পশ্চিমবঙ্গ বর্তমানে বেকার সমস্যা এক চরম আকার ধারণ করেছে। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দুর্নীতিতে রাজ্যের ভূমিকা এখন বহুল চর্চিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণমাধ্যমে একটু চোখ রাখলেই সে কথা বুঝতে খুব বেশি অসুবিধা হয় না। প্রাথমিক শিক্ষক, মাদ্রাসা শিক্ষক, মাধ্যমিক শিক্ষক এবং গ্রুপ ডি নিয়োগ নিয়ে মামলা চলছে। মামলার আওতায় এসেছে এস এস সির শারীরশিক্ষা ও কর্মশিক্ষা শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও। চাকুরি নিয়ে মামলা তখনই হয় যখন নিয়োগে বে-নিয়মের অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে লিখেছেন সনাতন পাল। আজ শেষ কিস্তি।
সাধারণত মানুষ আদালতে যান ন্যায়ের দাবিতে। তাহলে ঐ হবু শিক্ষকদের এই ধর্নায়য় বসাটা কি ন্যায়ের বিরুদ্ধে হচ্ছে না? সারা রাজ্যে লক্ষ লক্ষ বেকার আছেন, সবার চাকুরির দরকার। এক্ষেত্রে সরকার নিজের দুর্নীতি ঢাকতে আন্দোলনরত হবু শিক্ষকদের চাকরি দিতে চাইছেন। ওই পোস্টের জন্য রাজ্যের আর কোনো বেকার যোগ্যতা নির্ধারণের সুযোগ পাবেন না। কিন্তু সরকার একটার পর একটা নিয়োগে দুর্নীতি করবে আর তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হলেই আন্দোলন কারীদের দলীয়করণের কাজটা সম্পন্ন করে সুপার নিউমেরারি পোস্ট তৈরি করে চাকুরি দিয়ে আরও একটা বঞ্চনা তৈরী করবে? আর সেই খেসারত দেওয়া হবে সাধারণ জনগণের টাকায়! ঋণের টাকায়! যে ঋণের বোঝা মাতৃগর্ভে যে সন্তান আছে, তাকেও সেই ভার বহন করতে হবে! এতে কি ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে? আদালত যদি সরকারের এই ধরণের নিয়োগ পন্থাকে ঠিক বলে মনে করে,তাহলে সেটাই হবে। কিন্তু এই হবু শিক্ষকদের আদালতকে এতো হয় কেন? শাসকের কথায় উৎসাহিত হয়ে যে সকল হবু শিক্ষকরা ন্যায় দাবী করা মানুষদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামছেন, তারা কি ন্যায়ের পথে বাধা হচ্ছেন না? অবশ্যই বাধা। কিন্তু তাদের বেকারত্বের জ্বালা এবং চাকুরির চাহিদায় সেই অন্যায়কে অন্যায় বলে মনে করছেন না! এতে তারা ন্যায়ের পথে থাকা বেকারদের জ্বালার কারণ হচ্ছেন না তো!
তাদের কথা মোতাবেক মামলাকারী আইনজীবীদের বিরুদ্ধে এই ধরণের আন্দোলন এবং হুমকি অবশ্যই আদালতের কাজে অনেকটা বাধা দেওয়ারই সমতুল্য। এতে করে আমাদের এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়েছে। মানুষ আদালতে মামলা করতে গেলে সেখানে চাপ তৈরি করা হবে, বিচারপতি ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিলে তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হবে। এই সমস্ত ঘটনা প্রবাহ এ রাজ্যে আইনের শাসন থাকবে, কি না সেটা একটা বড় প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড় করিয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরী করার অর্থ কি রাজ্যে একটা জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম করার প্রচেষ্টা নয় ? কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ এবিষয়ে কতটা ভেবেছি? আর বেকারদের স্বার্থে কতটুকুই বা ভূমিকা নিয়েছি? কোনো সরকার দুর্নীতি করার সাহস তখনই পায়, যখন জনসমর্থন তার পক্ষে থাকে। এটা শাসক ভালো করেই জানে। সেই কারণেই হয়তো ৫০০ টাকার লক্ষ্মীর ভান্ডারের নিয়মকে আর একটু শিথিল করা, যাতে রাজ্যের একটা বহত্তর জনগোষ্ঠী শাসকের পক্ষে থাকেন। আর সেই সমর্থনের ভিত্তিতে চাকুরি বিক্রি করে ,দুর্নীতি করে শাসক যেন কালো টাকার পাহাড় তৈরী করতে পারে এবং সেই বিপুল পরিমাণ অর্থ যেন নির্বাচনে কাজে লাগাতে পারেন । এ এক অমোঘ নিয়তি আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে , দুর্নীতির কারণে যাঁদের চাকুরি হয়নি তাঁদের মা বোনেরা এবং যাঁরা দুর্নীতির প্রশ্রয়ে চাকুরি পেয়েছেন তাঁরা সকলেই একই লক্ষ্মীর ভান্ডারের লাইনে! তাঁরা হয়তো বঞ্চিত নিজেদের ছেলের কথাও ভাবছেন না। আমাদের এই উর্বর জমিতে শাসক মনের সুখে দুর্নীতির লাঙল দিয়ে মানব জমিন চাষ করছে। এই ব্যবস্থা আর কিছুদিন কায়েম থাকলে রাজ্যের বেকাররা ভয়ঙ্কর সংকটে পড়বেন। এই সংকট থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায় ন্যায়ের পথকে বাধা মুক্ত করা। এই বাধা মুক্ত করার লড়াইটাই মাননীয় আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য এবং মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মানুষরা করে চলেছেন। এই ন্যায়ের পক্ষে লড়াইয়ের পাশে আপনার আমার থাকা কি নৈতিক কর্তব্য নয়? বিষয়টা বিকাশ বাবু বা বিচারপতিগণের নয়, বিষয়টা ন্যায়-অন্যায়ের। রাজ্যের লক্ষ লক্ষ বেকারের। বিষয়টা সকলকে ভাবার জন্যই এই পোস্ট করা। (সমাপ্ত...)
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
লেখক প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct