বুড়িমার আর্তনাদ
মনির চৌধুরী
কিচিরমিচির পাখি ডাকা হেমন্তের ভোরে শিশির সিক্ত দূর্বাঘাস ও পথঘাট। সূর্যের আলোতে শিশিরকণাগুলো হীরা-মুক্তার মতো জ্বল জ্বল করে জানান দিচ্ছে, শীত এসেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় ঘাসের উপর চাদর বিছিয়ে আছে ভোরের শিশিরকণা। আর সেই ঘন শিশিরকণার মাঝে গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটার দিকে পায়ে হেঁটে প্রাইভেট পড়তে যেতাম আমজাদ স্যারের বাসায়। আমজাদ স্যারের বাসা থেকে একটু দূরে রাস্তার পাশে ছিল একটা বৃদ্ধাশ্রম। আর সেই বৃদ্ধাশ্রমের প্রবেশ দ্বারের পাশে ছিল একটা বকুল ফুল গাছ। সেই বকুল ফুল গাছ থেকে দখিণা বাতাসে ভেসে আসত বকুল ফুলের সুগন্ধ। বকুল ফুলের সুগন্ধে মুগ্ধ হয়ে আমি আর আমার বন্ধুরা আমজাদ স্যারের বাসায় বই রেখে বকুল ফুল কুড়ানোর জন্য প্রতিদিন ছুটে যেতাম বৃদ্ধাশ্রমের সেই বকুল ফুল গাছ তলায়। আমরা বকুল ফুল গাছের নিকট যাওয়া মাত্রই আমাদের হই হল্লা দেখে প্রচন্ড ঠান্ডার মাঝে মোটা চাদর গায়ে মুড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে ষাট বছরের এক বৃদ্ধ বুড়িমা লাঠি হাতে ছুটে আসত আশ্রমের গেটের সামনে এবং সেখান থেকে বৃদ্ধ বুড়িমা লাঠির উপর ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে আমাদের দিকে ছলছল চোখে চাতক পাখির মত তাকিয়ে থাকত আর বিড়বিড় করে একা একা কথা বলতো। আমি যেই বৃদ্ধ বুড়িমার দিকে তাকাতাম, তখন বৃদ্ধ বুড়িমার মনটা যেন ভীষণ খারাপ হয়ে যেত। দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো। বকুল ফুল কুড়িয়ে সেখান থেকে যখন চলে আসতাম, তখন বৃদ্ধ বুড়িমা মন খারাপ করে লাঠি উপর ভর দিয়ে গেটের কাছ থেকে চলে যেত। এই দৃশ্য দেখে আমি মনে মনে চিন্তা করতাম, বৃদ্ধ বুড়িমা আমাদেরকে দেখে প্রতিদিন সকালে কনকনে ঠান্ডা শীতে মলিন চাদর গায়ে জড়িয়ে লাঠি হাতে ঠক ঠক শব্দ করতে করতে কার জন্য গেটের কাছে ছুটে আসে। আর কেনোই বা প্রতিদিন আমাদের দিকে চাতক পাখির মত অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে। কি রহস্য লুকি আছে ঐ বৃদ্ধ বুড়িমার মাঝে? কার জন্য অপেক্ষার প্রহরে নীরবে নিভৃত্বে কাঁদে। আমাকে একদিন বৃদ্ধ বুড়িমার কাছে অজানা রহস্য সম্পর্কে জানতে হবে। এদিকে স্যারের বকুনির ভয়ে, সেদিন বকুল ফুল কুড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে বন্ধুদের সাথে স্যারের বাসায় ফিরে আসি। স্যারের বাসায় ফিরে আসার পর দেখি, স্যার প্রাইভেট পড়ানো শুরু করে দিয়েছে। আমি তখন বই খাতা ব্যাগ থেকে বাহির করে টেবিলের উপর রেখে স্যারের লেকচার মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকি। স্যারের প্রাইভেট পড়ানো যখন শেষ হয়ে গেল, তখন স্যারকে বিদায় জানিয়ে বন্ধুদের সাথে বাড়িতে ফিরে আসি। বাড়িতে ফিরে এসে প্রথমে হাত মুখ ধুয়ে সকালের নাস্তা করে কলেজে চলে যায়।
কিন্তু সেদিন কলেজে ক্লাস করতে ভালো লাগছি না। বারবার সেই বৃদ্ধ বুড়িমার কথা মনে পড়ছিল। কলেজের ক্লাসে মন বসছিল না। সেই জন্য কলেজে কয়েকটা ক্লাস করে সেদিন সবার আগে বাড়িতে চলে আসি। এদিকে সবার আগে কলেজ থেকে বাড়িতে চলে আসার কারণে আম্মু আমাকে দেখে বলছে, ‘কিরে আজকে এতো তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে আসলি কেনো? কলেজ ছুটি হয়ে গেছে নাকি?’ আমি তখন আম্মু বললাম, ‘না আম্মু! কলেজ এখন ছুটি হয়নি। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছিল। কলেজে ক্লাস করতে ভালো লাগছিল না। এই জন্যই সবার আগে কলেজ থেকে বাড়িতে চলে আসলাম।’ আম্মু তখন আমাকে বলছে, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, দুপুরে গোসল করে খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম কর তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ আম্মুর কথা মত গোসল করে দুপুরের অল্প একটু খাবার খেয়ে বিশ্রামের জন্য শয়নকক্ষে প্রবেশ করলাম। তারপর বিছানাপত্র ঠিক করে বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু সেদিন আমার দু’চোখে ঘুম আসছিল না। বারবার সেই বৃদ্ধ বুড়িমার মায়াবী চেহারা আমার দু’চোখে ভাসছিল। মনের মাঝে বারবার প্রশ্ন জাগছিল, কে ওই বুড়ি? কোথায় তার ঠিকানা? কেনোই বা প্রতিদিন আমাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে? বৃদ্ধ বুড়িমাকে নিয়ে চিন্তা করার কারণে সেদিন আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায় এবং প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছিল। কিন্তু একটু পরে আম্মু, আমার কক্ষে এসে আমাকে দেখে বলছে, কি করে ঘুম আসছে না? আমি তখন বললাম, ‘না আম্মু! আজকে কিছুতেই ঘুম আসছে না।’ তখন আম্মু, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। ক্লান্ত মন নিয়ে আমি আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লাম। সেদিন আর বিকালে বন্ধুদের সাথেও আড্ডা দেওয়া হলো না। মজা করে খেলাধুলা করা হলো না। তারপর বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো, ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে আমজাদ স্যারের প্রাইভেটের পড়া গুলো কোন রকম তৈরি করলাম। নয়তো পরের দিন সকালে প্রাইভেটে পড়া না হলে, স্যার আমাকে ভীষণ বকাবকি করবে। কোন রকম প্রাইভেটের পড়া গুলো তৈরি করে রাতের খাবার খেয়ে আগে ভাগেই ঘুমিয়ে পরলাম। নিস্তব্ধ নিশিরাত যখন অবসান প্রায় পাখিদের কিচিরমিচির ডাকে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে প্রতিদিনের মত চাঁদর গায়ে দিয়ে প্রাইভেট পড়তে গেলাম আমজাদ স্যারের বাসায়। স্যারের বাসায় প্রবেশ করা মাত্র বৃদ্বাশ্রমের সেই বকুল ফুল গাছ থেকে ভেসে আসেছিল সুমধুর গন্ধ। বকুল ফুলের গন্ধ পেয়ে আমি সেদিন একা একা ছুটে গেলাম বকুল ফুল কুড়াতে। আমি সেখানে যেই উপস্থিত হলাম, তখন আমাকে দেখতে পেয়ে বৃদ্ধ বুড়িমা লাঠি হাতে নিয়ে ঠক ঠক শব্দ করতে করতে প্রতিদিনের মত ছুটে এলো গেটের কাছে। আর আমার দিকে চাতক পাখির মত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তখন আমি বকুল ফুল কুড়ানো বাদ দিয়ে সাহস করে আস্তে আস্তে বৃদ্ধ বুড়িমার কাছে ছুটে গেলাম। বৃদ্ধ বুড়িমা আমাকে দেখে লজ্জায় ঘোমটা দিল। আমাকে কাছে পেয়ে খুব খুশি হল এবং মৃদু হাসি দিয়ে আমার কপালে চুমু খেলো। তখন আমি সাহস করে প্রথমে বৃদ্ধ বুড়িমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বুড়িমা তুমি প্রতিদিন আমাদেরকে দেখে কিসের জন্য প্রতিদিন গেটের কাছে ছুটে আসো? আর কেন-ই বা আমাদেরকে দেখে চাতক পাখির মত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাক?’ তখন বৃদ্ধ বুড়িমা আমাকে বলছে, ‘বাবা! আমার ছেলে আর ছেলের বউ সেই যে কবে আমাকে এখানে একা রেখে চলে গেছে। আর কোনদিন ফিরে এলো না। আমাকে একটিবারও খোঁজ খবর নিতে এলো না। চার দেয়ালের বন্দি কারাগারে একা থাকতে আমার আর ভালো লাগছে না। শেষ বয়সে নাতি-নাতনিদের সাথে মজা করে দিন কাটাব কি, তা নয় অসুস্থ শরীর নিয়ে একা একা বন্দি কারাগারে পচে মরতে হচ্ছে। কত কষ্ট করেছি, সেই সোনার টুকরো ছেলের জন্য। নিজে একবেলা না খেয়ে, নিজের জীবন মাটি করেছি কোন অচেনা সুখের আশায়। কিন্তু তার বিনিময়ে আমি আজ কিছুই পেলাম না। কি হতভাগা কপাল আমার?’ এই কথা বলতে বলতে, সেদিন বৃদ্ধ বুড়িমা হাউমাউ করে আমার সামনে কেঁদে ফেলল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct