এই বছরে একটি দীর্ঘস্থায়ী মহামারি গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বেড়েছে, মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়েছে এবং সর্বোপরি এই বছরটিতে ইউরোপে একটি রক্ত ও সম্পদক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে, যা গোটা বিশ্বকে ঝাঁকুনি দিয়েছে। এই দুর্যোগ–দুর্বিপাকের মধ্যে কিছু কিছু প্রত্যাশিত থাকলেও বেশির ভাগই অপ্রত্যাশিত ছিল। এসব দুর্যোগের সব কটিই আমাদের এমন শিক্ষা দিয়েছে, যা আমাদের অনেক ভুল ভাঙিয়ে দিতে পারে। এতে আমাদের প্রচলিত ধারণাগুলো ভেঙে যেতে বসেছে। এ নিয়ে লিখেছেন রিচার্ড হাস।
২০২২ সালের চলে যাওয়া নিয়ে খুব কম লোকই আফসোস করবে। কারণ, এই বছরে একটি দীর্ঘস্থায়ী মহামারি গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বেড়েছে, মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়েছে এবং সর্বোপরি এই বছরটিতে ইউরোপে একটি রক্ত ও সম্পদক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে, যা গোটা বিশ্বকে ঝাঁকুনি দিয়েছে। এই দুর্যোগ–দুর্বিপাকের মধ্যে কিছু কিছু প্রত্যাশিত থাকলেও বেশির ভাগই অপ্রত্যাশিত ছিল। এসব দুর্যোগের সব কটিই আমাদের এমন শিক্ষা দিয়েছে, যা আমাদের অনেক ভুল ভাঙিয়ে দিতে পারে। এতে আমাদের প্রচলিত ধারণাগুলো ভেঙে যেতে বসেছে। প্রথম বিষয় হলো, দেশগুলোর মধ্যে যে যুদ্ধ হচ্ছে তাকে কিছু বিশ্লেষক অপ্রচলিত ঘটনা ছাড়া আর কিছুই মনে করেননি। আমরা ইউরোপে যা দেখছি, তা আদতে একটি পুরোনো আমলের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ যেখানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সার্বভৌম ও স্বাধীন সত্তার তালিকা থেকে ইউক্রেনকে বাদ দিতে চাইছেন।পুতিন ভেবেছিলেন, অতি সহজে ও অতি দ্রুত তিনি জয় পাবেন। কিন্তু তার বদলে তিনি আবিষ্কার করলেন, তিনি তাঁর নিজের সেনাবাহিনীকে যতটা শক্তিশালী ভেবেছিলেন, তারা তা নয়। এ ছাড়া তিনি দেখলেন, তিনি এবং পশ্চিমের অনেকে ইউক্রেনকে যতটা দুর্বল ভেবেছিলেন, আদতে তারা তার চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ফলে ১০ মাস পরও যুদ্ধ চলছে এবং তা কখন শেষ হবে, তারও ঠিক নেই। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরতা যুদ্ধের পথে একটি বাধা হিসেবে কাজ করে। কারণ, যুদ্ধ বাধিয়ে পারস্পরিক লাভজনক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কগুলোকে ব্যাহত করতে কোনো পক্ষই আগ্রহী হবে না—দীর্ঘদিনের এই ধারণাটি আর টিকছে না। এখন দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক বিবেচনাই সবার আগে আসে। প্রকৃতপক্ষে, রাশিয়ার জ্বালানির ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্ভরতা সম্ভবত পুতিনকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছিল। পুতিন ভেবেছিলেন, জ্বালানি সরবরাহের কথা ভেবে ইউরোপ তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। কিন্তু ইউরোপ ঠিকই রাশিয়ার বিরুদ্ধে গেছে।
তৃতীয় বিষয়টি হলো, ইন্টিগ্রেশন বা একত্রীকরণ তত্ত্ব, যা চীনের ক্ষেত্রে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, অর্থনৈতিক সম্পর্ক-সাংস্কৃতিক, একাডেমিক এবং অন্যান্য আদান-প্রদানের বদৌলতে রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটায়, যা একটি দেশকে অধিকতর উন্মুক্ত ও বাজারভিত্তিক করে তোলে। কিন্তু চীনের সঙ্গে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদান–প্রদানের পর দেখা যাচ্ছে, সেখানে এখন আরও নিপীড়নমূলক শাসন চলছে। চতুর্থ বিষয়টি হলো, পশ্চিমা দেশগুলোর পছন্দের বাইরে কাজ করা দেশগুলোকে বাগে আনতে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের যে চল বহু আগে থেকে আছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করছে না। নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়া দেশগুলো খুব কমই তাদের আচরণে অর্থপূর্ণ পরিবর্তন আনে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া তার বড় প্রমাণ। রাশিয়াকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালানো থেকে বিরত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ একযোগে মস্কোর ওপর অবরোধ আরোপ করেছে। কিন্তু সেসব অবরোধ পুতিনকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরিয়ে আনতে পারেনি। পঞ্চম বিষয় হলো, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’ বাক্যাংশটিকে এখন অবসরে পাঠানো উচিত। কারণ, কার্যত ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’ বলে আসলে কিছুই নেই। নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতা জাতিসংঘকে নপুংসক করে তুলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করার জন্য মিসরে বিশ্বনেতাদের সাম্প্রতিক সমাবেশ ছিল একটি চরম ব্যর্থতার উদাহরণ। ষষ্ঠ বিষয় হলো, সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিপর্যায়ে ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সম্ভাবনা কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার তুলনায় গণতন্ত্রে অনেক বেশি। চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা তঁাদের সমাজকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ইন্টারনেটের কনটেন্টের বিষয়বস্তু নিরীক্ষণ এবং সেন্সর—উভয়ই সহজে করতে পারেন।
লেখক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct