বর্তমান সময়ে চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের ও পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ ব্যাঙ্কগুলি
পার্থপ্রতিম সেন
প্রা: চেয়ারম্যান পশ্চিমবঙ্গ গ্রামীণ ব্যাংক
পশ্চিমবঙ্গ গ্রামীণ ব্যাঙ্কের সোনালী দিনগুলো মনে পড়ে। সমস্ত স্তরের অফিসার্স এমপ্লয়িজ-দের উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল তুঙ্গে। করোনা ও অর্থনীতির শ্লথ গতির মধ্যেই ব্যাঙ্ক এগিয়ে ছিল পূর্ণ গতিতে। আমানতের ক্ষেত্রে স্বল্প সুদের আমানতের (সেভিংস এবং কারেন্ট ডিপোজিট) বৃদ্ধির হার ছিল বেশি যা ব্যাঙ্কের পক্ষে লাভজনক। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রেও যেসব প্রডাক্টে সুদের আয় বেশি, সেইসব ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার বেশি ছিল। তাই ব্যাঙ্কের সুদের নিট আয় (আমানতের উপর সুদ দেয়া এবং ঋণের উপর সুদ নেয়ার মধ্যে যে পার্থক্য) ছিল নজরকাড়া। নীতি হল সুদের খরচ কমানো এবং সুদের আয় বাড়ানো এবং সেই অনুযায়ী প্রোডাক্ট মিক্স তৈরি করে উপযুক্ত মার্কেটিং এর মাধ্যমে এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে লাভজনক ব্যবসা বাড়াতে হবে। ঋণ প্রোডাক্ট এর উপর অন্যান্য ব্যাঙ্কের তুলনায় সুদের হার কমিয়ে ব্যবসা বাড়িয়ে আখেরে লাভ নেই কারণ পরিণতিতে মুনাফা ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়। তাছাড়া ঋণ প্রোডাক্ট এর উপর সুদের হার কমিয়ে কতটুকু ব্যবসা বাড়ানো গেল, সেটাও দেখতে হবে। ব্যবসা যদি হাই-স্কেলে নিয়ে না যাওয়া যায়, তাহলে টোটাল ইন্টারেস্ট ইনকাম বা মোট সুদ থেকে আয় মার খাবে। এইসব ব্যাপারগুলো ব্যাঙ্কের ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে প্রতিনিয়ত পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়, না হলে পিছিয়ে পড়তে হয় এবং ব্যাঙ্কের পরিচালন কর্তৃপক্ষ ( বোর্ড অফ ডাইরেক্টরস), নাবার্ড, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, স্পনসর ব্যাঙ্কের সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। ব্যাঙ্ককে তাই ঋণ-সম্পদ ও আমানতের বৃদ্ধি এমন ভাবে ম্যানেজ করতে হয়, যাতে মুনাফার ক্ষেত্রটি শক্তিশালী হয়। আমরা পশ্চিমবঙ্গ গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কে এই কাজটা সঠিকভাবে করে প্রচুর নিট সুদের আয় বাড়িয়েছি। তাছাড়া ব্যাঙ্কে অন্যান্য সোর্স বা ক্ষেত্র থেকে আয় বাড়ানোর সুযোগ আছে যা নন-ইন্টারেষ্ট ইনকাম নামে সুপরিচিত।
যেমন বীমার ব্যবসা: লাইফ, নন-লাইফ, হেলথ ইন্স্যুরেন্স-এর পলিসি বিক্রি করা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিদের সাথে টাই-আপ করে। প্রচুর আয়। বীমা ব্যবসা থেকে প্রচুর আয় করেছি আমরা। তাছাড়া ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশন এর আওতায় অটল পেনশন যোজনা, জীবন জ্যোতি বীমা যোজনা, সুরক্ষা বীমা যোজনা- এর পলিসি বিক্রি করে ব্যাঙ্কের প্রচুর আয় হয়। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় এইসব জনকল্যাণমুখী পলিসি বিক্রির ক্ষেত্রে এক ব্যতিক্রমী কাজ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ গ্রামীণ ব্যাঙ্কে। অনেক অনেক পুরষ্কার আর তার সাথে প্রচুর আয় আমরা করতে পেরেছি। প্রায়োরিটি সেক্টরে ঋণ প্রদান বাড়িয়ে ‘প্রায়োরিটি সেক্টর লেন্ডিং সার্টিফিকেট’ বিক্রি করে ব্যাঙ্কের প্রচুর আয়। গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কে প্রায়োরিটি সেক্টরে ঋণ বাড়ানোর উপায় হল কৃষি ক্ষেত্র, স্বনির্ভর মহিলা গোষ্ঠী ক্ষেত্র এবং ক্ষুদ্র উদ্যোগ ক্ষেত্রে বেশি বেশি করে ঋণ প্রদানে উদ্যোগী হওয়া। এই ক্ষেত্রে কোনো ধরণের উপেক্ষা বা উদাসীনতা ব্যাঙ্কের বিপদ ডেকে আনতে পারে কারণ গ্রামীণ ব্যাঙ্ক তৈরি হয়েছে এইসব ক্ষেত্রে ঋণ দিয়ে গ্ৰামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করা এবং গ্ৰামীণ জনগণের অর্থনৈতিক প্রগতি ও সমৃদ্ধি রূপায়ণ করার জন্য। এই ক্ষেত্রে কোনো ধরনের কোনো শিথিলতার সুযোগ নেই এবং ব্যর্থতা আসলে দায় নিতে হবে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে এবং সেক্ষেত্রে যে কোনো সময় কেন্দ্রীয় সরকারের খড়্গহস্ত নেমে আসতে পারে ব্যাঙ্কের উপর। বলে রাখি, ‘প্রায়োরিটি সেক্টর লেন্ডিং সার্টিফিকেট বিক্রি’ করে আমরা পর্যাপ্ত আয় বাড়িয়েছে। মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে আমাদের ব্যাঙ্ক এক অগ্ৰগণ্য ভূমিকা পালন করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের গ্ৰামীণ উন্নয়ন মন্ত্রক ২০২১-২২ সালের জন্য মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য আমাদের ব্যাঙ্ককে বিশেষ ভাবে পুরষ্কৃত করেছে। তাছাড়া ঋণ প্রদানের সংখ্যা, ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে প্রসেসিং চার্জ, ডকুমেন্টেশন চার্জ ও আরো অন্যান্য চার্জ আদায় করে নন-ইন্টারেষ্ট ইনকাম অনেক বাড়ানো যায়। এই ক্ষেত্রেও আমাদের ইনকাম ছিল যথেষ্ট। তাছাড়া আছে ব্যাঙ্ক গ্যারেন্টি এবং অন্যান্য পরিষেবা ভিত্তিক ব্যবসা করার সুযোগ যা থেকে ব্যাঙ্কে নন-ইন্টারেষ্ট ইনকাম বাড়ানো যায়। গ্ৰামীণ অঞ্চলে এইসব ব্যবসার সুযোগ বেশি না থাকলেও কিছু আয় অবশ্যই হয়েছে আমাদের।
তাছাড়া ব্যাঙ্কের আরেকটি ক্ষেত্র আছে যেখান থেকে ইনকাম আসে, সেটা হলো ব্যাঙ্কের ইনভেষ্টমেন্ট পোর্টফোলিও। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্ট্যাটুটরি লিকিউডিটি রেশিও-এর নিয়ম অনুযায়ী ব্যাঙ্ককে নিট আমানতের ১৮ শতাংশ সরকারি বন্ডে ইনভেষ্ট করতে হয়। সেখান থেকে আসে ইন্টারেস্ট ইনকাম এবং সরকারি ঋণপত্রের ট্রেডিং বা কেনা বেচা করলে আসে নন-ইন্টারেষ্ট ইনকাম। তবে বন্ডের ইল্ড বা বন্ড থেকে আয় যখন ঊর্দ্ধমুখী, তখন বন্ড ট্রেডিং থেকে আয় তেমন হয়না, কিন্তু বন্ডের ইল্ড যখন নিম্নমুখী, তখন বন্ড কেনাবেচা থেকে ভালো নন- ইন্টারেস্ট ইনকাম হয়। কারণ বন্ডের প্রাইস আর বন্ডের ইল্ড ব্যস্তানুপাতিক অর্থাৎ একটা বাড়লে আরেকটা কমে। বন্ড থেকে ইন্টারেষ্ট ইনকাম তো ভালো হয়েছে আমাদের কারণ ব্যাঙ্ক ফিক্সড ডিপোজিট-এর সুদের হার থেকে বন্ডের কুপন রেট বা ইন্টারেস্ট রেট বেশি ছিল। তবে বন্ডের ট্রেডিং ইনকাম সব বছর সমান হয়নি। আগেই বললাম, বন্ডের ইল্ড যে বছর নিম্নমুখী ছিল, সে বছর বন্ড ট্রেডিং থেকে ভালো ইনকাম হয়েছে।তাছাড়া ঋণ প্রদানের পর এবং সরকারি বন্ডে লগ্নি করার পর আমানতের কিছু উদ্বৃত্ত ফান্ড আমরা বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট-এ রেখেছি। সেখান থেকে ভালো ইনকাম হয়েছে বিশেষতঃ বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলো থেকে। এইভাবে আমরা প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে ইন্টারেস্ট এবং নন- ইন্টারেস্ট ইনকাম বাড়িয়েছে সবাই মিলে নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে। সাথে সাথে খরচের দিকটা আমরা কমানোর চেষ্টা করেছি। প্রচুর সিনিয়র স্টাফ রিটায়ার করেছেন, জুনিয়র স্টাফ এসেছে। বেতনের পার্থক্য থাকায় বেতন প্রদানে সাশ্রয় হয়েছে। তাছাড়া অপারেশনে রদ বদল করে অনেক খরচ কমানো হয়েছে। এইভাবে আমরা বছর বছর অপারেটিং মুনাফা (আয় - ব্যয়) বা ব্যাঙ্কের ব্যবসা থেকে মুনাফা করেছি প্রচুর। বৃদ্ধির হার ছিল ৩০-৪০ শতাংশ। তবে বছর বছর টেকনোলোজির ক্ষেত্রে খরচা এবং স্টাফ পেনশনের জন্য বেশ বড় অঙ্কের খরচা
হওয়ায় আমরা নিট মুনাফা করতে পারেনি। সুখের খবর, এই বছরেই স্টাফ পেনশনের জন্য খরচা করা শেষ হয়ে যাবে। আগামী আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিক থেকেই পশ্চিমবঙ্গ গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কের নিট মুনাফা শুরু হবে। শেষ পর্যায়ে এসে বলি ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং-এর কথা। আজকের যুগ ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং এর যুগ। ডেবিট কার্ড, মোবাইল ব্যাঙ্কিং, ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং, ইউপিআই এবং অন্যান্য নিত্য নতুন ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং প্রোডাক্টস চালু করে এগিয়ে যেতে হবে, না হলে পিছিয়ে পড়তে হবে এবং সেই ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ে যাবে। ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং ছাড়া সমস্ত ধরণের ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং প্রোডাক্টস পশ্চিমবঙ্গ গ্রামীণ ব্যাঙ্কে আছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অনুমতি দিলেই ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং চালু হয়ে যাবে পশ্চিমবঙ্গ গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কে। শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা। কেন্দ্রীয় সরকার খুবই সচেষ্ট যাতে প্রতিটি গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কে ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং পরিষেবা অতি শীঘ্রই চালু হয় এবং প্রতিটি গ্ৰামীণ ব্যাঙ্ক যেন ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং-এর ক্ষেত্রে অন্যান্য সরকারি এবং বেসরকারী ব্যাঙ্কের সমকক্ষ হয়ে উঠে। বলে রাখি পশ্চিমবঙ্গ গ্ৰামীণ ব্যাঙ্ক পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি জেলা হাওড়া, হুগলি, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান এবং বীরভূমে ২৩০ টি শাখা নিয়ে ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় নিয়োজিত। কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশের ৪৩ টি গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কের মধ্যে ২০-২২টি গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কে আট হাজার কোটি টাকার মতো পুঁজির অনুমোদন দিয়েছে গত আর্থিক বছরে। বাকিদের পুঁজির প্রয়োজন নেই।
প্রতিটি গ্রামীণ ব্যাঙ্ককে ৯ শতাংশ ক্যাপিটেল বা পুঁজি রাখতে হয় ঝুঁকিযুক্ত ব্যাঙ্কিং সম্পদের জন্য। কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার এবং স্পনসর ব্যাঙ্ক ৫০:১৫:৩৫ অনুপাতে পুঁজির দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাঙ্কগুলিতে পুঁজি ঢেলেছে প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণে যাতে ৯ শতাংশ পুঁজির পর্যাপ্ততার অনুপাত রক্ষিত হয় এবং ব্যাঙ্ক শক্তিশালী হয় এবং বেশি বেশি করে ঋণ প্রদান করতে পারে দেশের অর্থনীতির উন্নতি সাধনে। কেন্দ্রীয় সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস, নাবার্ড, স্পনসর ব্যাঙ্ক এবং প্রতিটি গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কের সহায়তায় পাঁচ বছরের জন্য এক একটি গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কের জন্য এক একটি স্মার্ট প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে যা প্রয়োগ করে গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কগুলোকে শক্তিশালী আধুনিক গ্ৰামীণ ব্যাঙ্ক হিসেবে গড়ে তোলা হবে। সেই প্ল্যান অনুযায়ী প্রতিটি গ্রামীণ ব্যাঙ্কের পারফর্ম্যান্স নিয়মিত কঠোর ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং নিরীক্ষণ করা হবে। তাই গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কের পরিচালন বোর্ড, ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ এবং সমস্ত ধরণের কর্মীদের এবং কর্মী ইউনিয়নদের কাছে আজ প্ল্যান অনুযায়ী পারফর্ম্যান্স এক চ্যালেঞ্জ স্বরূপ এবং এই অগ্নিপরীক্ষায় গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কগুলি উত্তীর্ণ হবে বলেই আশা। আগামী দিনে গ্ৰামীণ ব্যাঙ্কগুলির বেশি বেশি করে সক্রিয় কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে ভারতের গ্ৰামীণ অর্থনীতি শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছাবে, সে তো নয় দুরাশা বলেই মনে করি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct