন। তিনি একটি বিশেষ পানি শোষক যন্ত্র তৈরি করেন, যার মধ্যে প্রথমবারের মতো ‘ডাবল অ্যাকশন’ কৌশল ব্যবহার করা হয়। এই পাম্পেও তিনি ক্র্যাংক শ্যাফট ব্যবহার করেছেন। শ্যাফটের দু’পাশে দুটি সিলিন্ডার বসিয়ে তিনি তার চিন্তার অগ্রসরতার ছাপ রেখেছেন এই যন্ত্রে। আরো একাধিক কারণে জাজারির ডাবল অ্যাকশন পাম্পটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। যেমন- ভালভের ব্যবহার, পিস্টনের ব্যবহার, প্রথম কোনো পানি শোষক যন্ত্রে সরবরাহ পাইপের ব্যবহার, কিংবা ঘূর্ণায়মান গতিকে সম্পূরক গতিতে রূপান্তরের জন্য ক্র্যাংক শ্যাফটের ব্যবহার। আধুনিক যন্ত্রনির্মাণ কৌশলের অনেক দিকই জাজারির ডাবল অ্যাকশন যন্ত্রে ছিল। ১৫ শতকে ইউরোপে একধরনের নতুন পানি শোষক যন্ত্রের প্রচলনে বেশ সাড়া পড়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, তখনো ইউরোপে জাজারির ডাবল অ্যাকশন যন্ত্র পৌঁছোয়নি। যখন ইউরোপীয়রা জাজারির ডাবল অ্যাকশন যন্ত্র হাতে পেল, তারা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলো যে, জাজারির প্রায় ৩০০ বছর আগে প্রস্তুতকৃত শোষক যন্ত্রটি তাদের যন্ত্রের চেয়ে অনেক উন্নত! আল জাজারির কিছু স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বা অটোম্যাটার নমুনা দেখলে বিস্ময়ে আপনার চোখ কপালে ওঠার যোগাড় হবে। সংক্ষেপে সেগুলোর পরিচয় দিচ্ছি- হাইড্রোপাওয়ার চালিত পৃথিবীর প্রথম দিকের একটি স্বয়ংক্রিয় দরজা তৈরি করেন জাজারি। আধুনিককালের ঘড়িতে যেরকম নির্দিষ্ট সময়ে ঘন্টা দেয়ার জন্য একধরনের স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে যায়, যা থেকে কোনো পাখি বা বিশেষ বস্তু বেরিয়ে আসে, জাজারি নিজের তৈরি একটি জলঘড়িতে এমন স্বয়ংক্রিয় দরজা ব্যবহার করেছিলেন। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে মানুষের বদলে রোবট ওয়েটারের ব্যবহার শুরু হয়েছে। যদি বলি, বিশ্বের প্রথম রোবট ওয়েটারটি আল জাজারি তৈরি করেছিলেন! গঠনে, যান্ত্রিক কৌশলে অনেক পিছিয়ে থাকলেও জাজারির চিন্তাভাবনা ছিল বিস্ময়করভাবে অগ্রসর। অবশ্য জাজারি ওয়েটার নয়, ওয়েট্রেস বা পরিচারিকা তৈরি করেছিলেন। তার পরিচারিকাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চা, পানি কিংবা মদ পরিবেশন করতে পারতো। একটি মাঝারি আকৃতির ট্যাংকের মধ্যে থাকতে পানীয় যা ফোঁটায় ফোঁটায় প্রতি সাত মিনিটে নির্দিষ্ট পাত্র বা পেয়ালায় জমা হতো। এরপর সেটি একটি স্বয়ংক্রিয় দরজার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে পরিবেশন করতো সে পানীয়!
পৃথিবীর প্রথম ফ্লাশ টয়লেটের ধারণাও আসে তারই একটি আবিষ্কার থেকে। হাত ধোয়ার জন্য একটি অত্যন্ত শৌখিন যন্ত্র তৈরি করেন আল জাজারি, যা আজকের পৃথিবীতে বসেও ভীষণ রকমের শৌখিনই মনে হবে। ‘পিকক ফাউন্টেইন’ নামক যন্ত্রটি এরূপ- দেয়ালের মধ্যে একটি যান্ত্রিক ময়ূর স্থাপিত, যার লেজে রয়েছে একটি প্লাগ। এই প্লাগ টানলেই ময়ূরের ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করবে পানি! পানিতে আপনি হাত ভিজিয়ে নিতে নিতে আরেকটি প্লাগ টানুন, ময়ূরের নিচ থেকে এবার একটি স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে গিয়ে আপনার জন্য সাবান উপস্থিত হবে। সাবান মাখিয়ে হাত ভালোমতো ধুয়ে পুনর্বার আরেকটি প্লাগ টানুন, বেরিয়ে আসবে তোয়ালে! অটোম্যাটেড ময়ূর থেকেও আরো বিস্ময়কর যন্ত্র তৈরি করেছেন আল জাজারি। আর তা হচ্ছে ‘মিউজিক্যাল অটোম্যাট’ বা একটি রোবটের ব্যান্ডদল! মোটেও ভুল কিছু পড়ছেন না পাঠক, রাজকীয় কোনো অনুষ্ঠানে অতিথিদের বিনোদিত করার জন্য জাজারি তৈরি করেন একটি রোবট ব্যান্ড। একটি ছোট নৌকার উপর বসানো থাকে চারজন কৃত্রিম সঙ্গীতজ্ঞ। নৌকাটি লেকে ছেড়ে দেয়া হলে তা লেকের ঢেউয়ের সাথে দুলতে থাকে এবং ছন্দময় সুরের সৃষ্টি করে সেই চার বাদক! ঘড়ির প্রতি আল জাজারির ছিল বিশেষ আকর্ষণ। তিনি বিভিন্ন রকমের জলঘড়ি এবং মোমঘড়ি তৈরি করেছেন। তিনি একটি এক মিটার উচ্চতার শৌখিন মোমঘড়ি তৈরি করেছিলেন, তৈরি করেছিলেন একাধিক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়িও। সে সময়ের প্রচলিত সৌরমডেলের একটি চলন্ত মডেলও তৈরি করেন জাজারি। অন্যদিকে বছর জুড়ে দিনের দৈর্ঘ্যের তারতম্য নির্ণয়ের জন্য তৈরি করেন একটি ‘এলিফ্যান্ট ক্লক’। তবে আল জাজারির সবচেয়ে চমৎকার নির্মাণ হচ্ছে তার ‘ক্যাসেল ক্লক’। ৩.৪ মিটার উচ্চতার এই বিশাল ঘড়ির কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।
ঘড়িটি রাশিচক্রের বিশাল এক নকশা উপস্থাপন করে। চাঁদ, সূর্যের আবর্তন কক্ষপথ নির্দেশক রয়েছে। দিন-রাতের দৈর্ঘ্যের পরিবর্তনের সাথে সাথে ঘড়িতে সময় পরিবর্তন করা যায়। ডিজিটাল ঘড়ির মতো এই ঘড়িতেও ছিল অ্যালার্ম ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট সময় পর বাদ্য বাজাতে শুরু করতো ঘড়ির নিচে অবস্থিত একদল কৃত্রিম বাদক। আল জাজারি শুধু একজন ভালো যন্ত্র নির্মাতাই ছিলেন না, ছিলেন একজন দক্ষ চিত্রশিল্পীও। তিনি যা কিছু তৈরি করেছেন, সবকিছুরই ডিজাইন খুব সুন্দর করে এঁকে রেখেছিলেন। এই চিত্রকর্মগুলো পরে যুক্ত করেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বই ‘দ্য বুক অব নলেজ অব ইনজেনিয়াস মেকানিক্যাল ডিভাইসেস’ এ। কিছু ছবি দেখে নেয়া যাক। বদি উজ-জামান আবু ইবনে ইসমাইল ইবনে আর রাজ্জাক আল জাজারি, সংক্ষেপে ইসমাইল আল জাজারি সম্ভবত ১১৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। আর্তুকিদ নামক এক প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন তিনি, যা বর্তমানে তুরস্কের অন্তর্গত। জন্মস্থানেই সম্ভবত ১২০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন আল জাজারি। তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে এর বেশি কিছুই জানা যায় না। তিনি ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন তার অসাধারণ বই ‘বুক অব নলেজ অব ইনজেনিয়াস মেকানিক্যাল ডিভাইসেস’ এর জন্য। এই বইয়ে তিনি অসংখ্য যন্ত্রের যান্ত্রিক কৌশল এবং প্রস্তুত করার কার্যপ্রণালী উল্লেখ করেছেন। মূলত, উপরে তার যেসব যন্ত্রের কথা আলোচনা হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশরই কোনো নমুনা পাওয়া যায় না। তবে যন্ত্রগুলো যে আল জাজারি নির্মাণ করেছিলেন, তাতে ইতিহাসবিদগণ একমত। কারণ প্রতিটি যন্ত্রের নির্মাণকৌশল ছিল অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এবং তখনকার সময়ে নির্মাণযোগ্য। গণিতেও আল জাজারির গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তবে তিনি ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন পেয়েছেন একজন দূরদর্শী প্রকৌশলী, উদ্ভাবক এবং নির্মাতা হিসেবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct