আপনজন ডেস্ক: সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের প্রি-ম্যাট্রিক বৃত্তি ও উচ্চশিক্ষায় গবেষণার ক্ষেত্রে মৌলানা আজাদ জাতীয় ফেলোশিপ নরেন্দ্র মোদি সরকার বন্ধ করে দেওয়ায় তাকে “সংখ্যালঘু-বিরোধী” পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছিলেন ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব থেকে শুরু করে ইউজিসি-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুখদেও থোরাট। এবার রাজ্যসভায় এই বৃত্তি বঞ্চনার বিরুদ্ধে সরব হলেন বিরোধী দলের সাংসদরা। মঙ্গলবার বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য লোকসভায় সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি অবধি প্রি-ম্যাট্রিক বৃত্তি এবং মৌলানা আজাদ ফেলোশিপ পুনরায় চালুর দাবি জানিয়ে বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলি পিছিয়ে থাকলে দেশের কীভাবে অগ্রগতি হবে। মঙ্গলবার এনিয়ে বেশ কয়েকজন মুসলিম সংসদ বৃত্তি ফিরিয়ে আনার দাবি সংসদে তোলেন।অনুদানের সম্পূরক দাবি নিয়ে আলোচনার সময় বিএসপি সাংসদ দানিশ আলী বলেন, প্রি-ম্যাট্রিক স্কলারশিপ এবং মৌলানা আজাদ ফেলোশিপ অবশ্যই পুনরুদ্ধার করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের সমৃদ্ধির জন্য সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। আপনি কীভাবে সংখ্যালঘুদের পিছনে ফেলে উন্নতি করতে পারেন? এআইএমআইএম-এর সাংসদ সৈয়দ ইমতিয়াজ জলিলও এই দাবি উত্থাপন করে বলেন, এই ফেলোশিপ বন্ধ করা হলে সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীরা কীভাবে পড়াশোনা করবে এবং অগ্রগতি করবে। সংখ্যালঘুদের শিক্ষার বিষয়টি উত্থাপন করে সমাজবাদী পার্টির সদস্য এস টি হাসান বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত মৌলানা আজাদ ন্যাশনাল ফেলোশিপের মতো যে বৃত্তিগুলি তারা বাতিল করেছে তা পুনরায় চালু করা। এআইইউডিএফ প্রধান বদরুদ্দিন আজমলও এই বৃত্তি পুনরুদ্ধারের দাবি জানান ও সংখ্যালঘুদের জন্য বাজেট বাড়ানোর আহ্বান জানান। উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি ৮ ডিসেম্বর লোকসভায় বলেছিলেন, মৌলানা আজাদ জাতীয় ফেলোশিপের আওতায় সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীরা থাকায় তা অন্যান্য প্রকল্পগুলির সঙ্গে অসঙ্গতি তৈরি হচ্ছে। উচ্চশিক্ষার জন্য অন্য যেসব বৃত্তি চালু আছে তাতে আবেদন করতে পারবেন সংখ্যালঘুরাও। তাই ২০২২-২৩ বর্ষ থেকে সংখ্যালঘুদের জন্য ফেলোিশপ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে বলে জানান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। অথচ, এমএএনএফ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ফেলোশিপ। এটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দ্বারা স্বীকৃত সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, পার্সি এবং শিখ - ছয়টি বিজ্ঞাপিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা এমফিল এবং পিএইচডি প্রোগ্রামগুলিতে উচ্চশিক্ষার জন্য এই প্রকল্প থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়া যেত। মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ইউএপিএ সরকার সাচার কমিটির ২০০৬ সালের সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় এমএএনএফ চালু করেছিল। ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম ‘আজাদ’-এর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে।
বহু ছাত্র ও শিক্ষাবিদরা বলছেন, এমএএনএফ প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্ত বিজেপি সরকারের ‘সংখ্যালঘু-বিরোধী’ পরিকল্পনার অংশ। একে ‘অন্যায্য’ সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করে তারা বলছেন, এটা মোদি সরকারের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি অবজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চ শিক্ষাকে অগম্য করে তুলবে। মৌলানা আজাদের পরিবারও এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেছে, এটি স্পষ্টতই দেশের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীর অবদানকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য সরকারের অভিপ্রায়কে প্রকাশ করে। মৌলানা আজাদের ভাইয়ের নাতনি হুসনারা সেলিম বলেন, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই সরকার আজাদের ব্যক্তিত্বকে খাটো করার জন্য নিরলসভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, গত বছর ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস-এর একটি অনুষ্ঠানে মৌলানা আজাদের একটি মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়। সেখানে তার পরিবারের দান করা বইগুলি ধুলোয় পড়ে রয়েছে। যদিও মৌলানা আজাদ এই কাউন্সিলেরই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।হুসনারা সেলিম বলেন, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের আকার ধারণকারী এমএএনএফকে পুনরুদ্ধারের জন্য প্রত্যেক নাগরিককে অবশ্যই তাদের আওয়াজ তুলতে হবে। ইউজিসি-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুখদেও থোরাট বলেন, দেশের সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় (প্রতিষ্ঠানগুলিতে) মুসলমানদের সর্বনিম্ন গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও (জিইআর) ১৬%, জাতীয় গড় ২৬.৩% এর তুলনায় কম। তিনি আরও বলেন, যদি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ফেলোশিপ কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে তারা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব বলেন, এটা শুধু মৌলানা আজাদের অপমান নয়, সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীকে একইভাবে অবজ্ঞাও করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক যে সরকার মৌলানা আজাদের নামানুসারে যে ফেলোশিপের নামকরণ করা হয়েছিল তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কেন্দ্র। যিনি ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন এবং যার শাসনামলে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (খড়গপুর), সঙ্গীত নাটক আকাদেমি সহ বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছিল।লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুরজ বাহাদুর থাপা বলেন, দুর্ভাগ্যবশত, অসঙ্গতিগুলি সংশোধন করার পরিবর্তে, তারা বৃত্তিটি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, কেন সরকার ওভারল্যাপিংয়ের সমস্যাগুলি এড়াতে শিক্ষার্থীদের তাদের আধার নম্বর দিয়ে ফেলোশিপের জন্য আবেদন করার জন্য নিবন্ধিত করে না। দিল্লি ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি নন্দিতা নারায়ণ বলেন, সরকার এমন এক সময়ে এমএএনএফ প্রত্যাহার করছে যখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এতে শাসকদলের ‘শিক্ষা-বিরোধী’ ও ‘মুসলিম-বিরোধী’ মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এই সিদ্ধান্তের ফলে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং শিখ শিক্ষার্থীদের উপর প্রভাব পড়বে যারা বিভিন্ন রাজ্যে অন্যান্য অনগ্রসর জাতি (ওবিসি) হিসাবে বিবেচিত হয় না। অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এন সাই বালাজি বলেন, ভারতীয় জনতা পার্টি সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে ফেলোশিপ বন্ধ করা শুরু করেছে কারণ বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেউ তাদের পক্ষে কথা বলবে না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct