মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লি যাত্রাকে কেন্দ্র করে কেন্দ্র রাজ্যের সম্পর্কের বিষয়টি আবারও আলোচনার কেন্দ্রে এসে পড়েছে। এসে পড়েছে রাজনীতির অনুমান অনুযোগ। তবে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের সুসম্পর্ক থাকা দরকার। দরকার দেশের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতি ও মানুষের উন্নয়নের জন্য। কেন্দ্র ও রাজ্যের মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া রাষ্ট্র নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু রাজ্য দুর্বল থাকলে কেন্দ্রের শক্তিশালী হওয়ার উপায় আছে কি? প্রশ্নটা আজকের নয়, অতীতের। এ নিয়ে লিখেছেন কাজী খায়রুল আনাম। আজ শেষ কিস্তি।
ভারতবর্ষে এখনও রাষ্ট্রভাষা বলে কিছু নেই। সরকারি ভাষা হিসেবে হিন্দি –ইংরেজিকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। হিন্দী প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে বহুবার কিন্তু রাজ্য সরকার গুলির তীব্র বিরোধিতায় পিছু হঠেছে কেন্দ্র। এছাড়াও কেন্দ্রীয় বরাদ্দ, অসম শুল্ক নীতি, শিল্পে লাইসেন্স প্রথা, আর্থিক সাহায্য বা ওভারড্রাফ্ট নীতিতে অসাম্য- যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নামে এমন কেন্দ্রীয় প্রবণতা একটা সময় দাপটের সঙ্গেই ছিল। তবে এখন তা কার্যত অতীত মাত্র। শুধু তাই নয়, কাজের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, খাদ্যের অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, তথ্যের অধিকারের জন্য লড়াইয়ের দিনও অতীত। প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি, নরসীমা রাও, অটল বিহারী বাজপেয়ী, মনমোহন সিং য়ের জমানায় এমন বহু কেন্দ্রীয় নীতির সরলীকরণের কারণে সম্পর্ক হয়ে ওঠে সহযোগী দাদার। স্বভাবতই বর্তমানে কেন্দ্রীয় নীতির বিরুদ্ধে গঠনগত আন্দোলনের কোনও সুযোগ নেই বললেই চলে। জিএসটি অবশ্য রাজ্য গুলির নয়া হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু কোনও রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী বক্তব্য সেভাবে শোনা যায় নি। কংগ্রেস দলগত ভাবে জিএসটির পদ্ধতিগত ও প্রয়োগবিধির রাজনৈতিক বিরোধীতা করলেও, কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলি তেমনভাবে উচ্চ বাচ্য করে নি।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবিতে কেন্দ্র - রাজ্য সম্পর্ক খতিয়ে দেখতে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিত সিং সারকারিয়ার নেতৃত্ব একটি কমিশন গঠন (১৯৮৩) করেন। সারকারিয়া কমিশন কেন্দ্র - রাজ্য সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা হিসাবে রাজ্যপাল ও ৩৫৬ ধারা কে চিহ্নিত করলেও সেই বাধাকে অতিক্রম করতে পারেনি কোনও সরকারই। ফলে, রাজনীতির জায়গাটা পুরোমাত্রায় পুরনো জায়গায় থেকে গেছে। প্রসঙ্গত, মোরাটোরিয়ামের জন্য টিএমসি মনমোহন সরকারের ওপর হতে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেও অথবা টিডিপি আর্থিক প্যাকেজের দাবিতে এন ডিএয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও উভয় সরকারই রাজ্য সরকারগুলির পাশে দাঁড়াতে পারেনি। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের দাদাগিরি নয়, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বৃহত্তর সীমাবদ্ধতার কথা স্মরণ রাখতে হবে। শুধু যে কেন্দ্রের দাদাগিরিই স্বাধীন ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে লেখা থাকবে তা নয়, কেন্দ্রও রাজ্য গুলির অযথা রাজনীতির শিকার হয়েছে বারবার। বাংলার বামফ্রন্ট কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছিল। বস্তুত, কম্পিউটার - তথ্য প্রযুক্তি, ডাঙ্কেল প্রস্তাব - গ্যাটচুক্তি বা উদার অর্থনীতির বিরুদ্ধে বাম আন্দোলন অবিস্মরণীয়। অবশ্য দলীয় রাজনীতির সঙ্গে রাজ্য সরকারের ভূমিকা গুলিয়ে ফেললে চলবে না। যদিও বামেদের বিরুদ্ধে সরকারী প্রশ্রয়ে ধর্মঘট-বনধ ইত্যাদি সফল করার মতো অভিযোগ আজও শোনাযায়। বাংলার বামফ্রন্ট সরকারের কেন্দ্র বিরোধী জিগিরের সঙ্গে অন্য রাজ্যের কেন্দ্র বিরোধী আন্দোলনকে মেলানো কঠিন। অবশ্য, বামফ্রন্ট সরকারেরই মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অটল বিহারী বা মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধে কোনও রকম সংঘাতে যাননি। পূর্বসূরীর অসভ্য-বর্বর শব্দবন্ধ তাঁর মুখে শোনা যায় নি। প্রসঙ্গত, ছিয়াত্তর বছরে গণতন্ত্রের নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলেছে ভারতবর্ষ। তবু, সংঘাতের ‘রাজনৈতিক দশা’ অতিক্রম করে উন্নয়নের ‘সহাবস্থান দশা’ প্রয়োজন। প্রয়োজন আরও নিবিড়ভাবে। এব্যাপারে বড়োর দায় স্বীকার করে এগিয়ে আসতে হবে কেন্দ্রীয় সরকার কে। ভুলে গেলে চলবে না, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক কখনোই অধীনতামূলক মিত্রতার নয়। কেন্দ্র এবং রাজ্যের সম্মিলিত উদ্যোগ ভিন্ন সার্বিক ‘ জন উন্নয়ন ‘ একেবারেই অসম্ভব। কোনও সম্ভব এর অবতারের পক্ষেও তা সম্ভব নয়। কারণ ‘চুটিয়ে রাজনীতি’ করা এক জিনিস আর ‘গুছিয়ে উন্নয়ন’ করাটা অন্য জিনিস। কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত নয় দরকার সহাবস্থান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্র - রাজ্যের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার কাজে সফল হলে বাংলার মঙ্গল। বাংলার সাফল্য। (সমাপ্ত...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct