সমাজতন্ত্রের ভারতীয় সংস্করণ নয়। এটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক মতাদর্শ যা বর্ণ ও লিঙ্গ ভিত্তিক ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ, সাংস্কৃতিক ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতা এবং অহিংস প্রতিরোধের সঙ্গে অর্থনৈতিক সমতার খোঁজকে একত্রিত করেছে। ভারতীয় সমাজতন্ত্র তাই দেশীয় সমাজতন্ত্র। বিগত যুগের ভুলে যাওয়া ইতিহাস কেন আমরা স্মরণ করব? প্রধান কারণ এই রাজনৈতিকভাবে দুর্বল এবং খণ্ডিত আন্দোলন আজ একটি অদ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এ নিয়ে লিখেছেন যোগেন্দ্র যাদব। আজ শেষ কিস্তি।
সর্বপ্রথমে, ভারতীয় সমাজতন্ত্রীরা কঠোরভাবে জাতীয়তাবাদী। আসলে এটিই ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁদের মৌলিক পার্থক্য। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যখন কমিউনিস্টদের অম্ল-মধুর সম্পর্ক ছিল, সমাজতন্ত্রীরা দৃঢ়ভাবে কংগ্রেসের নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে নিজেদের সংযুক্ত করেছিলেন। তাঁদের জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ ছিল না। সমাজতন্ত্রীরা ইতিবাচক এবং অগ্রগামী জাতীয়তাবাদের নেতৃস্থানীয় কণ্ঠস্বর ছিলেন যা সারা বিশ্বের ঔপনিবেশিকতা বিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিল। স্বাধীনতার পর, তাঁদের জাতীয়তাবাদ হয়ে ওঠে প্রধানত জাতি নির্মাণ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। কিন্তু তাঁরা ১৯৬২ সালে পরাজয়ের দিকে এগিয়ে চলা নেহরুর চিন নীতির সমালোচনা করতে পিছপা হননি। আজ যখন বিজেপি-আরএসএস দেশের বাইরে এবং ভিতরে কল্পিত শত্রুদের ধ্বংসাত্মক রাজনীতিকে প্রতিরোধ করার জন্য জাতীয়তাবাদের আহ্বান জানায়, তখন উদারপন্থী এবং বামপন্থীরা কিন্তু ভুল দিকে চলছেন। আপনি কোনো বিমূর্ত আন্তর্জাতিকতাবাদের সাহায্যে বিজেপির আক্রমণাত্মক জাতীয়তাবাদকে রুখতে পারবেন না। ভারতীয় সমাজতন্ত্রীদের ইতিবাচক জাতীয়তাবাদ আজকে ভ্রমাত্মক, বিদ্বেষমূলক জাতীয়তাবাদের কার্যকর প্রতিষেধক হতে পারে।
এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক আত্মসম্মানের রাজনীতিও জড়িয়ে আছে। বিজেপি ভারতীয় (পড়ুন হিন্দু) সভ্যতা ও সংস্কৃতির কথা বলে গর্ব প্রকাশ করে। ঔপনিবেশিক অতীত মুছে ফেলার প্রতীকী ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে প্রতিটি ভারতীয়র আত্মসম্মানকে জাগানোর ডাক দেয়। মুসলিম শাসকদের সময়কালকে ঔপনিবেশিক অতীতের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার গৌরব উদযাপনের বাস্তব এবং কাল্পনিক যুক্তি সাজিয়ে রাখে। ইংরেজি আধিপত্যকে আক্রমণ করে ভোট পাওয়ার চেষ্টা করে। বিজেপির সমালোচকরা উল্লেখ করেছেন যে এর বেশিরভাগই ফাঁকা বুলি। এই প্রতীকী মূল্য আসলে তুচ্ছ এবং তারা যে ইতিহাসের জন্য আহ্বান জানায় তা নকল। কিন্তু সাংস্কৃতিক আত্মসম্মানের জন্য তারা বিকল্প কোনো কারণ দেখায় না। ইংরেজদের প্রতি তাদের প্রতিরোধ ঔপনিবেশিকতা বিরোধী নয়, বরং এলিটিস্ট মনে হয়। ভারতীয় সমাজতন্ত্রীরা দেশীয় প্রেক্ষিত থেকে আমাদের সভ্যতার ঐতিহ্যকে সম্মান জানায়। ইংরেজির আধিপত্য নিয়ে তাঁদের সমালোচনা হিন্দির আধিপত্যকে সমর্থন না করে বিকল্প সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রস্তাব দেয়। ধর্মের প্রতি তাঁদের সহমর্মিতা নাস্তিকদের মতো নয়। সাধারণ আস্তিক ভারতীয়দের অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়ার পরিবর্তে কথোপকথনের পথ খোলা রাখে। তৃতীয় উপাদান হল সামাজিক ন্যায়বিচারের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি, বিশেষ করে বর্ণবৈষম্যের বিরোধিতা। আম্বেদকর ছাড়া ভারতীয় সমাজতন্ত্রীরাই প্রথম জাতিভেদকে ভারতীয় সমাজে বৈষম্যের অন্যতম প্রধান কারণ বলে মেনে নিয়েছিলেন। সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপের দাবি করেছিলেন (যে অংশের মধ্যে তফশিলি জাতি ও উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী, সংখ্যালঘু এবং মহিলারা আছেন)। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পেছনে ছিল সমাজতান্ত্রিক দলগুলো। বর্তমানে সেই উত্তরাধিকারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দলিত-বহুজন ঐক্য বর্তমান আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হয়ে উঠতে পারে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সমাজের সকল অনগ্রসর অংশের ব্যাপক ঐক্যের জন্য আদর্শগত ও রাজনৈতিক ভিত্তি প্রদান করে।যদিও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, এই আন্দোলনের উত্তরাধিকারীরা কি সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব নেবেন? স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সব প্রকার নিপীড়ন ও কর্তৃত্ববাদকে প্রতিহত করার গৌরবময় নজির রেখেছেন সমাজতন্ত্রীরা। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মহত্তোম সময়ে তাঁরা কংগ্রেসের বিরোধী শক্তি ছিলেন। সেই প্রজন্মের বেশিরভাগ সমাজতন্ত্রীদের মতো মুলায়ম সিং যাদবও কংগ্রেসের কট্টর সমালোচক হিসেবে পরিচিত। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের উত্তরাধিকারীদের আজ এই পথটি সংশোধন করতে হবে। এখন বিজেপি সেই আধিপত্যের মুখ যা সাংবিধানিক গণতন্ত্র এবং ভারতের ঐক্যের ভিত্তিকে দমন করতে চায়। নতুন ভারতে নিজের ভূমিকা পালনের জন্য ভারতীয় সমাজতন্ত্রকে একটি নতুন জন্ম নিতে হবে। (সমাপ্ত)
লেখক ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা।
অনুবাদ: সুদীপ্ত রায়
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct