পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী রাজ্যপাল হিসাবে ড. সি ভি আনন্দ বোস কার্যভার গ্রহণ করেছেন। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। । সেই আবহে তেতে উঠেছে বাংলার রাজনীতি। রাজ্যপাল থাকাকালীন জগদীপ ধনখড় যেভাবে বারবার সংবাদ শিরোনামে এসেছেন। রাজ্যপালের অতি সক্রিয়তায় বহু বিশেষণে ভূষিত হয়েছে গরিমার পদটি। তিনি উপরাষ্ট্রপতি পদে চলে যাওয়ার পর অস্থায়ী রাজ্যপাল লা গণেশন ‘নিয়মতান্ত্রিক নীরবতা’ পালন করে গেলেন। রাজ্যপাল ও রাজ্যের সংঘাত এ নিয়ে লিখেছেন কাজী খায়রুল আনাম। আজ প্রথম কিস্তি।
পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী রাজ্যপাল হিসাবে ড. সি ভি আনন্দ বোস কার্যভার গ্রহণ করেছেন। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। শাসক ও বিরোধী দলগুলি প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। সেই আবহে তেতে উঠেছে বাংলার রাজনীতি। রাজ্যপাল থাকাকালীন জগদীপ ধনখড় যেভাবে বারবার সংবাদ শিরোনামে এসেছেন, রাজ্যপালের অতি সক্রিয়তায় বহু বিশেষণে ভূষিত হয়েছে গরিমার পদটি। তিনি উপ রাষ্ট্রপতি পদে চলে যাওয়ার পর অস্থায়ী রাজ্যপাল লা গণেশন ‘নিয়মতান্ত্রিক নীরবতা’ পালন করে গেলেন। নতুন রাজ্যপাল আনন্দ বোস প্রথম জীবনে কলকাতায় স্টেট ব্যাঙ্কের চাকরি করতে এসেছিলেন। তাঁর নামে সঙ্গে বোস এসেছে নেতাজির থেকে। আনন্দজি শুধুমাত্র একজন আইএএস নন। চল্লিশটি পুস্তকের প্রণেতা। একজন কবি। সর্বোপরি একজন বিদ্বান ব্যক্তি। স্বাভাবিক ভাবে বলা যায়, তাঁর পক্ষে অতি সক্রিয় হওয়া সম্ভব নয়। আবার নীরবতা পালন করাও কঠিন। রাজ্যপালের ভূমিকার দিকে নজর থাকবে। এখন নজর দেওয়া যাক একটু ইতিহাসের দিকে।
রাজ্যপাল পদের রাজনৈতিক ব্যবহার আজকের নয়। জনতা সরকার (১৯৭৭) একদিনে পশ্চিমবঙ্গ সহ নয়টি কংগ্রেস সরকার বরখাস্ত করে রাজপালকে কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট পর্যায়ে নামিয়ে আনে। অবশ্য কংগ্রেসও তাদের দীর্ঘ শাসনে রাজ্যপাল পদের দূরপ্রয়োগ করেছে বহুবার। আবার রাজ্যপাল দের সঙ্গে দূরব্যবহার করেছে স্লোগান বিপ্লবী বামেরাও। এনডিএ সরকার পূর্বতন জমানার রাজ্যপালদের পদত্যাগে বাধ্য করে স্বয়ংসেবকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। রাজভবন থেকেই রাজনীতি করার অভিযোগ যেমন আছে, রাজনীতিতে ফিরে যাবার নজিরও আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্যপাল পদের কি আদৌ প্রয়োজন আছে ? প্রশ্নটা অবশ্য আজকের নয়, অতীতের। রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান। পশ্চিমবঙ্গে নিয়ম ভেঙে রাজপালের অতি সক্রিয়তার প্রথম শুরুয়াত করেন ধরমবীর। অজয় মুখোপাধ্যায়ের সরকার (১৯৬৮) ভেঙে দিয়ে। তারও দশ বছর পূর্বে কেরালায় ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের সরকার (১৯৫৯) ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের ইতিহাসে সর্বপ্রথম। যদিও এই সরকার ভাঙার পিছনে কম্যুনিস্টদের ভূমিকা আজও আলোচনার বাইরে থেকে গেছে। ঘটনা হল, কম্যুনিস্টদের অনুরোধেই বামপন্থাকে রক্ষার জন্য ইএমএস সরকারকে ভেঙে দেওয়া হয়। কম্যুনিস্ট নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু ও কংগ্রেস সভানেত্রী ইন্দিরাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, অবিলম্বে কেরালায় কম্যুনিস্ট সরকার ভেঙে না দিলে যে ভাবে বামপন্থীরা ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন তাতে ভারতবর্ষে বামপন্থাকে রক্ষা করা যাবে না। বামেদের অনুরোধে ইএমএসকে বরখাস্ত করা হলেও বামেরা আজও নেহরু ইন্দিরাকে কেরলে সরকার ভাঙার জন্য আক্রমণ করে থাকেন।
বাম শাসনে পশ্চিমবঙ্গে বিতর্কের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কে রাজ্যপালদের ফিরিয়ে নিতেও বাধ্য করা হয়েছে। আবার তাঁদের ইচ্ছায় ভৈরব দত্ত পাণ্ডে বা সৈয়দ নুরুল হাসানদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আর রাজ্যপাল অনন্ত প্রসাদ শর্মার সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার বামেরা করেছেন তা নজিরবিহীন। শর্মার অপরাধ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে বামেদের পছন্দ রমেন পোদ্দারকে নিয়োগ না করে আচার্য হিসেবে সন্তোষ ভট্টাচার্যকে নিয়োগ করা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে শঙ্করী প্রসাদ মিত্রকে নিয়োগ করে একই কোপে পড়তে হয় উমা শঙ্কর দীক্ষিতের মতো মানুষকে। রাজ্যপাল হিসেবে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে অনেক ক্ষেত্রে সহযোগিতা পাননি টি ভি রাজেশ্বর, বীরেন জে শাহ। তবে বাংলার ইতিহাসে রাজ্যপাল গোপাল কৃষ্ণ গান্ধির ভূমিকা দীর্ঘকাল আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে। তিনি সরকার ফেলে দিতে পারেন নি ঠিকই কিন্তু ভারতবর্ষের কোনও রাজ্যপালের এমন অতি সক্রিয়তার নজির নেই। তারপরও জ্যোতি বসুর সরকার এপি শর্মাকে বয়কট করে যে সংঘাতের রাস্তায় হেঁটেছিলেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পূর্বসূরীর সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেন নি। ঘটনা হল, বুদ্ধদেব বাবুই গোপাল কৃষ্ণ গান্ধিকে পছন্দ বলে মিত্র (ইউ পি এ-১) সরকারকে জানিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বাবুর জন্যই গোপাল কৃষ্ণকে কোনোভাবেই অসম্মান করা সম্ভব হয় নি। তাঁর কথায় তিনি রাজভবনে গিয়ে বিরোধী নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। যদিও রাজ্যপালের আচরণ পরিবর্তন পন্থী দের কাজটিকে জনমনে গ্রহণ যোগ্যতা এনেদিয়েছিল। এরপরও উপ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে (২০১৭) বুদ্ধদেব বাবুর চেষ্টাতেই সিপিআইএম গোপাল কৃষ্ণ গান্ধিকে সমর্থন করে। কংগ্রেস জমানার শেষ তিন বছরের মধ্যে একবছর তৃণমূল জোটে ছিল। কিন্তু বাকি দুই বছর রাজভবনের সঙ্গে নবান্নের দ্বন্দ্ব সেভাবে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠেনি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct