বাবা
তাপস কুমার বর
ভাঙা চেয়ারটা দরজার এক কোনে উলঙ্গ খামখেয়ালীর মতো নীরব হয়ে গেছে। যে চেয়ারটায় এক সময় বিমল বাবু কত গল্প, কবিতা ও উপন্যাস লিখতো বসে। আজ সেই মানুষটা বয়সের ভিড়ে নিজের আত্মীয়দের কাছে “একটা অবাঞ্চিত জড় বস্তু”! আজ কোথায় বিমল বাবু? কেউ খোঁজ করে না। একদিন যে মানুষটা নিজের সর্বস্ব দিয়ে নিজের পরিবারকে রক্ষা করে গেছে, আজ সেই মানুষটার ঠাঁই হয়নি তার নিজের পরিবারে! অমল: কে বলছেন? স্কুল শিক্ষক: আমি প্রিয়তোষ। আপনার বাবা যে স্কুলে চাকরি করতেন, সেই স্কুল থেকে বলছি। আমাগীকাল স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান, তাই বিমল বাবুর সঙ্গে কথা বলে উনাকে আমাদের স্কুলে আমন্ত্রণ করতে চাই। অমল: বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিল। আজকের সেই বিমল বাবু কোথায়? পয়ত্রিশটা বছর প্রাথমিক শিক্ষকতার কাজে যুক্ত ছিলেন। তিনবছর আগে বিমল বাবুর স্ত্রী মোহিনী দেবী মারা গেছেন। বিমল বাবু স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। আজ সেই মানুষটা নেই। এখন তার ছেলে-মেয়েরা বৃদ্ধ বাবাকে “বোঝা ভাবে”,.......“জীবনের দৌড়ে লাগাম লেগে গেছে, পেনশনের টাকাতে কোন রকম দিন চলে”। -বিমল বাবুর একমাত্র ছেলে অমল বেকার একটা বাউন্ডুলে ছেলে। সারাদিন নেশা ভাঙে ডুবে থাকে। বৌমাটাও বিমল বাবুকে সহ্য করতে পারেনা। আজ এই সমাজের বুকে মাঝে মাঝে পেছনে শুনতে হয়,....... “বাবা শিক্ষক, ছেলে নেশা ভাঙ করে”! - এই যন্ত্রণা অনেক কষ্টের, অনেকবার বিমল বাবু অমলকে বোঝাতে চেয়েছে,.... বিমল বাবু: বৌমা অমল কোথায়? বৌমা: কি জানি, বাবা আপনি গিয়ে খোঁজ করে নিন না!
বিমল বাবু: বৌমা তুমি অমলকে একটু বুঝিয়ে বলবে। এইভাবে নেশা ভাঙ করলে একদিন ওকে চরম বিপদে পড়তে হবে। এদিকে সমাজের কু-কথা,গাল-মন্দ শুনতে হয় সমাজের লোকেদের থেকে। বৌমা: বাবা আপনার যদি না ভালো লাগে এখান থেকে চলে যান না। “নিজের খাওয়া জোগারের মোরদ নেই, আবার সম্মান নিয়ে চলেন”! - অমল বাবু সেদিন মনে মনে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে। সে দুঃখ কাউকে বলা যায় না! সেদিন রাতে বিমল বাবুর সঙ্গে অমলের অনেক ঝামেলা হলো,..... অমল: বাবা তুমি তোমার বৌমাকে কি বলেছো? বিমল বাবু: বাবা, নেশা ভাঙ করা ছেড়ে দে। ব্যবসা কর, তোদের ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে খোকা। অমল: নিজের খাবার জোগারের মোরদ নেই, বড়ো কথা বলছেন। এখানে থাকতে গেলে আমাদের কথা মেনে চলতে হবে। বিমল বাবু: খোকা, তোদের জন্য এতোকিছু করলাম তাও তোরা আমাকে এইভাবে অপমান করছিস! অমল: বেশ করেছি। তুমি এখান থেকে বেরিয়ে যাও! - সেদিন বিমল বাবু চোখের অশ্রু লুকিয়ে নীরবে বোবা পাখির মতো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল,...... “মোহিনী দেখে যাও, তোমার ছেলে-মেয়েরা আমায় কত সুখী রেখেছে। তুমি থাকলে আমি দেখাতাম এ যুগের ছেলেদের বৃদ্ধ বাবাদের প্রতি তাদের ভবিষ্যৎ না কি বোঝা হয়ে যায়”? - বিমল বাবু কাঁদতে কাঁদতে মেয়ে ললিতাদের বাড়িতে ওঠে। সেখানে বিমল বাবু সব কথা বলে,....... বিমল বাবু: মা কেমন আছিস? ললিতা: কোন রকমে চলে যাচ্ছে বাবা। বিমল বাবু: কেন রে মা? জামাই কোম্পানির মেনেজার। এবারে তো প্রোমোশন হলো। কোম্পানি থেকে একটা কার ও গিফট করেছে শুনলাম। ললিতা: চুপ! - বিমল বাবু একদিন মেয়েদের বাড়িতে থেকে তিনি মনে মনে অনুভব করলেন। বৃদ্ধ বাবার জন্য তাদের মধ্যে একটু ঝামেলা শুরু হয়েছে। পরদিন সকালে বিমল বাবু তল্পিটা গুছিয়ে মেয়ে ও জামাইকে ডেকে বললো,....
“ এ বার আসি মা। তোরা ভালো থাকিস”! - আজ সেই বিমল বাবুর একটা অনাথাশ্রমে ঠাঁই জুটেছে,..... “অনেক অনাথ শিশু। সকলকে নিয়ে বিমল বাবুর জীবনটা এখন খুব আনন্দে কাটে”! জীবনের দৌড়ে হেরে গেছে। কত অনাথ শিশু, তাদের শিক্ষাদেন বিমল বাবু। রাতের আড্ডায় সকলকে শোনায় “মা ও বাবাকে কি করে শ্রদ্ধা করতে হয়”। বতর্মান সমাজ ব্যবস্থা যে দিকে গড়াচ্ছে একদিন এই পৃথিবীর বুক থেকে “মায়া-মমতা বিলুপ্ত হয়ে যাবে, সেদিন থাকবে শুধু হিংসা”! এতোগুলো বছর কাটিয়ে দিল বিমল বাবু। একবার ও ছেলে-মেয়েরা খবর নেয়নি। বাবা বেঁচে আছে,না মরে গেছে। একদিন বাজার থেকে বিমলবাবু ফিরছিল। কিছুটা দূরে একটা ছোট্ট ফুটফুটে শিশু “দাদু দাদু বলে চিৎকার করে ছুটে আসছে” পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো ছেলে অমল ও বৌমাকে। আজ সেই ছোট্ট নাতিটাই বার বার বাবাকে জিজ্ঞাসা করছে,...... “”বাবা দাদু আমাদের সঙ্গে থাকে না কেন?” - সেদিন ছেলে আমল ও বৌমা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে বিমল বাবুর কাছে তারা ক্ষমা চায়,.....“ক্ষমা করে দিও বাবা, তোমার প্রতি যে অন্যায় করেছি আজ নিজেকে ছেলে হিসাবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগছে”! - বিমল বাবুর দুটো চোখে অশ্রু বয়ে এলো। বিমল বাবুকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলো তার ছেলে বৌমা কিন্তু বিমল বাবু বললো,..... “তোরা ভুল বুঝতে পেরেছিস এটাই অনেক রে খোকা। আমি তোদের সঙ্গে যেতে পারবো না। এই অনাথাশ্রমে অনেক ছোট্ট ছোট্ট শিশুকে শিক্ষা দিতে হবে খোকা। না হলে ওদের ভবিষ্যৎ অন্ধকূপের মতো হয়ে যাবে”! ছোট্ট নাতিটা দাদুকে বললো,.... “দাদু তুমি কাঁদছো, হাত দিয়ে চোখের আশ্রুটা মুছিয়ে দিল”! বিমল বাবু হেসে উঠলো,... “আমার ছোট্ট নাতিটা, আমাদের সেই ছোট্ট অমল দেখে যাও মোহিনী”!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct