শিক্ষা মানব জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষাই মানুষের মধ্যে আত্মবোধ, আত্মবিশ্বাস অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়, ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিত বুঝতে শেখায়। যারা শিক্ষিত হয়েছে তারা সকলেই সভ্য, উন্নত ও মর্যাদাসম্পন্ন। কিন্তু, বিবেক, বুদ্ধি, বিজ্ঞতা ও তর্কশক্তি দ্বারা ভূষিত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের মুসলিম সমাজ অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে আছে। মুসলিম ছেলে-মেয়েদের স্কুলছুট হওয়ার সংখ্যা অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি। সংখ্যালঘু সমাজের আত্মসমীক্ষা দরকার। এ নিয়ে লিখেছেন সেখ হাফিজুর রহমান।
শিক্ষা মানব জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষাই মানুষের মধ্যে আত্মবোধ, আত্মবিশ্বাস অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়, ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিত বুঝতে শেখায়। যারা শিক্ষিত হয়েছে তারা সকলেই সভ্য, উন্নত ও মর্যাদাসম্পন্ন। কিন্তু, বিবেক, বুদ্ধি, বিজ্ঞতা ও তর্কশক্তি দ্বারা ভূষিত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের মুসলিম সমাজ অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে আছে। যেমন: ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ৪১.৫ মুসলিম একেবারে নিরক্ষর। গ্রাজুয়েট বা তার ঊর্ধ্বে শিক্ষিত মুসলিম মাত্র তিন শতাংশ। ২০১৫–১৬ সালের ষষ্ঠতম অল ইন্ডিয়া সার্ভে অন হায়ার এডুকেশন অনুযায়ী ১১৪০ জন ছাত্র-ছাত্রীরা তালিকাভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে একজন ছাত্র ও মুসলিম ছিল না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৩২৯ জন ছাত্র-ছাত্রী তালিকাভুক্ত হয়েছিল, কিন্তু তারমধ্যে মাত্র ৫০ জন মুসলিম ছিল। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৬,৫২২ জন ছাত্র-ছাত্রীকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, তারমধ্যে মাত্র ২.৩৪ শতাংশ মুসলিম ছিল। নর্থ বেঙ্গল বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিলিগুড়িতে তালিকাভুক্ত মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী মাত্র ২.৬ শতাংশ ছিল। কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যার ইনস্টিটিউটে৭৪০ জনের অ্যাডমিশন হয়েছিল, তারমধ্যে মাত্র আট জন মুসলিম ছিল। উক্ত পরিসংখ্যানগুলি স্পষ্ট করে যে আমরা মূল স্রোত থেকে অনেকটাই দূরে। এছাড়া, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে শিক্ষা লভ্য থাকা সত্ত্বেও মুসলিম ছেলে-মেয়েদের স্কুলছুট হওয়ার সংখ্যা অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, দরিদ্রতার কারণে কলেজে পড়তে পারে না সেটা বুঝতে পারা যায় কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এমনটা তো নয়। বরং এসবের প্রধান কারণ হল, প্রথাগত শিক্ষাকে উপেক্ষা করা, সেকেলে চিন্তাধারা ও নিরুৎসাহজনক পরিবেশ। বর্তমানে অবশ্য মুসলিম সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার জন্য এবং সামাজিক ও আর্থিক উন্নতির জন্য বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য দিয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেকটা উন্নতি হয়েছে।
আমাদের যা দেখানো হয় তাই দেখে থাকি, যা শোনানো হয় তাই বিশ্বাস করে থাক এবং সেই অনুসারে আচরণ করি। আমরা কুয়োর ব্যাঙের মতো বাহিরের জগত দেখতে পাইনা, কারণ চোখ, কান ও বোধশক্তি মহাসন্ন হয়ে আছে। যেখানে স্কুলে যাওয়াটা জরুরি মনে করা হয় না, স্কুলে না গেলে লজ্জিত হতে হয় না, সেখানে শিক্ষায় কৌতূহল থাকলেও ছেলে-মেয়েরা নিরুৎসাহিত হয়, তাই অশিক্ষিত থেকেই যায়। আমাদের মধ্যে অনেকে সোনার বা অন্যান্য বাণিজ্যিক কারণে পরিবার সহ বড় বড় শহরে থেকে থাকেন। তাদের সেই সেখানকার পরিবেশ গ্রাম থেকে একেবারে আলাদা / সেখানে সকলকেই বাচ্চাদেরকে পড়া-শোনা করাতে হয়। তাই স্কুলে না পাঠালে পরিবেশ হিসেবে লজ্জিত হতে হয়। তাদের অনেকেরই ছেলে-মেয়েরা শিক্ষিত এবং উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, প্রফেশনাল হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত। তারা গণ্ডির বাইরে গিয়ে চিন্তা করেছিল বলেই, মানসিকতা সুস্থ প্রশস্ত করেছিল বলেই, প্রথাগত শিক্ষায় বেশি করে আসতে পেরেছে। পক্ষান্তরে গ্রামে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের ঘরের অন্যান্য কাজও করতে হয়। যেমন ছোট ভাই-বোনেদের দেখাশোনা করা, মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করা, বাবার সঙ্গে দোকানে থাকা ইত্যাদি। এই কাজগুলো নিন্দনীয় নয়, বরং প্রশংসনীয়, কিন্তু শিক্ষাকে এড়িয়ে গিয়ে এই বয়সে এইসব কাজে জীবনের মূল্যবান সময়গুলি খরচ করাটাও যুক্তিযুক্ত নয়। তাই প্রয়োজন শিক্ষিত হওয়ার। শিক্ষার উন্নতির জন্য সমাজের মানুষদেরই ভাবতে হবে এবং প্রতিকার বের করতে হবে। সম্ভাব্য প্রতিকার বের করতে হবে। এখানে উল্লেখনীয় যেমন কম্যুনিটি ওয়েলফেয়ার ফান্ড। আমাদের মুসলিম সমাজে অনেক ধনী সম্পদশালী ব্যক্তিগণ আছেন যাঁরা হিতৈষী ও দানি হয়ে থাকেন। যাকাতও নিয়মানুযায়ী দিয়ে থাকেন। বলাবাহুল্য, এই সব সম্মানীয় গুণী মুসলিমগণ যদি যাকাতের কিছু অংশ, সদকা ইত্যাদি এই ফান্ডে জমা দেন। যদি দান হিসেবে দেন স্কুলছুট ছেলে-মেয়েদের জন্য, মেধাবী গরিব ছাত্র-ছাত্রীরা যারা পড়াশোনায় ভালো তাদের পড়াশোনার জন্য তাহলে ওই মুসলিম ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়। ফান্ডের এই টাকা থেকে দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের জন্য বই, খাতা পত্রেরও ব্যবস্থা হওয়া উচিত। এছাড়া, ওই সব বাচ্চাদের জন্য কমন কোচিং ক্লাসেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যেখানে ছুটির দিন যারা শিক্ষিত তাদের সাধ্যমতো শ্রমদান দিলে, গাইড করলে তারা লাভবান হয়। যদি গ্রামে সে রকম কোনো শিক্ষিত ব্যক্তি না থাকে তাহলে অন্য গ্রাম থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান রাখে এমন ব্যক্তিদেরকে অস্থায়ীভাবে নিযুক্ত করা যেতে পারে। অনেকেই তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা ইন্টারেস্ট সুদ মনে করে গ্রহণ করে না। তারা যদি ওই টাকা তুলে ওয়েলফেয়ার ফান্ডে জমা দেয় তাহলে সেই টাকাটা পুণ্যের কাজ বলে গ্রহণযোগ্য হবে। এইরূপ পদক্ষেপের ফলে সমাজে শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, ছেলে-মেয়েরা, মাতা-পিতা সকলেই অনুপ্রাণিত হবে। মূল স্রোতে আসার আমাদের সফর সহজ হয়ে উঠবে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
লেখক ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct