জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত কপ২৭ সামিট ও ম্যানগ্রোভ অ্যালায়েন্সের প্রেক্ষাপট
সজল মজুমদার
শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
এক বা একাধিক নানা প্রাকৃতিক ও মানবিক কারণে পৃথিবী ও তার বায়ুমন্ডলের মধ্যে তাপীয় সমতার আকস্মিক বা ধীরগতিতে পরিবর্তন ঘটে চলেছে, আবহাওয়া ও জলবায়ুর এই অস্বাভাবিক আচরণকেই জলবায়ু পরিবর্তন বলে। জলবায়ু পরিবর্তনের অপার্থিব এবং পার্থিব নানা কারণসমূহ রয়েছে। যদিও পার্থিব কারণগুলো পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খরা, অস্বাভাবিক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, অনিয়মিত বর্ষা, পরিবর্তিত জলচক্র এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো এই পৃথিবীতে ঘটে চলেছে। শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ অভিবাসিত তথা বাস্তুচ্যুত হয়ে চলেছে।২০২১ সালে প্রকাশিত চরম আবহাওয়া সংক্রান্ত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভারত বিশ্বের সপ্তম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। এই বছরের শুরুর দিকে ব্যাপক বন্যা উত্তর পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের লক্ষাধিক মানুষের জীবন জীবিকা কে বাস্তু চ্যুত ও ধ্বংস করেছে। মোদ্দা কথা, দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব গুরুতর এবং আরো অধিক তীব্র হয়ে উঠছে। আবহাওয়া এবং জলবায়ুগত দুর্যোগ ও বিপর্যয় কে প্রতিরোধ করবার জন্য সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের (UNO) উদ্যোগে স্টকহোম সম্মেলন, কানাডার মন্ট্রিয়লে পরিবেশ সম্মেলন, বা ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে আর্থ সামিটে বিশ্ব পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পৃথিবীর প্রগতিশীল দেশগুলো একত্রিত হয়ে বিভিন্ন এজেন্ডা বা কর্মসূচিও গ্রহণ করেছে এবং সেগুলোকে বাস্তবায়িত করতেও সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তাদের নিজ নিজ পরিবেশ এবং জীব বৈচিত্র কে রক্ষা করবার জন্য পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন নীতি ও আইন তৈরি করেছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বা বিশ্বব্যাপী উষ্ণ করন কি স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে!!? নাকি পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমাগত উর্ধ্বমুখী!!! প্রসঙ্গত অতি সম্প্রতি এ বছরের 20 শে নভেম্বর মিশরের Sharm El Sheikh নামক স্থানে United Nations framework convention on climate change অথবা Conference of the Parties এর উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে COP27 সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।COP26 এর আগে হয়েছিল স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো তে। এবারের উক্ত COP27 পরিবেশ সম্মেলনে বিশ্বের ৯২ টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, ১৯০ টি দেশ, তথা ৩৫০০০ সর্বমোট প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য ২০১৬ সালের পর আফ্রিকা মহাদেশের অন্তর্গত কোন দেশে এই প্রথম এই ধরনের জলবায়ু সামিট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। COP27 সামিটে বিশ্ব জলবায়ু রক্ষার্থে একগুচ্ছ এজেন্ডা বা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। যেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে অনুকূল জলবায়ুর সুষ্ঠ প্রয়োগ, বিশ্ব জলবায়ু পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির সঠিক প্রয়োগ, Climate Empowerment কে কার্যকর করতে উপযুক্ত বিষয়গুলির নিরীক্ষণ, আফ্রিকা মহাদেশের মানুষ কে সহনশীল ও পরিবর্তনশীল উন্নয়নের মাধ্যমে সহযোগিতা প্রদান, জলবায়ুগত বিপর্যয়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন দেশের নির্দিষ্ট অঞ্চল বা স্থানগুলো পুনর্গঠনের জন্য আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সাহায্য প্রদান, জলবায়ু ক্ষেত্রে পারস্পরিক সংহতি, আন্তর্জাতিক বহু পার্শিয় সহযোগিতা বৃদ্ধি প্রভৃতি। অপরদিকে জলবায়ু ও জীববৈচিত্রগত গুরুত্ব ধরে রাখতে ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্যের জন্মস্থান হলো সুন্দরবন। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ যেমন প্রচুর পরিমাণ কার্বন শোষণ করে পরিবেশে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে, তেমনি বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের উপকূলীয় ঝড়ের হাত থেকে স্থানীয় মানুষজনকে রক্ষা করে চলেছে।। এক কথায় সামাজিক ও বাস্তু তন্ত্রগত দিক থেকে ভাবলে সুন্দরবনের বিরাট গুরুত্ব রয়েছে, একথা বলাই যায়। এই গুরুত্বকে সামনে রেখেই এবারের COP27 সামিটে একটি আন্তর্জাতিক সরকারি জোট গড়ে তোলা হয়েছে। যাকে Mangrove Alliance for Climate (MAC) বলা হচ্ছে। মূলত সারা বিশ্বের পরিবেশে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের গুরুত্ব সম্পর্কিত সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই এই জোট।MAC এর অন্যতম অংশগ্রহণকারী দেশগুলো হলো UAE, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং স্পেন।MAC জোট সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভারতের অন্যতম লক্ষ্য হলো আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপন করে ২.৫ থেকে ৩ বিলিয়ন টোন উৎপাদিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস কে শোষিত করবার ব্যবস্থা করা। উল্লেখ্য COP27 সামিটে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্বকারী অরণ্য, জলবায়ু পরিবর্তন, তথা পরিবেশবিভাগের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব MAC জোট সম্পর্কে বলেন, “ ভারতের উপকূলীয় অরণ্যের জীব বৈচিত্র এবং উপকূলের ক্ষয় রোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, পাশাপাশি অগণিত মানুষের জীবন জীবিকা উপকূলীয় অরণ্যের উপর নির্ভরশীল। তাই আগামীতে ক্ষতিকারক গ্রীন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ কমাতে ম্যানগ্রোভ বনসৃজন করার পাশাপাশি ম্যানগ্রোভ ধ্বংস প্রতিরোধ করার বিষয়টিতেও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে”। অন্যদিকে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত চরঘেরি গ্রামের বাসিন্দা, বর্তমানে পেশায় ভূগোল শিক্ষক, কিন্তু নেশায় ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ ও সমাজ , পরিবেশের সচেতনতার বার্তা সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া, এযাবৎ সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকায় লক্ষাধিক ম্যানগ্রোভ চারা রোপন করে নজির সৃষ্টিকারী ম্যানগ্রোভম্যান বলে পরিচিত উমা শংকর মন্ডল MAC জোট সম্পর্কে জানালেন, “ সুন্দরবনের কোর বা বাফার অঞ্চলে যেসব মানুষ বসবাস করে, যারা প্রতিনিয়ত জীবন জীবিকার জন্য লড়াই করছে, উপকূলীয় ঝড়ের সাথে লড়াই করছে, হিংস্র বন্যপ্রাণী র সাথে বেঁচে থাকার সংগ্রামে রয়েছে সেই রকম মানুষের সংখ্যা এখানে প্রায় ২৫ লাখের মতো হবে। তাই প্রধানত ম্যানগ্রোভ অরণ্য ভিত্তিক সুন্দরবনের যেমন বাস্তুতন্ত্রগত গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি অ প্রত্যক্ষভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকেও এর গুরুত্ব আছে। তবে এবারের COP27 এ MAC জোট হওয়াতে অফিসিয়ালি ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে বলতে গেলে। উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি কাজ, নারী স্বাস্থ্য, নারী ক্ষমতায়ন, প্রভৃতি বিষয়গুলোর মত ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের জন্য MAC জোট স্থাপন আগামীতে জলবায়ুগত বিপর্যয়গুলো প্রতিহত করতে খুবই কার্যকরী হবে বলে আশা করছি”। অর্থাৎ গ্রীন হাউজ গ্যাস গুলো র নিঃসরণ, নির্গমন কমানোর জন্য এবারের COP27 সামিটের বিশেষ কর্মসূচি Reducing Emissions from Deforestation and forest Degradation (REDD) বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে MAC জোট তৈরি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ বলতেই হয়। অন্যদিকে এবারের জি-20 বৈঠকে ও ভারত অন্যতম নেতৃত্ব প্রদানকারী দেশ, এবারের জি- 20 বৈঠকেও বিভিন্ন বিবেচ্য এজেন্ডা গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জলবায়ু ক্ষতি মোকাবেলায় অর্থের যোগানের ক্ষেত্রে খসড়া প্রস্তুতি, মাঝারি ও নিম্ন আয়ের দেশ গুলিতে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়ার জন্য উৎসাহ প্রদান, বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।সুতরাং পরিশেষে বলতেই হয় , বিশ্বব্যাপী উষ্ণ করন স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য সমগ্র বিশ্বের ছোট বড় রাষ্ট্রগুলো একজোট হয়েই কাজ করে চলেছে । এবং এভাবেই আমরা সম্মিলিতভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই সুন্দর পৃথিবীকে বাসযোগ্য যাতে করে রেখে পারি সেই প্রচেষ্টা তেই সমবেতভাবে এভাবেই সকলকে ব্রতী, সংকল্পবদ্ধ হতে হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct