যখন মোবাইল ছিল না তখনও পর্যন্ত, সকালে বাড়িতে সংবাদ ও সাময়িক পত্রটির জন্য গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকতেন বিবিধ শ্রেণির মানুষ। আজকের যুগে অনেকেই মোবাইলেই খবরের কাগজ পড়েন। অবশ্য প্রথম আঘাতটা দিয়েছিল টেলিভিশন। তবুও বিজ্ঞাপনকে অবলম্বন করে অনেক সংবাদপত্রই তাঁদের অস্তিত্ব সমানে বজায় রেখেছে। এই বিষয় নিয়েই আলোকপাত করেছেন ড. রমজান আলি।
যখন মোবাইল ছিল না তখনও পর্যন্ত, সকালে বাড়িতে সংবাদ ও সাময়িক পত্রটির জন্য গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকতেন বিবিধ শ্রেণির মানুষ। আজকের যুগে অনেকেই মোবাইলেই খবরের কাগজ পড়েন। অবশ্য প্রথম আঘাতটা দিয়েছিল টেলিভিশন। তবুও বিজ্ঞাপনকে অবলম্বন করে অনেক সংবাদপত্রই তাঁদের অস্তিত্ব সমানে বজায় রেখেছে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সংবাদ-সাময়িক পত্র প্রকাশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কারণ শিক্ষায়তনের বাইরে এই ধারা জনমানস ও বাংলা গদ্যকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। খ্রিস্টান মিশন, মুদ্রণযন্ত্র এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গদ্য সাহিত্য নির্মিতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করলে সংবাদ-সাময়িক পত্র প্রকাশ সহজ হল। প্রকাশে দেরি হওয়াতে তার কয়েকটি কারণ ছিল। প্রথমত, সংবাদপত্র পদ্যে লেখা হয় না। সংবাদের জন্য গদ্য তখনও আদর্শ গদ্য তৈরি হয় নি। দ্বিতীয়ত,এত দিন বাংলাদেশে ছাপাখানা ছিল না। প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা হয় ১৮০০ সালে শ্রীরামপুর মিশনে। আর অক্ষর তৈরিতে খুশমৎ-এর হস্তলিপি গ্রহণ তার বাস্তব রূপায়নে সাহায্য করলেন পঞ্চানন কর্মকার ও মনোহর কর্মকার। তৃতীয়ত, সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য একটা আর্থিক ব্যাপার থেকেই যায়। কোন বাঙালি তখনও পর্যন্ত এতে সাহায্য করেনি। অর্থাৎপৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সংবাদ প্রকাশ হতে দেরি হয়েছে। চতুর্থত, সংবাদপত্র থেকেও যে শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় এবং তা যে আস্বাদযোগ্য হতে পারে, তা সবার জানা ছিল না।
সংবাদপত্রের উৎসভূমির দিকে তাকালে দেখা যায় মুঘল আমলে রাজধানী এবং অন্যান্য প্রদেশের সংবাদ ফারসি ভাষায় হাতে লিখে ‘আখবার’ প্রকাশ করা হত। ইউরোপে অভিজাত ও ব্যবসায়ীরা চিঠি থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতেন। পরে জার্মানির গুটেনবার্গ মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কার করলে মুদ্রণ যন্ত্রে ছাপা সংবাদ পরিবেশন হতে থাকে। শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রথম বাংলা সংবাদ-সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ বাঙালির মননচর্চার ভূমিটিকে যেমন শক্ত পোক্ত করেছে তেমনি বাংলার গদ্য নির্মিতিতে এক বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলা সংবাদ-সাময়িক পত্রের সূচনা ঘটে ১৮১৮ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে শ্রীরামপুর মিশনারীদের উদ্যোগে। জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হল ‘দিগদর্শন’ পত্রিকা। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী এর আগে ইংরাজি ভাষায় ভারতবর্ষ থেকে প্রথম পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৭০ খ্রি. জেমস্ অগস্টাস্ হিকির সম্পাদনায় ‘বেঙ্গল গেজেট’ পত্রিকাটি। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ১৮১৮ খ্রিঃ ‘দিগদর্শন’ থেকে শুরু করে ১৮৭২ খ্রিঃ ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা প্রকাশ পর্যন্ত সময়কালটি বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। উদ্দীপনার চাপে একের পর এক আবির্ভূত হল সংবাদ পত্র এবং সাময়িক পত্র। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সংস্পর্শে এদেশীয় মননশীল মানুষেরা দেশ বিদেশের খবর জানতে চাইলো, জানতে চাইল পৃথিবীর কোথায় বিবর্তন চলছে। সুতরাং মানুষের কৌতূহল ও প্রত্যাশা পূরণে সংবাদ-সাময়িক পত্রগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।
প্রত্যাশা পূরণ ছাড়াও তৎকালীন সময়ে এই পত্রিকাগুলি স্বদেশের পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করে নাগরিকদের সচেতন করেছে। গোষ্ঠি কেন্দ্রিক আদর্শ প্রচার করেছে, ব্যবসায়ীর দৃষ্টি ভঙ্গিতে বহুল প্রচার পেতে চেয়েছে, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নছাড়াও দর্শন ইতিহাস সমাজধর্ম, ভাষা শিক্ষা ইত্যাদি আলোচনা করেছে। কখনও আবার কোনো কোনো পত্রিকা এককভাবে সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা পালন করেছে। শুধু তাই নয় মৌলিক সাহিত্য সৃষ্টিতেও এরা পিছিয়ে থাকেনি। ১৮১৮-১৮৭২ এই কালপর্বে উল্লেখযোগ্য সাময়িক পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হল জন ক্লার্ক মার্শম্যান-এর সম্পাদনায় দিগ্দর্শন, সমাচারদর্পণ (১৮১৮ খ্রিঃ)। এরপর এল -‘বাঙ্গাল গেজেট’-১৮১৮ খ্রিঃ, সম্পাদক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। পরবর্তীতে রামমোহন রায় ও ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সম্বাদ কৌমুদী’-১৮২১ খ্রিঃ। মতের মিল না হওয়ায় এর দুজনে আবার আলাদা আলাদা পত্রিকা বের করলেন। মাত্র উনিশ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১ খ্রিঃ) প্রকাশ করলেন। খানিকটা ধর্মীয় প্রভাব থেকে বের হওয়ার চেষ্টা অবশ্য ছিল। ব্রাহ্মধর্মের মুখপত্র হিসাবে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দায়িত্ব তত্ত্ববোধিনী (১৮৪৩ খ্রিঃ) দিলেন অক্ষয়কুমার দত্তকে। মেয়েদের বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে প্যারীচাঁদ মিত্র ১৮৫৪ খ্রিঃ প্রকাশ করলেন ‘মাসিক পত্রিকা’। তারপর ১৮৭২ খ্রিঃ থেকে ‘বঙ্গদর্শন’ নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র।
শ্রী ভূদেব চৌধুরী ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা’ (২য় পর্যায়) গ্রন্থে জানিয়েছেন –“ বাংলা লিখ্য গদ্যরীতির সূতিকাগার ছিল বিবিধ শিক্ষায়াতন, আর তার শৈশব-কৈশোর মুখ্য বিচরণ ক্ষেত্র বিভিন্ন সংবাদ এবং সাময়িক পত্রের পৃষ্ঠা।” উদ্ধৃতি থেকেই বোঝা যায় যে বাংলা গদ্য ভাষা বিকাশে সাময়িক পত্রগুলি কি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটা ঠিক যে ১৮১৮ খ্রিঃ ‘দিগ্দর্শন’ পত্রিকার মধ্য দিয়ে সংবাদ-সাময়িক পত্রের যে সূচনা ঘটেছিল ১৮৪৩ খ্রিঃ ‘তত্ত্ববোধিনী’ প্রকাশ পর্যন্ত তার নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সংস্পর্শে এসে বাংলা দেশে জ্ঞানবিজ্ঞান, সমাজ সংস্কার ও সাহিত্য চিন্তার যে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল তৎকালীন যুগের পত্রিকাগুলি সেই যুগের পরিচয়কে ধরে রেখেছে। বলা বাহুল্য যে, বাংলা সাহিত্যের গদ্য সাহিত্যে যে প্রস্তুতিকাল চলেছিল সেটি এই পর্বেই ঘটেছিল।
বাংলা সংবাদ-সাময়িক পত্রের ১৮১৮-৪৩ খ্রিঃ এই কাল পর্বে সব থেকে বেশি উপকৃত হয়েছে বাংলা গদ্য। ভাষা বিকাশ এবং গদ্য গঠনে পত্র পত্রিকাগুলি যথাযথ সাহায্য করেছিল। পত্রিকার ভাষা কতখানি শুদ্ধ ও প্রাঞ্জল ছিল ‘দিগ্দর্শন’-এর পাতা থেকে তুলে ধরা যেতে পারে –– “পৃথিবী চারিভাগে বিভক্ত আছে ইউরোপ ও আসিয়া ও আফ্রিকা ও আমেরিকা। ইউরোপ ও আসিয়া ও আফ্রিকা এই তিনভাগ এক মহাদ্বীপে আছে, ইহারা কোন সমুদ্র দ্বারা পরস্পর বিভক্ত নয় কিন্তু আমেরিকা পৃথক এক দ্বীপে প্রথম এক দ্বীপ হইতে দু’হাজার ক্রোশ অন্তর।” উদ্ধৃতিটিতে বিরাম চিহ্নের ব্যবহার স্পষ্ট নয় এবং ইংরেজি বাক্য রীতির প্রতিফলন থাকলেও এটি সহজবোধ্য।
সংবাদ সাময়িক প্রকাশের ফলে ভাষা কেবল আর ভাবের বাহন রইল না। বাংলা ভাষা হয়ে উঠল সর্ব প্রকার জ্ঞানচর্চার বাহন। দর্শন, ভূগোল, বিজ্ঞান, ইতিহাস, জীবনী সাহিত্য, মনোবিদ্যা সবকিছুই গদ্যে রচিত হতে শুরু করলো। অবশ্য প্রথমদিকের পত্রিকাগুলিতে এগুলি বস্তুনিষ্ঠ প্রাথমিক জ্ঞানদানে সীমাবদ্ধ ছিল, পরে অবশ্য আলোচনার মান গভীর এবং উন্নত হয়েছে।
দলাদলি ও কলহের ফলে সংবাদ পত্রের গদ্য ভাষায় যুক্তি ও তর্ক প্রবেশ করলে ভাষার তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধি পায় এবং গতিপ্রাপ্ত হয়। এবিষয়ে রামমোহন রায়ের ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ পত্রিকাটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। খুব সচেতন ভাবেই রামমোহন তাঁর লেখায় কর্তাকর্ম-ক্রিয়ায় বিন্যাস ক্রমটিকে রক্ষা করেছেন এবং যথোচিত বিরাম চিহ্নের প্রয়োগে বাংলা গদ্য আরও প্রাঞ্জল হয়েছে।
সেকালের সংবাদ-সাময়িক পত্রগুলিতে সংবাদ পরিবেশনের বস্তুনিষ্ঠ ‘কেজো’ গদ্যের ব্যবহার হত। তাই তৎসম শব্দের পাশাপাশি তদ্ভব, দেশি, বিদেশি বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারটি সমৃদ্ধি লাভ করেছে। এ প্রসঙ্গে ‘সমাচার দর্পণ’ থেকে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে -- “নূতন কেতাব – ইংরেজি বর্ণমালা অর্থ উচ্চারণ সমেত প্রথম বর্ণাবধি সাত বর্ণ পর্যন্ত বাঙ্গালা ভাষায় তৰ্জ্জমা হইয়া মোং কলিকাতায় ছাপা হইয়াছে তাহাতে পড়িবার কারণ পাঠ ও গণিত ও নমতা ও ব্যাকরণ ও লিখিবার আদর্শ ও পত্রধারা ও আর্জি ও খত ও টর্ণিনামা ও হিতোপদেশ প্রভৃতি আছে।” উল্লিখিত অংশ থেকে বোঝা যায় যে, বাংলা গদ্যে কিভাবে বিদেশি শব্দের প্রবেশ ঘটেছে।
এই কাল পর্বে সংবাদ-সাময়িক পত্রগুলি ‘সহমরণ’, ‘বিধবা বিবাহ’, ‘কৌলিন্য প্রথা’, স্ত্রী শিক্ষা, বহুবিবাহ নিবারণ, ইংরাজি শিক্ষা ইত্যাদি সমস্যাকে তুলে ধরেছিল। এব্যাপারে ‘সমাচারদর্পণ’, ‘সংবাদ কৌমুদী’, ‘তত্ত্ববোধিনী’ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কোন কোন পত্রিকা যেমন ‘জ্ঞানান্বেষণ’ খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার, তত্ত্ববোধিনী ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। তাছাড়া এই পত্রিকাগুলিকে ঘিরেই একদল গদ্য রচয়িতার সৃষ্টি হয়।
শুরু থেকে বঙ্গদর্শন পর্যন্ত সংবাদ-সাময়িক পত্রগুলি ধর্ম প্রচারে, সমাজ সংস্কারে, জ্ঞানবিকাশে, মনন চর্চায় এবং সর্বোপরি বাংলা গদ্যের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct