গুণসম্পন্ন মূল্যবোধ আমাদের মন থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। শিক্ষক, মাতা-পিতাকে সম্মান করা, তাদের আজ্ঞা পালন, কর্তব্যপরায়ণ হওয়া উচ্চমানের চরিত্র। কিন্তু এখনকার প্রজন্মের যুবকদের মধ্যে সেই মনোভাবআগেকার মতো খুব একটা দেখা যায় না। আধুনিকীকরণ ও পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণ করার কারণে এই নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। এছাড়া, ঘৃণা, বিদ্বেষ মনোভাব, অসহনশীলতা, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, বেইমানি, নিষ্ঠুরতা, নেতিবাচক চিন্তাধারার ঘটনা বেড়েই চলেছে। এ নিয়ে লিখেছেন সেখ হাফিজুর রহমান।
যে কোনও ধারণা, যে কোনো অনুভূতি, কার্যকলাপ ও অভিজ্ঞতা যা মানব সমাজের জন্য উপকারী, দরকারি এবং সুফলপ্রদ। সেই বোধটাকেই বলা হয় সামাজিক এবং নৈতিক মূল্যবোধ। যেমন সততা,অন্যের কষ্টকে নিজের মতো করে ভাবা ইত্যাদি। এই মূল্যবোধগুলি আমাদের বলে দেয় কোনটি ভূল, কোনটি সত্য, কোনটি সৎ আর কোনটি অসৎ। এই বোধগুলি ভাল মন্দের মাপকাঠি। এটি বলে দেয় কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয়। মূল্যবোধ আছে বলেই আমরা এক্যবদ্ধ ভাবে সংযুক্ত ও সংশক্তিপ্রবণ। মূল্যবোধ সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি আনে ও সেটাকে বজায় রাখে। এর অভ্যাস করলে সামাজিক বন্ধন মজবুত হয়। যার ফলে সমাজের অগ্রগতি ঘটে। কিন্তু, পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে এইসব গুণসম্পন্ন মূল্যবোধ আমাদের ব্যবহার, কার্যকলাপ এবং মন থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। শিক্ষক ও মাতা-পিতাকে সম্মান করা, তাদের আজ্ঞা পালন করা ও কর্তব্যপরায়ণ হওয়া উচ্চমানের চরিত্র। কিন্তু এখনকার প্রজন্মের যুবকদের মধ্যে সেই মনোভাব, মনোবৃত্তি, আগেকার মতো খুব একটা দেখা যায় না। আধুনিকীকরণ ও পাশ্চাত্যের অনুকরণ করার কারণে এই নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। এছাড়া, ঘৃণা, বিদ্বেষ মনোভাব, অসহনশীলতা, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, বেইমানি, নিষ্ঠুরতা, নেতিবাচক চিন্তাধারার ঘটনা বেড়েই চলেছে। ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক স্তরে ও মূল্যবোধ হ্রাস পেয়েছে। যেমন আমরা স্বার্থপর হয়ে গেছি, শুধু নিজেকে বুঝি, নিজের আয়েস-আরামটাই চাই। যে কোনো প্রকারে যেমন করেই হোক, জিততে হবে, নম্বর ওয়ান হতে হবে।
অন্যের বা পাড়া-প্রতিবেশীর কষ্ট, সমস্যাকে উপেক্ষা করে শুধু নিজের উন্নতির জন্য লাফিয়ে লাফিয়ে অগ্রসর হতে হবে। আমাদের এই রূপ মানসিকতা, চিন্তাধারা এবং ব্যবহার প্রমাণ করে দেয় যে সমাজে মূল্যবোধ গভীরভাবে বিপন্নময় হয়ে যাচ্ছে। এই বিপন্নময় পরিস্থিতিকে এমনভাবে চলতে দেওয়া যায় না, আমাদের সমুচিত পদক্ষেপ নিতে হবে। তা নাহলে আমাদের ঐতিহ্য সম্পন্ন সভ্য দেশ হিসেবে আমাদের পরিচয় মুছে যাবে। তাই, অবিলম্বে মূল্যবোধ শিক্ষা স্কুলে স্কুলে শুরু করতে হবে। সমকালীন বুদ্ধিজীবীগণ, লেখক, শিক্ষাবিদ ও মনোবৈজ্ঞানিকগণ এই বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। যেমন এনসিআরটি, সিবিএসই মূল্যবোধ শিক্ষার উপর নির্দেশিকাও তৈরি করে দিয়েছে, তা সত্ত্বেও স্কুলে সেগুলোর ঠিকমতো অনুসরণ করা হয়নি। যেহেতু স্কুলই একমাত্র উপযুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেখানে অন্যান্য পাঠ্য বিষয়ের সঙ্গে মূল্যবোধ শিক্ষা পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু, বিড়ম্বনা হচ্ছে যে অভিভাবক ও অনেকেই এই শিক্ষাকে একটা অতিরিক্ত বোঝা মনে করে থাকে। এটাকে তাদের ছাত্রদের উপর জবরদস্তি চাপানো হচ্ছে বলে মনে করা হয়। এটা একটা ভূল ধারণা। এই ভুল ধারণাগুলোকে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি দ্বারা দূরীভূত করতে হবে। তাদেরকে এই শিক্ষার লাভ, মহত্ব, এবং প্রাসঙ্গিকতাকে অবগত করাতে হবে। মূল্যবোধ শিক্ষার বিষয়ে বিদ্বান ও পণ্ডিতগণ কী বলে গেছেন?
১. সুপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক আ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলছেন: “সফল মানুষ হওয়ার চেষ্টা না করে একজন মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হবার চেষ্টা কর।
২. প্রয়াত ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেছিলেন, ‘মূল্যবোধ বিহীন শিক্ষা সুগন্ধবিহীন ফুলের মতো।’ মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘আপনার বিশ্বাস আপনার চিন্তাধারা হয়ে ওঠে, আপনার চিন্তাধারা আপনার কথা হয়ে ওঠে, আপনার কথা আপনার কর্মে পরিণত হয়, আপনার কর্ম আপনার অভ্যাস হয়ে যায়, আপনার অভ্যাস আপনার মূল্য হয়ে ওঠে, আপনার মূল্য আপনার ভাগ্য হয়ে ওঠে।’ তাহলে মূল্যবোধ মানুষের মধ্যে থাকা এবং মূল্যবোধ শিক্ষা প্রদান করা যে কতই না বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন তা স্পষ্ট হয়ে গেল। এর প্রাসঙ্গিকতা আছে বলেই শিক্ষাবিদ বারাক রোজেনশাইন, জোহান হার্বট, পাওলো ফিরেরে, ডা. জ্যোতি কুমটা, ডা. অনিতা পাঠানিয়া মূল্যবোধ শিক্ষার উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। অতএব, সেই অনুসারে আমাদের সকলকে সংশ্লিষ্ট সংস্থা, ও বিশেষজ্ঞদের সাথে জোট বেঁধে এই কাজে অগ্রসর হতে হবে। নতুন প্রস্তাবনা, নতুন পরিকল্পনা এবং নতুন অধ্যাপনা-বিদ্যার উন্নতি ঘটাতে হবে। যেমন শিক্ষকদেরকে ট্রেনিং দিতে হবে।
৩. প্রয়োজন অনুসারে অধ্যাপনা-বিদ্যা ডেভেলাপ করতে হবে।
৪. মাতা-পিতা, অভিভাবক এবং সম্প্রদায়কে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জাগ্রত করতে হবে।
৫. স্কুলের গোটা পরিবেশটাকে ইতিবাচক করতে হবে।
লেখক ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct