পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে একটু দেরিই হয়েছিল মুসলমানদের। সংবাদপত্র যে ভাবপ্রকাশের অন্যতম প্লাটফর্ম, সেটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল তাঁদের। ধর্মীয়বোধ হয়তো এই বুঝে উঠতে না পারার একটা অন্যতম কারণ। এই বিষয় নিয়েই আলোকপাত করেছেন- রমজান আলি.....
পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে একটু দেরিই হয়েছিল মুসলমানদের। সংবাদপত্র যে ভাবপ্রকাশের অন্যতম প্লাটফর্ম, সেটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল তাঁদের। ধর্মীয়বোধ হয়তো এই বুঝে উঠতে না পারার একটা অন্যতম কারণ। উত্তর ভারতে স্যার সৈয়দ আহমদ এবং বাংলাদেশে নবাব আবদুল লতিফের নেতৃত্বে ইংরেজ শাসন ও আধুনিকতার সঙ্গে আপোস মীমাংসার একটা প্রচেষ্টা শুরু হয়। শেখ আলীমুল্লাহ ১৮৩১ সালে যখন ‘সমাচার সভারাজেন্দ্র’ নামের পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করলেন সেই বছরই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘সম্বাদপ্রভাকর’ বের করেছেন। সরকারি ভাষা বদলের আঘাতটা কাটাতে মুসলমানদের সময় লাগলো বঙ্গদর্শন প্রকাশের দুবছর পর্যন্ত। পাক্ষিক ‘আজীজন নেহার’ নিয়ে মশাররফ হোসেন সম্পাদকের ভূমিকায় এলেন ১৮৭৪ সালে। সেই বছরই বের হল আনিছউদ্দীনের সম্পাদনায় ‘পারিল বাত্তাবহ’। পাঠকের অভাব থেকে অর্থনীতি ইত্যাদি নানাকারণে সফলতার মুখ দেখেনি বঙ্গদর্শন সমকালীন এই দুই পত্রিকা। ‘সাহিত্যসাধক চরিতমালা’য় ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন – “বঙ্গদর্শনের আবির্ভাব একটা সামান্য সাময়িক ঘটনামাত্র নয়, বাংলা সাহিত্যের পরবর্তী সমস্ত ইতিহাসই এই একটি ঘটনার দ্বারা প্রভাবাহিত হইয়াছে। প্রবন্ধ সমালোচনা যে কতগুলি সংবাদ ও তথ্যের সমষ্টিমাত্র নয়; সেগুলিও যে নানা বিচিত্র রসসংযোগে জ্ঞানবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আনন্দেরও খোরাক যোগাইতে পারে, বঙ্গদর্শনেই সেই সত্য সর্বপ্রথম প্রচারিত হইল।” বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত ও প্রতিষ্ঠিত এই পত্রিকাটি ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে প্রচ্ছন্নভাবে হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে বিশেষ কোন ধর্মীয় গোষ্টীর প্রভাবমুক্ত হয়ে সাহিত্যভাবনাকেই এই পত্রিকা বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১২৭৯ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ মাসে, ইংরাজি ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে। আরও দুটি পর্যায়ে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল । দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রকাশ ছিল অনিয়মিত এই প্রকাশ যথাক্রমে- ১২৮৪, বৈশাখ – ১২৮৫ চৈত্র, ১২৮৭ বৈশাখ, ১২৮৮ আশ্বিন, ১২৮৯ বৈশাখ ১২৮৯ চৈত্র, ১২৯০ কার্ত্তিক – ১২৯০ মাঘ । তৃতীয় পর্যায়ে প্রকাশ কাল ১৩০৯ বৈশাখ ১৩১২ চৈত্র। দ্বিতীয় পর্যায়ের সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অবশ্য এই সময় শ্রীশচন্দ্র কিছুটা সময় পত্রিকা সম্পাদনার ভার নিয়েছিলেন। তৃতীয় পর্যায়ে ‘নব পর্যায় বঙ্গদর্শন’ নাম দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীর্ঘ চার বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। স্মরণ করা যেতে পারে, এই পত্রিকাতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছিলেন। মোহিতলাল মজুমদারও সম্পাদনার দায়ভার গ্রহণ করেছিলেন। সত্যজিৎ চৌধুরির সম্পাদনায় সাম্প্রতিককালে নৈহাটি থেকে ‘বঙ্গদর্শন’ শিরোনামে একটি পত্রিকা (ত্রৈমাসিক) প্রকাশিত হচ্ছে।
পত্রিকাটি প্রকাশের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য কাজ করেছিল ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভারতীয় ধর্ম সংস্কারের ওপর থেকে যখন সমস্ত প্রকার বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার পক্ষে মতামত জ্ঞাপন করল তারপর থেকেই প্রকৃতপক্ষে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলন শুরু হয়। ভারতীয় হিন্দু ঐতিহ্যে যা কিছু উন্নত ভাবনার প্রকাশক এবং যা মানুষকে স্বাদেশিকতায় উন্মত্ত করতে পারে তার উপর বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা প্রকাশ করলেন। বঙ্গদর্শনের পত্র সূচনায় পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র জানিয়েছেন – “এই পত্র আমরা কৃতবিদ্য সম্প্রদায়ের হস্তে, আরও এই কামনায় সমর্পণ করিলাম যে, তাঁহারা ইহাকে আপনাদিগের বার্তাবহ স্বরূপ ব্যবহার করুন। বাঙ্গালী সমাজে ইহা তাঁহাদিগের বিদ্যা, কল্পনা, লিপি কৌশল এবং চিতোৎকর্ষের পরিচয় দিক। তাহাদিগের উক্তি বহন করিয়া ইহা বঙ্গমধ্যে জ্ঞানের প্রচার করুক।” বঙ্গদর্শন পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষা চর্চা বৃদ্ধি। এ প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র জানিয়েছেন – “যতদিন না সুশিক্ষিত জ্ঞানবন্ত বাঙ্গ ালীর বাঙ্গালা ভাষায় আপন উক্তি সকল বিন্যস্ত করিবেন, ততদিন বাঙ্গালীর উন্নতির কোন সম্ভাবনা নাই।” এই উদ্দেশ্যে তিনি বঙ্গদর্শনের পরিকল্পনা করেছিলেন। বঙ্গদর্শন পত্রিকার আর একটি উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষিত শ্রেণির মধ্য দিয়ে অশিক্ষিত শ্রেণিকে আলোকিত করা। কারণ বঙ্কিমচন্দ্র দেখেছিলেন তৎকালীন সমাজে ‘আমাদের ভিতরে উচ্চশ্রেণি এবং নিম্নশ্রেণির লোকের মধ্যে পরস্পর সহৃদয়তা কিছুমাত্র নেই।’ সন্দেহ নেই যে বঙ্কিমচন্দ্র পাঠোপযোগী করে পত্রিকাটিকে সাজিয়েছিলেন। তাই এই পত্রিকায় একই সঙ্গে উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, রসরচনা, সমালোচনা ইত্যাদিকে জায়গা দেয়। পত্রিকার অধিকাংশ লেখকেরই আদর্শ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। এই পত্রিকার লেখক গোষ্ঠির অন্যতম ছিলেন সম্পাদক বঙ্কিমচন্দর নিজে। সঙ্গে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রশেখর মুখার্জী, রামদাস সেন, চন্দ্রনাথ বসু, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ প্রতিভাধর লেখকেরা। বঙ্কিমচন্দ্রের অধিকাংশ লেখাই প্রকাশিত হয়েছিল এই পত্রিকার পাতায়। উপন্যাসের দিক থেকে বিষবৃক্ষ, ইন্দিরা, চন্দ্রশেখর উপন্যাসের নাম বলা যায়। পাঠকদের মনোরঞ্জনের জন্য এবং বৈচিত্র্যের জন্য আপাতলঘু ব্যঙ্গাত্মক রচনা হিসাবে এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় – ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ এবং ‘লোকরহস্য’-এর মতো প্রবন্ধগুলি। কমলাকান্তের দপ্তরে বঙ্কিমচন্দ্র দার্শনিক অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। এই পত্রিকা না বের হলে হয়তো কমলাকান্তের দপ্তর-এর মত রচনার রস উপভোগ করা যেতো না। বঙ্কিমচন্দ্রের লোকরহস্য, বিজ্ঞান রহস্যের মতো সিরিয়াস্ রচনাগুলিও এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
সঞ্জীবচন্দ্রের সম্পাদনাকালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর নিজের লেখা ‘জাল প্রতাপচন্দ্ৰ’ উপন্যাসটি। যেটি বর্ধমানের রাজবংশের এক ট্রাজিক-সন্তান প্রতাপচন্দ্রকে নিয়ে লেখা। তাকে জাল প্রমাণিত করার চক্রান্তে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের লোকেরাও জড়িয়ে পড়েন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘ব্রাহ্মণ ও শ্রমণ’ এখানেই প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনাকালে তাঁর নিজের লেখা ‘মাল্যদান’, ‘শিক্ষা সমস্যা’; অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শিল্পে ত্রিমূর্তি’; রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ‘মহাকাব্যের লক্ষণ’; অক্ষয়কুমার মৈত্রের ‘রাজতরঙ্গিনী’; দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘বিবাহ যাত্রী’ ইত্যাদি প্রকাশের মুখ দেখে। মোহিতলালের সম্পাদনাকালে শরদিন্দু-জগদীশ-বিভূতিভূষণ-সতীনাথের গল্প মুদ্রিত হয়েছিল। ঢিলেঢালা সম্পাদনা এবং নিয়মিত প্রকাশিত না হওয়া অমনযোগ ইত্যাদি নানা কারণে বঙ্গদর্শনের প্রকাশ যে বন্ধ হয়ে যাবে সেটা বেঁচে থাকতে থাকতেই বঙ্কিমচন্দ্র আশঙ্কা করেছিলেন। তবুও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সংবাদ-সাময়িক পত্র হিসাবে বঙ্গদর্শনের গুরুত্ব সর্বাধিক। পত্রিকাটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে জানিয়েছেন – ‘বঙ্কিমের বঙ্গদর্শন আসিয়া বাঙালির হৃদয় একেবারে লুট করিয়া লইল।’ বঙ্কিমের কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন – “বঙ্গদর্শন যেন তখন আষাঢ়ের প্রথম বর্ষার মত ‘সমাগতো রাজবদুন্নত ধ্বনিঃ’ এবং মুষলধারে ভাববর্ষণে বঙ্গসাহিত্যের পূর্ববাহিনী পশ্চিমবাহিনী সমস্ত নদী নির্ঝরিণী অকস্মাৎ পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়া যৌবনের আসন্নবেগে ধাবিত হইতে লাগিল।” উল্লেখ্য যে, এই পত্রিকার জন্যই বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যগুরু হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। দেড়শ বছর পুর্তিকালে নানা কারণে পত্রিকাটি নিয়ে চর্চা হচ্ছে ও আগামীতে হবে। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্যের চর্চা শুরু করে জাতীয়তাবোধে সাড়া দিয়ে। তবে সে জাতীয়তাবোধ কতটা উদার তা নিয়েও প্রশ্ন থেকেই গেছে। তবে সাহিত্য ও সমকালীন সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি এই পত্রিকায় পদার্থ বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিল। আপাত লঘু ব্যঙ্গাত্মকরীতি প্রবন্ধের প্রকাশ, বঙ্গদর্শন এর মাধ্যমেই হয়। ইংরাজি ‘ফেমেলিয়ার’ পত্রিকার মতো এই পত্রিকায় প্রথম ব্যক্তিগত প্রবন্ধের সূচনা হয়। স্বদেশ ভাবনার জাগরণে এই পত্রিকা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। সোমপ্রকাশ, আর্যদর্শন, নবজীবন, বান্ধব ইত্যাদি সংবাদ সাময়িক পত্রিকা বঙ্গদর্শনকে আদর্শ করে কয়েকটি পত্র-পত্রিকা আবির্ভূত হয়েছিল। বঙ্গদর্শনেই প্রথম যথাযথ সাহিত্য-সমালোচনার সুপ্রকাশ ঘটে। পত্রিকাটিতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণাঙ্গ উচ্চমানের সাহিত্য পত্রিকা, সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে একটি আদর্শ মানদণ্ড বেঁধে দিতে পেরেছিলেন। যা পরবর্তী বাংলা উপন্যাস ও প্রবন্ধের ক্ষেত্রে মান্যরূপ লাভ করতে পেরেছিল। এই পত্রিকাটির বাংলা ভাষা চর্চা প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। ইউরোপীয়দের ধারণাকে নস্যাৎ করার জন্যই বঙ্কিমচন্দ্র দেখাতে চেয়েছিলেন যে, বাঙালিরা ‘বিদ্যা বুদ্ধি হীন’ ও ‘লিপি কৌশল শূন্য’ নয় এবং এই সূত্রে একটি বাঙালি লেখক গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছিল। এই পত্রিকায় উচ্চশিক্ষিত এবং অশিক্ষিতের সামাজিক বৈষম্য দূর করতে সচেতন প্রচেষ্টা চালায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct