স্নেহের ফল
গোলাম মোস্তাফা মুনু
বেশ কয়েকদিন ধরে মা-বেটিতে তর্ক-বিতর্ক চলছে। আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি। রিহানা রাগের মাথায় বলে ফেলে, ‘আমার সম্পত্তিগুলো আমাকে ফিরিয়ে দে। বাবার সম্পত্তির যত অংশ পেয়েছিলাম সবটাই তোকে লিখে দিয়েছি। আমি এটা ভুল করেছি। তোর নামে থাকলেই তুই বিক্রি করে ফেলবি।’ মেয়ে সাইনুরা মায়ের একথা শুনে চুপ হয়ে যায়। আর কোনো কথা বলে না। কিছুক্ষণ পর সাইনুরা কোমল সুরে বলে, ‘তোমার জামাইবাবু এটা মানবে না। এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না। তোমার জামাইবাবুকে বলো।’ ‘আমি তোকে লিখে দিয়েছি, তাই তোকেই বলবো। আমি তোদের পরিকল্পনা বুঝতে পেরেছি । তোরা এখানকার সব বিক্রি করে তোর শ্বশুরের ভিটাতে গিয়ে আবার বসবাস শুরু করবি। আর আমি কোনো উপায় না পেয়ে তোদের সাথে গিয়ে গোলামী করবো।’ মনে মনে কী ভেবে নিয়ে রিহানা এবার কেঁদে ফেলে। কেঁদে কেঁদেই সে বলে, ‘আমি কোনো দিনই সুখ পেলাম না। তোর বয়স যখন তিন মাস তখন তোর বাবা মারা যায়। তোকে বুকে নিয়ে আমি বাবার বাড়ি চলে আসি। সন্তান নিয়ে ভাই-ভাবিদের সাথে থাকা একজন বিধবার কী যন্ত্রনা; সেটা একজন বিধবা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। শত যন্ত্রণার মধ্য দিয়েও আবার স্বপ্ন দেখতাম, তোকে বড় করে বিয়ে দিয়ে তোর স্বামীকে ঘর জামাই করে রাখবো।রাখলামও। কিন্তু কাজের কাজ হল না। প্রতিদিন তোরা আমাকে মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছিস।’ সাইনুরা এবার যেন মনে মনে রেগে যায়। মাকে বলে, ‘তুমি তো প্রায়ই এসব বলে আমায় গঞ্জনা দাও। আমাকে ধরে কি বসে থাকতে বলেছিলাম আমি? তুমি আর একটা বিয়ে করে ঘর সংসার করলে না কেন? সুখ পেতে।’ মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে সাইনুর অবাক হয়ে যায়। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখে কোনো কথা নেই। খানিক পরেই চোখের জল মুছতে মুছতে সে নিজের ঘরে চলে যায়। খাটের এক কোণে বসে অপলকে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন মুহূর্তে বিগত দিনের ঘটনা তার স্মরণ হয় --‘তোর মেয়ের বয়স দশ বছর হয়ে গেল। তুই আর সময় নষ্ট করিস না। দেখে শুনে আর একটা বিয়ে করে ফ্যাল।’ তোর আর একটা সংসার গড়া খুবই দরকার। রিহানার মাথার উকুন বাছতে বাছতে কথাগুলো বলল বড় দিদি। দিদির কথা শুনে রিহানা নীরব থাকে। নীরব থাকে দিদিও। খানিক নীরবতার পর রিহানা বলে, ‘আমি বিয়ে করলে মেয়েটার কী দশা হবে ভেবেছিস দিদি? ও থাকবে কার কাছে? আমি ছাড়া ওর আর কে আছে?’
‘কেন? আমি যে আছি। তোর মেয়ে আমার কাছে থাকবে। ওকে নিয়ে তুই কোনো চিন্তা করিস না। তোকে নিয়ে আমার বড় ভাবনা হয়। তোকে বিয়ে করতেই হবে রিহানা। অনেক ছেলের খবর আছে আমার কাছে। এক মাসের মধ্যে আমি তোর বিয়ে দেবো। আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুই আর ‘না’ করিস না।’ এ বলে দিদি রিহানার চুলের খোপা বেঁধে দিয়ে চলে যায় রান্না ঘরের দিকে। আর রিহানা দু হাটুতে চিবুক রেখে বসেই থাকে। তিন মাস পর। রিহানার বিয়ে হয়ে যায়। রিহানার স্বামীর বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। তার স্ত্রী মারা গেছে। প্রথম পক্ষের দুটি ছেলে এবং দুটি মেয়ে আছে। সবার বিয়েথা হয়ে গেছে। এতদিন ছোট ছেলের কাছে থেকে সে খাওয়া দাওয়া করছিল। রিহানাকে বিয়ে করার পর সে আলাদাভাবে ঘর-সংসার শুরু করে।বেশ সুখেই কাটে তাদের দিন। একদিন সকালে রিহানার কাছে খবর আসে তার মেয়ে সাইনুরার মাথা ফেটে গেছে। গতকাল বিকালে। সাইনুরার মাসির ছেলে ঢিল ছুড়ছিল অন্যদিকে। হঠাৎ করে একটি ঢিল সাইনুরার মাথাতে লাগে। মাথা থেকে রক্ত ঝরতে শুরু হয়। কাল বিলম্ব না করে মাসি সাইনুরাকে গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার ইনজেকশন দেওয়ার পর মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন। সাইনুরা গতরাত্রে মা মা বলে কেঁদেছেও খুব। মা রিহানা এ খবর শুনে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না। স্বামীর অনুমতি নিয়ে তখনই ছুটে আসে মেয়ের কাছে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মা খুব কাঁদে। কাঁদে মেয়েও। রিহানা সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েকে নিজের কাছে রাখার। মেয়েও মায়ের কাছে থাকতে রাজি। আপাতত মা মেয়ের কাছে দু’দিন থেকে মেয়ের সেবা সুশ্রূষা করে। মা বিদায় কালে মেয়েকে বলে, ‘তুই আপাতত কয়েকটা দিন তোর মাসির কাছে থাক। কয়েকদিন পর আমি এসে তোকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো।’ মায়ের যাওয়ার মুহূর্তে সাইনুরা খুব কাঁদে। মা-ও চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। দীর্ঘক্ষণ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে থাকে সে। সেদিনই রাত্রে শোবার সময় সর্ষের তেল দিয়ে স্বামীর শরীর মালিশ করতে করতে রিহানা বলে, ‘জামিমের আব্বা, তোমাকে একটা কথা বলবো, তুমি মন খারাপ করো না। সাইনুরাকে আমি নিজের কাছে রাখতে চাই। তাই তোমার অনুমতি চাইছিলাম।’
রিহানার স্বামী দানেশ আলী উপুড় হয়ে শুয়েছিল। চিত হয়ে যায়। খানিক নীরব থেকে কী যেন সে ভাবতে থাকে। খানিক ভেবে নিয়ে পুনরায় উপুড় হয়ে যায়। তারপর সে বলতে শুরু করে, ‘রিহানা তোমার মেয়েকে তুমি এখানে আনতে চাইছো তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যদি ওরা তোমার মেয়েকে কষ্ট দেওয়ার মতো কথা বলে তাহলে...! থাক, কথা আর আগে বাড়াচ্ছি না। তুমি মনে কিছু করো না রিহানা। তোমার মেয়েকে এখানে না আনাই ভালো হবে।’ বলে দানেশ আলী নীরব থাকে। রিহানাও নীরবে স্বামীর পিঠ মালিশ করতে থাকে। পরেরদিন খুব সকাল সকাল বিছানা ত্যাগ করে রিহানা। সকালের বাসী কাজকর্ম সেরে ফেলার পর নাস্তা তৈরি করতে শুরু করে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে নাস্তা তৈরি হয়ে যায়। ইতিমধ্যে বিছানা ছেড়েছে দানেশ আলী। হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় মাদুর পেতে বসে সে-ও নাস্তা খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। রিহানা খাবার এনে তার সামনে রাখে। দানেশ খেতে শুরু করে। রিহানা ঘরের ভেতর যায়। মিনিট পাঁচেক পর ঘর থেকে সে বেরিয়ে আসে। হাতে একটি বড় ব্যাগ। দানেশ আলী রিহানার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী ব্যাপার রিহানা?’ ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে রিহানা বলে, ‘আমি চলে যাচ্ছি। অনেক চিন্তা ভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আর কোনোদিন আমি এখানে ফিরবো না। দ্বিতীয়বার বিয়ে করাটাই আমার ভুল হয়েছে। আমাকে ছাড়া মেয়ের খুব কষ্ট হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি। ও আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। ওর সাথেই আমার থাকা উচিত। তুমি আর আমাকে বাধা দিও না।’ দানিশ আলী এবার দাঁড়িয়ে যায়। রিহানাকে সে কোমল সুরে বলে, ‘রিহানা, তোমার মেয়ের যখন বিয়ে হয়ে যাবে তখন সে সব দুঃখ ভুলে যাবে। দেখবে তোমাকেও ভুলে যাবে। অধিকাংশ মানুষের এমনই স্বভাব।’ এ বলে দানিশ আলী কিছুক্ষন নীরব থাকে। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘বারবার বিয়ে করাকে মানুষ ভালো নজরে দেখে না। আমার আর ইচ্ছাও নেই। তুমি আর একবার ভালো করে ভেবে নাও।’ রিহানার কোনো সাড়া না পেয়ে দানেশ আলী পুনরায় বলতে শুরু করে, ‘স্ত্রীর কাছে স্বামীর চেয়ে আপন আর কেউ হয় না। কথাটা মনে রেখো রিহানা।’ রিহানা কোনো কথা না বলে চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আজ সেই ফেলে আসা দিনের ঘটনা স্মরণ করে রিহানা কাঁদতে শুরু করে। তার কানের কাছে একই বাক্য বারবার বাজতে থাকে, ‘স্ত্রীর কাছে স্বামীর চেয়ে আপন আর কেউ হয় না।’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct