বেবি চক্রবর্তী, আপনজন: সদ্য হয়ে যাওয়া মহামারীর দুর্বিষহ সময়টাকে বাদ দিয়ে কেউ কি কখনো দেখেছেন যে আজকের জনকলরব মুখরিত শিয়ালদহ অঞ্চল কখনও জনবিরল হয়েছে? রাত্রির কথাই ধরুন। রাত্রে সারাদিনের কর্মক্লান্ত কলকাতা নগরী ঘুমোয়। তখনও কলকাতার পথদিয়ে লোকজন যাতায়াত করে, তবে কখনও কখনও একেবারে যায়ও না। গেলে পরে দেখা যায় রাত্রে ষ্টেশনে এসে গাড়ি থেমেছে কিংবা ভোর রাত্রে গাড়ি ছাড়বে সেইজন্যে লোকের আনাগোনা। কিন্তু তবুও হলফ করে বলা যায় যে শিয়ালদহ কখনও জনবিরল হয় না। কলকাতার ওই অঞ্চলে সদা-সর্বদাই লোকজনের আনাগোনা। অতীতে দেশ বিভাগের পরে পূর্ব বাংলা থেকে গৃহহারারা সেখানে এসে নিজেদের সংসার পেতেছিলেন। দেশ স্বাধীনতা পাওয়ার পরে ওই অঞ্চলে আর একটি ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল। সুতরাং কলকাতা শহরের ওই মহাকেন্দ্রবিন্দুতে কখনও লোকের কমতি হয়নি। আর কলকাতার যেখানে যত লোক সেখানে তত মত, সেখানেই তত ইতিহাস। তাই বছরে বছরে সেখানে ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। শিয়ালদহ কলকাতার একটি ঐতিহাসিক মহামিলন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। শহর কলকাতার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হল শিয়ালদহ। সারা শহরের লোক ওই জায়গাটিতে দিনে-রাত্রে একবার না এলে যেন হাঁফ ছাড়তে পারেন না। সেখানে সব আছে, মানুষের প্রয়োজনীয় যে কোন বস্তু সেখানে পাওয়া যায়। সামনে বৃহৎ রেল ষ্টেশন। দিনরাত ধরে অগণিত লোক আসছে আর যাচ্ছে। তাঁদের পদধূলিতে ষ্টেশনের পিচকালো পিচের পথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। দেশ বিদেশের বিবিধ দ্রব্য সম্ভার সেখানে আসে। মাছ তরিতরকারী এসে পড়ে সামনের নফরবাবুর বাজারে। সে সব জিনিস মিনিটে মিনিটে কলকাতার বিভিন্ন বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। কলকাতা ও আশেপাশের অঞ্চলগুলি সেই সব জিনিষ-পত্তর ক্রয় করে নিজেদের প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয়তা মেটায়।
বর্তমানে ওই অঞ্চলটি যেমন বিখ্যাত তেমনি অতীতে একবার চলে যান। প্রাচীন কলকাতার ইতিহাস হাতড়াতে হাতড়াতে এগিয়ে চলুন। ‘আপজনের’ আঁকা পুরানো কলকাতার ম্যাপের একটি জায়গায় গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ুন। কিছু দেখতে পাচ্ছেন কি? প্রাচীন কলকাতার ইতিহাসেও ওই অঞ্চলটি উল্লেখযোগ্য ছিল। তখন একটি ‘বটবৃক্ষ’ ঐ শিয়ালদহ ষ্টেশনেরই কোন এক জায়গায় ছিল। সেটারই ছায়া-শীতল তলায় বসে তখনকার দিনের দেশি বিদেশি বণিকেরা তামাক সেবন করতেন। বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিকের গ্রন্থে লেখা আছে যে ‘জোব চার্নক’ও সেখানে বসে তামাক সেবন করেছিলেন। এবার ইতিহাসের বইগুলি বন্ধ করে দিয়ে নিজের কল্পনায় সেই জায়গাটিকে ঠিক করে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন। বেড়িয়ে পড়ুন সেই প্রাচীন বটবৃক্ষের স্মৃতি খুঁজতে। কারণ সুদূর অতীতে শিয়ালদহ অঞ্চলে কখনও কোন বটবৃক্ষ ছিল, বর্তমানে সে-কথা বিশ্বাসই হবে না। শিয়ালদহ ষ্টেশনের ঘেরাও অঞ্চলে ঢুকে হামাগুড়ি দিয়ে খুঁজতে থাকুন সেই বটবৃক্ষের কোন শিকড়। কিংবা এক টুকরো তামাকের ছাই, যা বণিকেরা সেদিন বসে বসে মৌজ করে সেবন করতেন। কিন্তু কোথায়? কোথায় সে সব! দেখতে দেখতে আপনার চোখ আপনা থেকেই অবিশ্বাসে কালো হয়ে উঠবে। এবারে শিয়ালদহের সামনে দাঁড়িয়ে আর একবার ষ্টেশনের মাথার ঘড়ি থেকে চোখ দুটো বরাবর নামিয়ে দিন। চোখের ওপর জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করুন সেই বৃহৎ প্রাচীন বটবৃক্ষটি। যেটা অতীতে মাথা উঁচু করে সেখানে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করেছিল; কিন্তু না, কিছুতেই মনে করতে পারবেন না। আর মনে করবেন কি? কিছু চিহ্ন কি সেখানে আছে যে সেই চিহ্নটির গোড়া ধরে একটা কল্পনার ভাব আনবেন? শহর কলকাতা চিরকাল পুরোন খোলস ছেড়ে নতুন খোলস নিয়েছে কিন্তু পুরাতনের কোন চিহ্নই সে নিজের দেহে ধরে রাখে নি। শুধু ঐতিহাসিকেরা দয়া করে তাঁদের মহামূল্যবান পুস্তকে সেই সব স্মৃতি ধারণ করে আমাদের জ্ঞান পিপাসা আরও বাড়িয়েছেন। অথচ একদিন ওই বিখ্যাত বটবৃক্ষের ছায়া-শীতল তলায় বসে দেশি বিদেশি বণিকেরা বিশ্রাম করতেন, তামাক সেবন করতেন আর আড্ডা দিতেন।
শুনলে আশ্চর্য লাগে যে তখনকার দিনেও আড্ডার চল ছিল। আড্ডা যে একটা মহামিলনের মহৌষধ সে কথা বাঙালি অনেকদিন পরে বুঝতে পেরেছিল। আজকাল আড্ডা দিলে চরিত্র নষ্ট হয় না বরং দৃঢ় হয়। মানুষ সব বয়সে সর্বকালে আড্ডা দিতে ভালবাসে। সারাদিনের পরিশ্রম তারপর একটু মৌজ করে আড্ডা। কয়েক কাপ চা, কয়েকটা সিগারেট। আর কয়েকটি ইয়ার বন্ধু, তা তাঁরা এক বয়েসের হোক বা যুবক-বৃদ্ধের মিলন হোক কিংবা ছেলে-মেয়েতে হোক। আড্ডা কিন্তু আড্ডাই। সেটার কোন রকমফের নেই। নির্মল বা দূষিত হোক - তবুও সেটার মূল্য আছে। আজকের যুগে আড্ডাতেই পৃথিবীর কাজ চলেছে। যুদ্ধ শুরু হচ্ছে, আবার যুদ্ধ থামছেও। আড্ডাতে যেমন বন্ধুত্বের সূত্রপাত হচ্ছে, তেমনই শত্রুর বৃদ্ধিও হচ্ছে। ইদানীং কালে স্রেফ আড্ডাতেই অনেক বড় বড় কাজ সুসম্পন্ন হচ্ছে। তাই আমাদের বাপ-পিতামহের সাবধানবাণীর আজকাল আর কোন মূল্য নেই। তাই আজ ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে, তখনকার দিনের কলকাতার বড় বড় মহারথীরা সেই প্রাচীন বটবৃক্ষের তলায় বসে আড্ডা দিতেন। ঘোড়া বা গাধা বা উটের পিঠে ব্যবসায়ীরা মালপত্তর রেখে সেগুলোকে ওই বটবৃক্ষের পাশে বেঁধে রাখতেন। তারপরে বিশ্রাম করে, আড্ডা সুখে তৃপ্ত হয়ে আবার যে যাঁর পথে চলে যেতেন। পুরানো কলকাতার সেই প্রধান মহামিলন ক্ষেত্রটি কবে যে লোপ পেয়েছিল তার কোন হদিস ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় না। ইতিহাসের কোথাও কোন তারিখ বা কোন খ্রীষ্টাব্দ লেখা নেই। এবং কে সেই রমণীয় স্থানটি অমন করে উচ্ছেদ করেছিলেন, তাঁরও কোন নাম ইতিহাসে লেখা নেই। তবে এ কথা হলফ করে বলা যায় যে সেখানেই সেই বটবৃক্ষটি ছিল এবং সেখানে একটি আড্ডা ঘরও ছিল তা - না হলে ‘বৈঠকখানা’ নাম হল কেন?
অতীতে শুধু ‘বৈঠকখানা বাজারের’ সীমানাকেই ‘বৈঠকখানা’ বলা হত না। ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ‘আপজনের ম্যাপ’ অনুসারে ‘লালবাজার’ থেকে ‘শিয়ালদহ’ পর্যন্ত অঞ্চলটিকে ‘বৈঠকখানা রোড’ বলা হত। ১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘হিকির গেজেট’ থেকেও জানা যায় যে ওই বটবৃক্ষটি ও তার বিপরীত দিকে ইংরেজদের আর একটি ‘ব্রেড-এণ্ড-চিজ বাংলো আড্ডা ঘর’ ছিল। এবং ওই আড্ডা ঘরটি সেকালের ইংরেজদের কাছে সুপ্রসিদ্ধ ছিল এবং বিখ্যাত একটি ‘ট্যাভার্ন’ নামে সর্ব সাধারণের কাছে প্রসিদ্ধ ছিল। তারপরে ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দে সেই বাংলোটি নিলামে বিক্রি করবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই বিষয়ে তখনকার দিনের সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল বলেই এই তত্ত্বটি সহজে পাওয়া যায়। তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, বাড়ির বৈঠকখানার মত ওই অঞ্চলটিও একদিন ইংরেজদের পুরো বৈঠকখানা ছিল। তখন ইংরেজরা ‘চৌরঙ্গী’তে বাস করতেন আর ‘বৈঠকখানায়’ এসে আড্ডা দিতেন। সেইজন্যই এখন বৈঠকখানার সমগ্র অঞ্চলটি এমন কি শিয়ালদহর চারদিকে আড্ডা দেওয়ার মত লোকের মিছিল। দিনরাত কেবল লোক, কেবল কলরব। আড্ডা দেওয়া ছাড়া যেন কারুর আর কোন কাজ নেই। দেশবিদেশ থেকে লোক ট্রেনে করে আসছেন আর ওই পথ দিয়ে আড্ডা দিতে দিতে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা মাছ তরিতরকারী নিয়ে তারই পাশের বাজারে বসে যাচ্ছেন বিক্রি করতে - আর একই সঙ্গে ভিন্ন দেশের লোকের সঙ্গে হাসি-তামাশার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। তার উপরে আছে সারা শহর কলকাতার সব লোকের আসা-যাওয়া। সবই যেন সেই প্রাচীন কলকাতার আড্ডা ঘরের স্মৃতি রক্ষার্থে। সেই বটবৃক্ষের অমর স্মৃতিকে রক্ষা করবার জন্য নিজেদের অজান্তেই যেন সেই তোড়জোড়। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যই যেন মানুষের সেই পরিত্রাহি চেষ্টা। কিন্তু যদি প্রাচীন কলকাতার এই স্মৃতিচিহ্নগুলি ঐতিহাসিকদের পুস্তকের মত কেউ চিহ্নিত করে রাখতেন? কিন্তু কে তখন জানতেন যে একদিন এর এত মূল্য হবে? তখন কে-ই বা জানতেন যে বর্তমান সময়ের মানুষ আবার সেই স্মৃতিচিহ্নগুলোকে খুঁজবে?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct