২০২২ সাল জুড়ে বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের হাত ধরে কিছু সময়ের জন্য হলেও বিশ্বের প্রধান শক্তি তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্ব। এর কারণও স্পষ্ট—আপেক্ষিক শক্তি ও দুর্বলতার স্থানান্তর। বৈশ্বিক অর্থনীতি শ্লথ হয়ে যাওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাত ব্যাপকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। গোটা ইউরোপের অর্থনৈতিক চিত্র পালটে গেছে। এ নিয়ে লিখেছেন রিচার্ড ডি উলফ। আজ প্রথম কিস্তি।
২০২২ সাল জুড়ে বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের হাত ধরে কিছু সময়ের জন্য হলেও বিশ্বের প্রধান শক্তি তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্ব। এর কারণও স্পষ্ট—আপেক্ষিক শক্তি ও দুর্বলতার স্থানান্তর। বৈশ্বিক অর্থনীতি শ্লথ হয়ে যাওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাত ব্যাপকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। মার্কিন মিত্র হিসেবে ইউরোপেও যে এর আঁচ লাগবে, তা চোখ বন্ধ করেও বলে দেওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে ঘটেছেও তাই। গোটা ইউরোপের অর্থনৈতিক চিত্র পালটে গেছে। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এই অঞ্চলের ভবিষ্যত্ ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে, যা অজানা নয় কারো। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মন্থর গতি থেকে নিস্তার পায়নি সাম্প্রতিক সময়ে আলো ছড়ানো গণচীনও। যদিও সমস্যার সম্মুখীন হলেও তা থেকে অবিস্মরণীয়ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে ইতিবাচক পর্যায়ে আছে শি জিন পিংয়ের চীন। এরূপ প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের গভীর মৈত্রী এবং অর্থনৈতিকভাবে দেশটির ঘুরে দাঁড়ানোর চিত্র চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয় কিছু রাষ্ট্রের কপালে। বছরের পর বছর ধরে ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক প্রতিযোগিতা, শুল্ক ও বাণিজ্যযুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা ও ভর্তুকির মধ্য দিয়ে ২০২২ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক যুদ্ধ এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। এসবের মধ্যে বিদায়ি বছর রেখে যাচ্ছে আরেক মহাসমস্যা—ইউক্রেন যুদ্ধ। যদিও আসল ঘটনা অন্যখানে। মূলত রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে যে যুদ্ধ চলছে, তাকে ‘সামরিক যুদ্ধ’ বলা হচ্ছে যদিও, কিন্তু এর আড়ালে রয়েছে অন্য বাস্তবতা। এখন পর্যন্ত সংঘর্ষে উভয় পক্ষের সেনা এবং ইউক্রেনের জনগণের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগের বিষয়কে বাদ দিলে এই যুদ্ধকে ‘একটি সীমিত ও গৌণ ব্যাপার’ ছাড়া অন্য কিছু হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বলতে হয়, এ বছরের মূল বাস্তবতা বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বনাম রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ। বলা বাহুল্য, উভয় পক্ষের নিষেধাজ্ঞা ও পালটা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে সমগ্র বিশ্বে চরম নাভিশ্বাস ওঠে, যার রেশ ক্রমশ বাড়ছেই। এর অভিঘাতে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিসহ সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হয়ে বিশ্ববাজার হয়ে ওঠে টালমাটাল।
দেশে দেশে বাজারব্যবস্থায় ঘটেছে ব্যাপক পরিবর্তন। পরিস্থিতি দিনে দিনে কেবল খারাপের দিকেই যাচ্ছে! উদ্বেগের সব থেকে বড় বিষয়, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি এতটাই বেড়েছে যে, বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৩ সাল থেকে চলছে ‘মহামন্দার বছর’। উল্লেখ করা দরকার, বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতির গায়ে ক্রমাগতভাবে চাবুক মেরে চলেছে ঊর্ধ্বমুখী সম্পদ ও আয়ের পুনর্বণ্টন প্রক্রিয়া। এ দুটি খাতে ভারসাম্যহীনতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণি। এর ফলে অনিবার্যভাবেই শ্রমগোষ্ঠী থেকে আসছে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। ২০২২ সাল জুড়ে বিশ্বের বহু দেশে শ্রমিকশ্রেণির অসন্তোষ ছিল চোখে পড়ার মতো। সম্পদ ও আয় খাতে অস্থিরতার কারণে দৈনন্দিন ব্যয়সীমা সংকোচন করা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য একপ্রকার অসহনীয় হয়ে উঠেছে। শ্রমিকের রাস্তায় নেমে পড়া, সংঘবদ্ধ আন্দোলন, ধর্মঘট—এ সবই ছিল বছড় জুড়ে বড় সংবাদ। মজার ব্যাপার হলো, সমসাময়িক পুঁজিবাদ যে গভীরতর বৈষম্য, অস্থিতিশীলতা ও অন্যায়-অন্যায্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, তা থেকে উত্তরণে তথাকথিত বাম ও ডান—উভয়পন্থি সরকার ও দলগুলো কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তা পর্যবেক্ষণে রাখে শ্রমিক সমাজ। এসব ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত পর্যাপ্ত উদ্যোগ গ্রহণ না করায় শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তেই থাকে। এই অবস্থায় পুঁজিবাদের জাঁতাকলে পড়া ভুক্তভোগী নিম্নবিত্ত গোষ্ঠী হাত মেলায় পুঁজিবাদের সমালোচকদের সঙ্গে। এর ফলে মহাশক্তির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে উত্থান ঘটে গ্লোবাল সাউথের। এ অবস্থায় পুঁজিবাদী কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে কিছু পদক্ষেপ হাতে নেয় যদিও, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনে তা যথেষ্ট নয় বলেই প্রতীয়মান হয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct