দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ মালয়েশিয়ায় বহুল আলোচিত নির্বাচনের পর আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে ঐক্য সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আনোয়ারের পাকাতান হারাপান জোট ছাড়াও রয়েছে বারিসান ন্যাশনাল ও সারাওয়াকের জিপিএস জোট। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার হিমালয় কন্যাখ্যাত দেশ নেপালে সংসদের পূর্ণ মেয়াদ শেষে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শাসক জোট সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেলেও জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। এ নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ শেষ কিস্তি।
নেপালি কংগ্রেস, সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র), সিপিএন (ইউনিফাইড সোশ্যালিস্ট), পিপলস সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং রাষ্ট্রীয় জনমোর্চার জোটগতভাবে ৫ আগস্ট ২০২২-এ সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বিদ্বতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে ১৫ আগস্ট, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাবুরাম ভট্টরাইয়ের নেতৃত্বে নেপাল সোশ্যালিস্ট পার্টি সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র) এর নির্বাচনী প্রতীক ও ইশতেহারের অধীনে নির্বাচনে প্রতিদ্বিদ্বতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ৯ অক্টোবর পিপলস সোশ্যালিস্ট পার্টি জোট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং জোট সাতটি আসনে লোকতান্ত্রিক সমাজবাদী পার্টিকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এবারের নির্বাচনী ফলাফলের একটি চিত্র স্পষ্ট হওয়ার পর সিপিএন-ইউএমএল চেয়ার এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি গত বৃহস্পতিবার সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র) প্রধান পুষ্প কমল দহলকে টেলিফোন করেছেন এবং প্রস্তাব করেছেন যে তারা যেন একসাথে কাজ করতে পারেন। দুই নেতা ১৫ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে কথা বলেছেন বলে দহলের একজন সহযোগী জানিয়েছেন। দহল নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল না হওয়া পর্যন্ত ওলিকে অপেক্ষা করতে বলেছেন বলে জানা গেছে। ওলি একই সাথে প্রধানমন্ত্রী ও নেপালি কংগ্রেসের সভাপতি শের বাহাদুর দেউবাকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন।একজন মাওবাদী নেতা বলেছেন, ‘যেহেতু আমরা ক্ষমতাসীন জোটের মূল সদস্য, আমরা নির্বাচনের ফলাফল এবং ভবিষ্যৎ পথ নিয়ে প্রথমে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করব এবং তার পরই সিদ্ধান্ত নেবো কোন পথে যেতে হবে।’ অন্য দিকে মাওবাদী কেন্দ্রের দ্বিতীয় স্তরের নেতাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষাকারী একজন ইউএমএল নেতা বলেছেন, ‘আমাদের দল সবার সাথে আলোচনার জন্য উন্মুক্ত। তবে আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হবে নেপালি কংগ্রেস ছাড়া সরকার গঠন করা।’ইউএমএল নেতা উল্লেখ করেন, মাওবাদী কেন্দ্রের দ্বিতীয় স্তরের নেতারা নির্বাচনের ফলাফল দেখে হতবাক হয়েছেন, বিশেষ করে নেপালি কংগ্রেসের সাথে নির্বাচনী অংশীদারিত্ব যে তাদের পক্ষে আসেনি সেটি তারা উপলব্ধি করেছেন। মাওবাদী কেন্দ্র ২০১৭ সালের মূল নির্বাচনে ৩৬টি সংসদীয় আসন জিতেছিল, তারা এইবার মাত্র অর্ধেক সংখ্যায় জয়ী হতে চলেছে। নেপালি কংগ্রেসের সাথে তাদের অংশীদারিত্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেনি। অন্য দিকে, মাধব নেপাল সঙ্কটে পড়েছেন, কারণ তার দল একটি জাতীয় পার্টির মর্যাদার জন্য ন্যূনতম ভোট পেতে লড়াই করছে। এই অবস্থায় নেপালি কংগ্রেস ছাড়াই পরবর্তী সরকার গঠনের নেতৃত্ব দিতে পারবে ইউএমএল।
ইউনিফাইড সোশ্যালিস্টের একজন নেতা বলেছেন যে তার দল ইউএমএলের সাথে কাজ করার পরিবর্তে মাওবাদী কেন্দ্রের সাথে ঐক্য পছন্দ করে। এখন দুই দলের মধ্যে একীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। দুই দল এক হলে পরে ইউএমএলের সাথে ঐক্য সম্ভব হবে। ইউএমএল চেয়ারম্যান ওলি বৃহস্পতিবার ফলাফল নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন এবং দেশে সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। ওলি বলেন, আগে আমরা আশা করেছিলাম যে নির্বাচন সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারসহ স্থিতিশীলতা আনবে, কিন্তু ফলাফলে দেখা যায় কোনো দলই সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। এখন ঘোড়া কেনাবেচার ব্যবসা শুরু হবে। একটি নতুন সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ম্যাজিক সংখ্যা হলো কেন্দ্রে ১৩৮ এবং সংখ্যাটি প্রতিটি প্রাদেশিক পরিষদের জন্য ভিন্ন। তবে এখন পর্যন্ত, নেপালি কংগ্রেস, সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র), সিপিএন (ইউনিফায়েড সোশ্যালিস্ট), রাষ্ট্রীয় জনমোর্চা এবং লোকতান্ত্রিক সমাজবাদী পার্টির ক্ষমতাসীন জোট একটি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন মেরুকরণে এসব দল একই অবস্থানে না-ও থাকতে পারে। সেটি হলে পুরো রাজনৈতিক অবস্থা পাল্টে যেতে পারে। রাজনৈতিক এ পরিবর্তনের সময়ে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোর ভূমিকার পাশাপাশি থাকে বাইরের শক্তির প্রভাব ও কার্যক্রম। নেপালে এ ধরনের প্রভাব বিস্তারে ভারত ও চীনের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। নেপালি কংগ্রেসকে ভারত-বান্ধব আর ইউএমএলকে চীন-বান্ধব দল বলে বিবেচনা করা হয়। স্বাভাবিকভাবে এই দুই দেশ চাইবে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল দলের নেতৃত্বে সরকার গঠন হোক। চীন যদি মাওবাদী ও সোশ্যালিস্ট কমিউনিস্ট পার্টিকে ইউএসএলের সাথে সমঝোতায় রাজি করাতে পারে তাহলে দেশটিতে আবারো চীনপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, কাজটি খুব সহজ নয়। দিল্লি চাইবে না কোনোভাবে এই সমীকরণ কাজ করুক।
(সমাপ্ত...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct