পারস্য সাম্রাজ্যের সবচেয়ে দুধর্ষ সেনারা (‘দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস’)
ফৈয়াজ আহমেদ
প্রাচীন পারস্যে দেশের প্রথম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় রাজা সাইরাসের হাত ধরে। সেই রাজা সাইরাস, যিনি প্রায় যাযাবর কিছু গোষ্ঠী নিয়ে গড়ে ওঠা একটা রাজ্যকে মাত্র পনের বছরের মধ্যে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করে ছিলেন। তাকে বলা হতো ‘রাজাদের রাজা’। নিজে তো একজন দুধর্ষ যোদ্ধা ছিলেনই, তার পাশাপাশি প্রাচীন পারস্যের প্রথম সাম্রাজ্যকে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দেয়ার মধ্যে দিয়েই প্রমাণিত হয় যে তার সাম্রাজ্য পরিচালনার দক্ষতাও ছিল অসাধারণ। আধুনিক সময়ে প্রতিটি দেশেরই সেনাবাহিনীর সাধারণ সেনাদের পাশাপাশি বিশেষ সামরিক ইউনিট থাকে, যে ইউনিটের যোদ্ধারা অন্য সেনাদের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষতার অধিকারী হয়ে থাকে। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ‘দ্য গ্রেট’ সাইরাস ভালোভাবেই এই ধরনের বিশেষ সামরিক ইউনিটের গুরুত্ব অনুধাবন করতে সমর্থ হন। তার বিশেষ সামরিক ইউনিট তার সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। রাজা সাইরাসের বিশেষ সামরিক ইউনিটের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে ‘দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস’ নামে। নামকরণ নিয়ে একটি ছোটখাট বিতর্ক রয়েছে। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, এই বিশেষ ইউনিটের নাম ছিল ‘আনুসিয়া’, (Anusiya), যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘সঙ্গী’। তবে যারা এই ইউনিটকে ‘দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস’ বলে থাকেন, তাদের দাবির পেছনে শক্ত যুক্তিও রয়েছে। বলা হয়, এই বিশেষ ইউনিটের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল দশ হাজার। এই দশ হাজার সৈন্যের মধ্যে একজনও যদি আহত হতো বা মারা যেতো, তাহলে তৎক্ষণাৎ তার পরিবর্তে রিজার্ভে থাকা আরেকজন যোদ্ধা দ্বারা তার শূন্যস্থান পূরণ করা হতো। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, মূল দশ হাজার সৈন্যের বিশেষ ইউনিটের পেছনে আরেকটি ছোট ‘ইমমর্টালস’ দল প্রস্তুত রাখা হতো সবসময়, যাতে যুদ্ধের সময় বা অন্য যেকোনো কারণে কোন যোদ্ধা আহত হলে তাকে আরেকজন ‘ইমমর্টাল’ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যায়। সুতরাং এই দশ হাজার সৈন্যের বিশেষ ইউনিটকে কখনোই দমানো যেত না, মেরে ফেলা যেত না, থামানো যেত না। কারণ সবসময়ই এই ইউনিটে দশ হাজার সৈন্য থাকতো। এভাবেই তাদেরকে ‘দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস’ হিসেবে নামকরণ করা হয়।
‘দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস’ ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, এই ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ‘পান্তিয়া আর্তেশবদ’ নামের এক নারী কমান্ডার, যাকে রাজা সাইরাস নিজের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাবিলন শাসন করতে পাঠান। পান্তিয়া আর্তেশবদ এই অভিজাত বাহিনী গঠন করেন ব্যবিলনকে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যগুলোর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। তবে বিখ্যাত গ্রীক ইতিহাসবিদ জেনোফোন এই বিশেষ সামরিক ইউনিট গঠনের মূল কৃতিত্ব দেন আকেমেনিদ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ‘কিং অব দ্য কিংস’ সাইরাসকেই। তার মতে, রাজা সাইরাস তার তৎকালীন সেনাবাহিনী ‘দ্য স্পাডা’র সবচেয়ে দুধর্ষ সেনাদেরকে নিয়ে এই ইউনিট গঠন করেন, যার প্রাথমিক কাজ ছিল রাজপ্রাসাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যার নামই আসুক না কেন, রাজা সাইরাস ও তার উত্তরসূরীরা সবাই সুনিপুণ দক্ষতার সাথে এই বাহিনীকে কাজে লাগান নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও যুদ্ধক্ষেত্রের গতিপথ পাল্টে দেয়ার ক্ষেত্রে। প্রায় দু’শো বছর টিকে থাকা আকেমেনিদ সাম্রাজ্যের সফলতার পেছনে এই ইউনিটের ভূমিকা যেকোনো ইতিহাসবিদ নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন। মূলত পারস্যের অধিবাসীদের মধ্য থেকেই এই বিশেষ সামরিক ইউনিটের সদস্যদের বাছাই করা হতো। তবে সমস্ত অধিবাসীদের মধ্যে থেকে নয়, বরং সমাজের সবচেয়ে অভিজাত ব্যক্তিদের মধ্যে থেকেই বাছাই করা হতো। পরবর্তীতে মিডিয়ান ও এলামাইট রাজ্য রাজা সাইরাসের অধীনে চলে আসলে এই দুই রাজ্য থেকেও এই বিশেষ ইউনিটের সদস্য বাছাই করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই দুই রাজ্য ছিল রাজা সাইরাসের একসময়ের শত্রু, সুতরাং অনাগত ভবিষ্যতে এই দুই রাজ্য থেকে বাছাই করা সদস্যদের বিশ্বাসঘাতকতার একটা প্রশ্ন তার সামনে ছিল। কিন্তু এই ইউনিটে তাদের উপস্থিতি দেখে রাজা সাইরাস যে বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি মোটেও পাত্তা দেননি, সেটি সহজেই বোঝা যায়।
আকেমেনিদ সাম্রাজ্যের পুরো দু’শো বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, যেসব রাজ্য একসময় রাজা সাইরাসের বিরোধিতা করেছিল, পরবর্তীতে জয়ের পর সেসব রাজ্য থেকে বাছাই করা ‘ইমমর্টালস’রা কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। তাদেরকে খুব নিখুঁতভাবে নিয়োগ দেয়া হতো, যাতে এই বিশেষ সামরিক ইউনিটের মান কখনও পড়ে না যায়। সাধারণত পাঁচ বছর বয়স থেকেই আকেমেনিদ সাম্রাজ্যের সৈন্যদলে অন্তর্ভুক্ত হতে চাওয়া শিশুদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যেত। প্রাথমিকভাবে তাদের ঘোড়ায় আরোহন করা, শিকার করা, তীর ছোড়া ইত্যাদির প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। বিশ বছর বয়সে গিয়ে তারা ‘দ্য স্পাডা’ বাহিনীতে সৈন্য হিসেবে নিয়োগ পেতো। এই সৈন্যদের মধ্যে থেকে চারিত্রিকভাবে সবচেয়ে দৃঢ় এবং সামরিক দিক থেকে সবচেয়ে দক্ষ সৈন্যদের এই বিশেষ সামরিক ইউনিটে নিয়ে আসা হতো, যারা ছিল আকেমেনিদ সাম্রাজ্যের মোট সৈন্যের মাত্র দশ শতাংশ। এই সৈন্যদের মূল অস্ত্র ছিল ছয় ফুট দৈর্ঘ্যের বর্শা, যার সামনের দিকটি ছিল অত্যন্ত ধারালো। এছাড়া এই বর্শার পেছনের দিকটি ছিল আপেল আকৃতির, যেটির একটি আঘাত প্রতিপক্ষ সৈন্যের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল। ‘দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস’ ইউনিটের সদস্যরা মাথায় ‘তিয়ারা’ নামের একটি মুখোশ পরিধান করতেন, যেটি বাতাস ও ধূলোর বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতো। এছাড়াও স্বর্ণের অনেক অলংকারও পরিধান করতেন তারা। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের জন্য আলাদা করে বিশেষ খাবার বরাদ্দ ও দাসদাসী নিয়োজিত থাকতো। সমাজে তাদের অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হতো।
ইতিহাস বলে, যুদ্ধের সময় সাইরাসের সেনাবাহিনীর সবার সামনে থাকতো তীরন্দাজরা। এরপরই থাকতো ‘দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস’রা। তাদের কাজ ছিল তীরন্দাজরা যেন নির্বিঘ্নে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারে সেক্ষেত্রে সহায়তা করা। আর পাশে থাকত অশ্বারোহী বাহিনী। মিডিস, লিডিয়া, ব্যাবিলন– প্রায় সব রাজ্যজয়ের ক্ষেত্রেই এই সামরিক ইউনিটের বিশেষ ভূমিকা ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৫২৫ সালে রাজা সাইরাসের সন্তান রাজা দ্বিতীয় ক্যাম্বাইসিসের হাতে পরাজিত হন মিশরের ফারাও তৃতীয় সামতিক। পেলুসিয়ামের সেই যুদ্ধে মিশরের তৎকালীন ফারাওকে পরাজিত করতে দুর্দান্ত ভূমিকা রাখে ইমমর্টালস বাহিনী। এই যুদ্ধে জয়ের ফেলে আকেমেনিদ সাম্রাজ্যের আয়তন একেবারে মিশর পর্যন্ত প্রসারিত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের উৎকর্ষতা দেখে সিনাই ও জুদিয়ার আরব ও সাইপ্রিয়টরা যুদ্ধের পরিবর্তে রাজা সাইরাসের সাথে মিত্রতা স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। আকেমেনিদ সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট দারিয়ুসও সিন্ধু ও পাঞ্জাব জয়ের ক্ষেত্রে এই সামরিক ইউনিটকে ব্যবহার করেন। আকেমেনিদ সাম্রাজ্যের প্রসারের পেছনে সবসময়ই ভূমিকা রেখেছিল ‘দ্য পার্সিয়ান ইমমর্টালস’ ইউনিট। সাইরাসের হাত ধরে যে বিশেষ বাহিনীর যাত্রা শুরু হয়েছিল,পরবর্তী দু’শো বছরে সেই বাহিনী ছিল সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সফলতার সমার্থক শব্দ। যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের সবটুকু নিংড়ে দেওয়ার গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লে আকেমেনিদ সমাজে এই বিশেষ ইউনিটের সদস্যদের মর্যাদা বহুগুণ বেড়ে যায়। পঞ্চাশ বছরে পা রাখলে সাধারণত এই ইউনিটের সদস্যদের অবসরে যেতে হতো, যাতে তরুণ সৈন্যদের এই ইউনিটে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়৷ অবসরের পর এই সৈন্যদের জীবনযাপনে যেন সমস্যা না হয়, সেজন্য সম্রাটের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ভাতা ও জমির মালিকানা প্রদান করা হতো। অবসরের পরও এই ইউনিটের সদস্যরা সমাজের সবার কাছে যথাযথ মূল্যায়ন পেতেন।
তথ্য সুত্র: ইন্টারনেট
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct