প্রতিবন্ধীদের নিয়ে ভাবনার বিষয়টি ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’ নামে গৃহীত হয়। এবারের থিম ‘সব ধরনের প্রতিবন্ধী দৃশ্যমান নয়’। বিশ্ব জুড়ে না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু উন্নত দেশে প্রতিবন্ধীদের সম্বন্ধে পজিটিভ ধারণা বেড়েছে। এদের বিষয়ে জানাশোনা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যই এখন আমরা বলি, প্রতিবন্ধীরা ভিন্ন; কিন্তু আলাদা নয়। এজন্যই সব ধরনের প্রতিবন্ধীদের আর আলাদা স্কুলে যেতে হয় না; সবার সঙ্গে একই স্কুলে পড়াশোনা করে এবং কাজে-কর্মে এদের সমান মর্যাদায় ভাবা হয়। সুতরাং, প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে বিশদভাবে জানা ও ধারণা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত গবেষণা, বই-পুস্তক ও প্রচার-প্রচারণা। এ নিয়ে লিখেছেন নির্মল সরকার।
জকাল মানুষের নিজ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস, ঘটনা, দিন, অধিকার, মানবিক দিক, অন্যান্য জীব, প্রাণী, পরিবেশসহ অনেক দিকেই সচেতনতা বেড়েছে। এসব বিষয়ের অনেকগুলোই বিশ্বভাবনায় স্থান করে নিয়েছে। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে ভাবনার বিষয়টি ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’ নামে গৃহীত হয়। এবারের থিম ‘সব ধরনের প্রতিবন্ধী দৃশ্যমান নয়’। আমরা জানি, প্রতিবন্ধিতা একই প্রকারের, ধরনের নয়; ভিন্ন ভিন্ন রূপে বা ফর্মে দৃশ্যমান হয়। বৃহৎ অর্থে এই ধরনগুলো শারীরিক, মানসিক ও ডেভেলপমেন্টাল। অনেকে সংবেদন এবং আবেগসংশ্লিষ্ট প্রতিবন্ধী। তাই এবারের থিমে ফোকাস করা হয়েছে—অদৃশ্য হলেও এরাও প্রতিবন্ধী এবং এদের প্রতিবন্ধিতার ধরনও বিবেচ্য। এদের প্রতিও সমান ফোকাস হওয়া উচিত। কিন্তু প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধিতার বিষয়টি আমাদের মতো দেশে তেমন সুপরিচিত ক্ষেত্র নয়। আলোচনায় সেই সব দিকের কিছু খোঁজ মিলবে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রতিবন্ধী শ্রেণির লোকের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। শারীরিক ও মানসিক বিবিধ শ্রেণির প্রতিবন্ধিতা বৃদ্ধিতে অধিক জনসংখ্যা, দীর্ঘস্থায়ী নানা রোগের বিস্তার, পরিবেশ, অর্থনীতি প্রভৃতি নিয়ামককে দায়ী করা হয়। প্রতিবন্ধী শ্রেণির অনেকেই আমাদের সন্তান, পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, আত্মীয় ও স্বজন। আমাদের সঙ্গেই এদের বসবাস। কিন্তু এদের কি দেখেই আমরা শনাক্ত করতে পারি? নাকি এদের চেনার কোনো উপায় আছে? উত্তর, না তেমন করে পারি না। কারণ, এদের অনেকেই অদেখা বা অদৃশ্য শ্রেণির প্রতিবন্ধী। পাশ্চাত্যের দেশসমূহে প্রতিবন্ধিতা পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত উন্নত পদ্ধতির জন্য এদের নির্ণয় সহজ ও সম্ভব হলেও আমাদের মতো দেশে এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আমাদের মতো দেশে শারীরিক অবস্থাই এখনো প্রতিবন্ধিতার মাপকাঠি। উন্নত দেশে গবেষকদের সঙ্গে চিকিৎসকেরাও প্রতিবন্ধীদের দৈহিক ও মানসিক দিকের সীমাবদ্ধতার বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে অবগত। এসব গবেষক ও চিকিৎসকদের অভিমত, অধিকাংশ লোকেরই কোনো না কোনো ধরনের দৈহিক বা মানসিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে এসব সীমাবদ্ধতার অনেকগুলোই আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় তেমন বাধার সৃষ্টি করে না। এজন্য আমরা তাদের প্রতিবন্ধী বলি না। যেমন—একজন পাঠকের চশমার সাহায্যে খবরের কাগজ পড়তে সহজ হয়। চশমা ছাড়া তিনি কাগজটি পড়তে তেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। এটা একধরনের প্রতিবন্ধকতা বটে। কিন্তু পাঠকের এই প্রতিবন্ধকতা তার সাধারণ জীবনযাত্রায় তেমন কোনো বাধার সৃষ্টি করে না। তাই তিনি প্রতিবন্ধী বলে চিহ্নিত নন।
লার্নিং প্রতিবন্ধীদেরও দেখে সহজে বোঝা সম্ভব হয় না যে তার মধ্যে এ ধরনের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। কিন্তু লার্নিং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিও একজন প্রতিবন্ধী। এই শ্রেণির প্রতিবন্ধীরা অদৃশ্য শ্রেণির মধ্যে পড়ে। অটিজমও অদৃশ্য শ্রেণির। এদের প্রতিবন্ধিতার ধরন চোখে দেখা যায় না; অদেখা। বিশেষজ্ঞ ছাড়া সাধারণের পক্ষে শারীরিক অদেখা এই অবস্থাগুলো বোঝা সহজ নয়। এমনকি চোখ-মুখ দেখেও তাদের এই প্রতিবন্ধকতার ধরন খুব একটা অনুমান করা সম্ভব হয় না। দেখেই চটজলদি বলা সহজ হয় না যে সে অটিজমের শিকার। এদের কারো কারো মধ্যে এক বা একের অধিক ধরনের প্রতিবন্ধিতা থাকতে পারে। অটিজম শিশুর মধ্যেও থাকতে পারে লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি, থাকতে পারে দৃষ্টিহীনতা। সুতরাং, এই শিশু বা ব্যক্তির মধ্যে অটিজম, লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি, দৃষ্টিহীনতাসহ তিন ধরনের ডিজঅ্যাবিলিটি রয়েছে। এই প্রতিবন্ধিতার ধরন বহুমুখী। এই শিশু বা ব্যক্তি যদি অমৌখিক বা বাক্যহীন হয়ে থাকেন, তবে তার মধ্যে চার ধরনের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। মনে রাখতে হবে, অটিজম শারীরিক বা মানসিক কোনো প্রতিবন্ধিতা নয়; না কোনো রোগ, না ব্যাধি। এটি একটি অবস্থা। অটিজম নিয়েই এই শিশু জন্মগ্রহণ করে। কিংবা অটিজম এমন কিছু নয় যে, লালন-পালনের কারণে পরবর্তী জীবনে তা বিকশিত হয়। জন্মের পর শুধু কিছু সময়ের ব্যবধানে অটিজমের লক্ষণগুলো আমরা দেখতে পাই। বিশ্ব জুড়ে না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু উন্নত দেশে প্রতিবন্ধীদের সম্বন্ধে পজিটিভ ধারণা বেড়েছে। এদের বিষয়ে জানাশোনা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যই এখন আমরা বলি, প্রতিবন্ধীরা ভিন্ন; কিন্তু আলাদা নয়। এজন্যই সব ধরনের প্রতিবন্ধীদের আর আলাদা স্কুলে যেতে হয় না; সবার সঙ্গে একই স্কুলে পড়াশোনা করে এবং কাজে-কর্মে এদের সমান মর্যাদায় ভাবা হয়। সুতরাং, প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে বিশদভাবে জানা ও ধারণা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত গবেষণা, বই-পুস্তক ও প্রচার-প্রচারণা।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct