মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লি যাত্রাকে কেন্দ্র করে কেন্দ্র রাজ্যের সম্পর্কের বিষয়টি আবারও আলোচনার কেন্দ্রে এসে পড়েছে। এসে পড়েছে রাজনীতির অনুমান অনুযোগ। তবে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের সুসম্পর্ক থাকা দরকার। দরকার দেশের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতি ও মানুষের উন্নয়নের জন্য। কেন্দ্র ও রাজ্যের মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া রাষ্ট্র নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু রাজ্য দুর্বল থাকলে কেন্দ্রের শক্তিশালী হওয়ার উপায় আছে কি? প্রশ্নটা আজকের নয়, অতীতের। এ নিয়ে লিখেছেন কাজী খায়রুল আনাম। আজ প্রথম কিস্তি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লি যাত্রাকে কেন্দ্র করে কেন্দ্র রাজ্যের সম্পর্কের বিষয়টি আবারও আলোচনার কেন্দ্রে এসে পড়েছে। এসে পড়েছে রাজনীতির অনুমান অনুযোগ। তবে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের সুসম্পর্ক থাকা দরকার। দরকার দেশের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতি ও মানুষের উন্নয়নের জন্য। কেন্দ্র ও রাজ্যের মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া রাষ্ট্র নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। শক্তিশালী কেন্দ্র অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু রাজ্য দুর্বল থাকলে কেন্দ্রের শক্তিশালী হওয়ার উপায় আছে কি? প্রশ্নটা আজকের নয়, অতীতের। ভারতবর্ষের সংবিধানে কেন্দ্রীকতার ঝোঁক সুস্পষ্ট। শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য তা অপরিহার্য জ্ঞান করেছিল সংবিধান সভা। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে তারপরও কেন্দ্র – রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের জন্য, বিশেষত রাজ্যের অধিক ক্ষমতার পুনর্বিবেচনার জন্য বহু কমিশন গঠিত হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্যের বিমাতৃসুলভ আচরণ অভিযোগের ঘাটতি হয়নি কোনোদিন। পণ্ডিত নেহরু কেন্দ্র–রাজ্যের মধ্যে যে সহযোগিতার বাতাবরণ তৈরি করেছিলেন, তা তাঁর মৃত্যুর অল্প কাল পরই ভূলুন্ঠিত হতে শুরু করে। পণ্ডিতজির সতেরো বছরের দীর্ঘ শাসনে অবশ্য কেরালা বাদে আর কোথাও বিরোধী দলের সরকার গঠিত হয়নি। বিভিন্ন রাজ্যে বিরোধী সরকার গঠিত হয় তাঁর মৃত্যুর তিন বছর ( ১৯৬৭) পরে। পরমত অসহিষ্ণুতার রাজনীতি যেমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তেমনি ‘ক্ষমতার অভ্যাস ‘ প্রকট হতে শুরু করে। তবে রাজ্যের বঞ্চনার স্লোগান যে সব সময় বাস্তব নির্ভর ছিল তা নয়। কেন্দ্র বিরোধীতা অনেক সময় হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক মূলধন।
বিবিধ কারণে কেন্দ্র বিরোধীতার আওয়াজ উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। (এক) পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দেশদ্রোহী আন্দোলন (দুই) স্বতন্ত্র রাজ্য গঠনের দাবি (তিন) আঞ্চলিক স্বার্থ পূরণের লক্ষ্য (চার) আর্থিক বঞ্চনার দাবি আদায় (পাঁচ) কেন্দ্রে বিরোধী সরকার থাকার কারণ, ইত্যাদি। স্বাধীন ভারতবর্ষ জন্মগত বিচ্ছিন্নতা সঙ্গী করেই গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করেছিল। পঞ্জাব, জম্মু ও কাশ্মীর শুধু নয় , মিজোরামের মতো ক্ষুদ্র রাজ্যেও রাষ্ট্র বিরোধী স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন হয়েছে । পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন এখনও আছে। ভাষা, নদীর জল, অন্য রাজ্যের শ্রমিক বিরোধীতা প্রভৃতি কে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক স্বার্থে আন্দোলন হয়ে থাকে । আর্থিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের মতো পণ্ডিত নেহরুর ঘনিষ্ঠ মানুষও। তবে বাম বাংলার কেন্দ্র বিরোধী লড়াইকে জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সংগ্রামে বদলে দিয়েছিল। এই ইস্যুতে বাংলার রেকর্ড আজও কোনও রাজ্য ভাঙতে পারেনি। চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গে সারা দেশে একই সাথে বিধান সভা নির্বাচনে (১৯৬৭) শাসক কংগ্রেস বাংলা সহ এগারোটি রাজ্যে ক্ষমতা চ্যুত হয়। রাজ্যের বিরোধী অকংগ্রেসী শাসক শক্তি গুলি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সেভাবে উচ্চবাচ্য করার ‘ রাজনৈতিক সাহস’ দেখাতেই পারেনি । কারণ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার রাজনৈতিক উপস্থিতির সম্মুখে কোনও বিকল্প মুখ ছিল না । মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী সি এন আন্নাদুরাই বা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো নেতারা আঞ্চলিক রাজনীতির বাইরে বেরোতে পারেননি। জরুরি অবস্থা পরবর্তী নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক জনসমর্থনে সরকার গঠন করে বামফ্রন্ট। কেন্দ্রে পুনরায় ফিরে আসেন ইন্দিরা। তাঁর প্রত্যাবর্তনের বছর দুয়েক পরে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় ফিরে আসার পর বামফ্রন্ট কেন্দ্র বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আজকে অবশ্য কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের শাসক দলের নির্বাচনের মরসুমে যতই আক্রমণ প্রতি আক্রমণ হোক, কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের তেমন কোনও সংঘাত নেই। ইন্দিরা গান্ধির সরকারের জরুরি অবস্থা জারি কে একটা ব্যতিক্রম ঘটনা বলে মনে করা হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের অনৈতিক ক্ষমতার দাপট দেখানোর বহু নজির রয়েছে। এবং তা শুধু আজকের নয়, অতীতেরও। যদিও নাগাল্যাণ্ড, মিজোরাম, মনিপুর প্রভৃতি জাতি ভিত্তিক রাজ্য গঠন কেন্দ্রীয় সরকারের দাদাগিরির নজির বলে মনে করা হয়। ঘটনা হল, অখিল ভারতীয় জন সংঘের নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী পণ্ডিত নেহরুর সরকারের কাছে এর বিরোধীতা করে প্রতিবাদ জানান। এবং নিজে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রধানমন্ত্রী হয়ে আদিবাসীদের জন্য পৃথক রাজ্য (ঝাড়খণ্ড) বানিয়ে দেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct