ব্যর্থ মরুদ্যান
তাপস কুমার বর
জীবনের পরিণতি একটা বিচ্ছিন্নতার অন্ধকারাগারে জোয়ার-ভাটার মতো কখনো উন্থান কখনো পতন। আজ কোথায় দীপেশ? একটা মরুভূমির মরুদ্যানে সে হারিয়ে গেছে,......“বিবেক দহন কেন মেটেনা,তাকে শান্তনা দিতে দিতে দীপেশ আজ ক্লান্ত!”সেদিন সেই দীপেশ আজ পাগলা গারদে পাগলের মতো চিৎকার করে বলছে,.....“মৃন্ময়ী তুমি দীপেশ কে জ্বালিয়েছো,পুড়িয়েছো, ভাবনার আকাশে কখনো তুমি কি তাকে একবার ডেকেছো?”দীপেশ কৃষক পরিবারের সন্তান। বাবা একজন ভাগ চাষী। তাদের বাড়িটা তালপাতার ছাউনি দিয়ে ঘেরা। দীপেশের মা বলে,......“কৈ গো দীপেশের বাপ।বর্ষাকাল এসে যাচ্ছে। বাড়িটা তো সারাই করতে হবে। না হলে গাছতলায় গিয়ে থাকতে হবে”!দীপেশ তাদের আর্থিক পরিস্থিতির কথা জেনে কলেজ পাস করে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। তাদের গ্রামে মৃন্ময়ীদের ধানের গোডাউনে হিসাবপত্রের কাজ করে। কিন্তু কখন যে মালিক রতন ব্যানার্জীর মেয়ে মৃন্ময়ী দীপেশ কে ভালোবেসে ফেলেছে,দীপেশ জানতে পারেনি। দীপেশ প্রথমে তাদের বাড়িটা সারাতে চায়। তাই সে দিন-রাত পরিশ্রম করে চলছে। একদিন কাজ থেকে সাইকেল করে দীপেশ বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ স্কুলের কিছুটা দূরে মৃন্ময়ীর সঙ্গে দেখা। মৃন্ময়ী দীপেশকে বললো,.....“বাবা আপনাকে আজ আমাদের বাড়িতে দেখা করতে বলেছে”!দীপেশ মাথা নেড়ে বললো, মালিকের সঙ্গে দেখা হলো,মালিক তো কিছু বললো না আমাকে! মৃন্ময়ী বললো কিছু বঝবেন না! এই কথা বলে সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে গেলো। দীপেশ সেদিন মৃন্ময়ীর চোখে একটা স্নেহের দৃষ্টি দেখেছিল “যা বোঝানো যায় না”। এই ভাবে এক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর মৃন্ময়ী প্রায় সময় দীপেশদের বাড়িতে আসা যাওয়া শুরু করলো। দীপেশ ও মৃন্ময়ীকে কখন যে চুপিচুপি ভালোবেসে ফেলেছে সে জানাতে পারেনি। কিন্তু দুজন কেউ কাউকে বলতে পারছে না,......“সেদিন রাস্তার মধ্যিখানে দুজন দাঁড়িয়ে। একটা নীরবতা। মুখের ভাষা জড়িয়ে যাচ্ছে দুজনের।”মৃন্ময়ী বললো, জানো দীপেশ তোমায় অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। দীপেশ বললো তোমার বাবা কত বড়োলোক। আমি সামান্য একজন ভাগ চাষীর ছেলে,এটা কখনো তোমার বাবা মেনে নেবে না। সেদিন মৃন্ময়ী চিৎকার করে বলেছিল,......“আমি বাবাকে বোঝাবো! তুমি কত ভালো।”দীপেশ সেদিন একটা কথা বলেছিল, মৃন্ময়ী তুমি জানো না বর্তমান সমাজ “টাকার গোলাম” টাকা ছাড়া ভালোবাসার কোন মূল্য নেই এই সমাজের বুকে। যদি বাবা মা-রা এই ভালোবাসার কথাশুনে দুই পক্ষ মেনে নেয়,....
“তার থেকে সুখ আর কখনো হতে পারেনা মৃন্ময়ী”!সেদিন মৃন্ময়ী আর কিছু বলেনি। পরে এই কথা জানাজানি হতে মৃন্ময়ীর বাবা একদিন দীপেশকে ডেকে অনেক অপমান করেছিল! বললো আর কখনো যদি আমার মেয়ের সঙ্গে দেখি, তাহলে এই গ্রাম থেকে বিচার দিয়ে গ্রাম ছাড়া করবো! আর সেদিন মালিক রতন ব্যানার্জী দীপেশের সব হিসাব পত্র চুকিয়ে দিয়ে দীপেশকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। সেদিন মৃন্ময়ী বাবার সামনে একটাও কথা বলেনি;নীরব থেকেছে। পরদিন মৃন্ময়ী লুকিয়ে দীপেশদের বাড়িতে যায়। দীপেশ মৃন্ময়ীকে বাধা দেয়,......“আর কখনো এসো না এই বাড়িতে, এই বাড়ির দরিদ্রতা তোমার জন্য নয়।”সেদিন মৃন্ময়ী কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে বাবা কে অনেক বুঝিয়ে বলে “বাবা দীপেশ অনেক ভালো ছেলে, ওকে মেনে নাও”। রতন ব্যানার্জী মেয়ের এই কথাশুনে তিনি রাগে ফুঁসছেন।পরদিন গ্রামের লোক নিয়ে গিয়ে দীপেশকে মিথ্যা ধানের গোডাউনে পঞ্চাশ হাজার টাকা চুরির অপবাদ দিয়ে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়।সেদিন দীপেশের বাবা ও মা রতন ব্যানার্জীর পায়ে ধরে অনেক অনুনয় করলো কিন্তু কিছু লাভ হলো না। চিৎকার করে দীপেশের মা বলছে,......“বাবু আমার ছেলেটা চোর নয়! আপনার গোডাউনে এতো দিন কাজ করলো,তখন কিছু হলো না। আজ আপনার মেয়ের জন্য মিথ্যা চুরির অপবাদ দিলেন”!গর্জে উঠলো রতন ব্যানার্জী। সেদিন চোখের সামনে দীপেশদের বাড়িটা ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল। বিক্ষুব্ধ দীপেশ রেগে গিয়ে রতন ব্যানার্জীকে সাটিয়ে গালে একটা চড় মেরেছিল। সেদিন প্রচন্ড হইচল হলো। কিন্তু সত্য চাপা পড়ে গেলো। টাকাই সত্যকে ও হার মানায়। কাঁদতে কাঁদতে দীপেশ জেলে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে তার উপর অকথ্য অত্যাচার করা হতো, মা ও বাবার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হতো না। আজ সেই দীপেশ আজও জেলে বন্দি।আর মৃন্ময়ী আসেনা,.......“এখন মূল্য কমে গেছে। সে একজন আসামী বলে। কিন্তু আসামী তো দীপেশ মৃন্ময়ীর জন্য হয়েছে”! দীপেশ আজ অন্ধকারাগারে বন্দি হয়ে “মা ও বাবাকে খোঁজে”। বাবা তোমরা কেমন আছো?মা তুমি খেয়েছো? এই প্রশ্নগুলো বার বার দীপেশের বিবেক দংশন করে চলেছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct