বিশেষ প্রতিবেদক, কলকাতা, আপনজন: দেশবিভাগ পরবর্তী নয়া প্রজন্ম থেকে উত্থিত খাজিম আহমেদ (জন্ম ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭) জন্মগ্রহণ করেন মুর্শিদাবাদ জেলার রানীনগরে অবস্থিত কাতলামারির মালিপাড়া গ্রামে। বস্তুত তিনি প্রবন্ধ নির্মাণের ক্ষেত্রে কাজী আবদুল ওদুদ রেজাউল করিম আর এম. আবদুর রহমানের উত্তরসূরী হিসেবে নিজের মেধা আর মননকে নিজস্বতার খোঁজে নিরপেক্ষতা এবং বৃহত্তর নৈর্ব্যক্তিকতার প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করছেন। অনির্বচনীয় প্রকাশ স্টাইল তার শব্দ ব্যবহার দুর্বোধ্য প্রবন্ধ পাঠকেও সুখপ্রদ করে তোলে। আর বিষয় নির্বাচনে খাজিম আহমেদের সমাজ মনস্কতা পুনঃ পুনঃ আমাদের চমকিত করে। দেশ বিভাগজনিত কারণে একটি আন্তর্জাতিক এবং একেশ্বরবাদী জাতিসত্তার প্রতি যে অবিচার এবং ‘দূরমুশ’ করার প্রবণতা ক্রিয়াশীল ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের মনে তার বিরুদ্ধে যে যৌক্তিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তা প্রখর নির্ভীকতার পরিচয়বাহী। ‘বেসুমার’ মুগ্ধতা নিয়ে প্রকাশক হিসেবে তাঁর প্রথম অসাধারণ প্রবন্ধগ্রন্থ ‘পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা’ পাঠক সজ্জনের দরবারে পেশ করি। প্রবন্ধগ্রন্থ এমনভাবে সমাদৃত হবে তা চিন্তার অগোচর ছিল। সোজাসুজি বলতে কি বাংলা আর ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোতে ২০১২-তে ব্যাপক সুখ্যাতি করা হয়েছিল। আজও-বেঙ্গলি পত্র-পত্রিকায় উক্ত গ্রন্থটির রিভিউ হচ্ছে। প্রথম মুদ্রণ নিঃশেষিত। দ্বিতীয় সংস্করণ ‘উদার আকাশ প্রকাশন’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। লকডাউন আমাদের বিড়ম্বিত করেছে। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন বিগত চুয়ান্ন বছর অগণন প্রবন্ধ তাঁর পত্রস্থ হয়েছে, অথচ সেগুলো গ্রন্থাকারে পাওয়া গেল না কেন? এমনবিধ প্রশ্ন আমার মনেও ছিল। জনাব আহমেদকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করায় দ্বিধাহীন উত্তর করলেন, ‘এই অকৃতী অধমের কাজ হলো লেখা, পাঠক পড়বেন, প্রকাশক বই ছাপাবেন, এটাই তো দস্তুর। বই প্রকাশ আমার কর্ম নয়।’ এমনই নির্মোহ তাঁর মানস ভাবনা। ‘উদার আকাশ পত্রিকা’র সম্পাদক এবং ‘উদার আকাশ প্রকাশন’-এর পরিচালক হিসাবে আমি তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিকে গ্রন্থবদ্ধ করার অভিপ্রায় এবং অভিলাষ পোষণ করি। আমার পরম শ্রদ্ধেয় অভিভাবক তুল্য খাজিম আহমেদ সানন্দে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। মল্লিক ব্রাদার্স, প্রভিনিসিয়াল বুক এজেন্সি, নবজাতক প্রকাশন, লেখা প্রকাশনী, বুকস ওয়ে, অভিযান পাবলিশার্স, সর্বোপরি প্রবাদপ্রতিম মিথ বা কিংবদন্তি প্রকাশন সংস্থা ‘হরফ প্রকাশনী’র উত্তরসূরি হিসেবে ‘উদার আকাশ প্রকাশন’ বিগত এক দশকে প্রায় শতটি গ্রন্থ সফলভাবে প্রকাশ করেছে। সাহিত্যের সব শাখাতেই এই নয়া আর তরতাজা প্রকাশন বিচরণ করেছে।পাঠকবর্গের স্নেহ-ভালবাসা, পৃষ্ঠপোষকতা আমাদের পরমপ্রাপ্তি। স্বভাবতই নত-মস্তক হচ্ছি।
দেশবিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবাংলার জাতিসত্তা বিষয়ক অনন্য সাধারণ প্রাবন্ধিক ইতিহাসবেত্তা উপমহাদেশ বিষয়ক সমাজ বিজ্ঞানী খাজিম আহমেদের দীর্ঘ জীবন চর্চিত অজস্র প্রবন্ধাবলির মধ্য থেকে ১৮টি দিকনির্দেশক গবেষণা ‘উদার আকাশ প্রকাশন’ থেকে ‘বাঙালি মুসলমান : আপন ভুবনের সন্ধানে’-এর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ প্রকাশের সুযোগ পেয়ে নির্মল গর্বানুভব করছি। সততার সঙ্গে উচ্চারণ করি ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের মে মাস থেকে ২০১৯-এর ২৫ ডিসেম্বর তক জনাব খাজিম আহমেদ ‘ডেডলি ডিজিজ’-এর সঙ্গে লড়াই করছিলেন এবং অবশেষে তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। দীর্ঘদিন বাদে তাঁর লেখক সত্তাকে পুনরুজ্জীবিত করার সওয়ালে শ্লাঘা বোধ করছি। ‘উদার আকাশ প্রকাশন’ হরওয়াক্ত তাঁর পাশে রয়েছে। ‘উদার আকাশ পত্রিকা’য় দেড় ডজনের ওপর প্রথাবিরোধী কঠোর পরিশ্রম সাধ্য গবেষণাজাত প্রবন্ধ খাজিম আহমেদ লিখেছেন। সমালোচনা, নানাবিধ মূল্যায়ন ছয় দশকের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও ‘উদার আকাশ’ শীর্ষক রচনা বিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবাংলার ৬০ বছরের এক ঐতিহাসিক দলিল ভবিষ্যতের জন্য রেখে গেলেন। বিশেষত ইসলামী সভ্যতার গৌরবময় ইতিহাসের পুনরুদ্ধার, উপেক্ষিত ও বিস্মৃত মুসলিম ব্যক্তিত্ব, ভারত ইতিহাসে মুসলিম শাসকদের ভূমিকাকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে ভ্রান্তির ড়োজালে জড়িয়ে উত্থাপনের বিরুদ্ধে প্রকৃত সত্য আহরণ, বিভাগ-পরবর্তী এ বাংলায় মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা প্রভৃতি ইতিহাস ও সমাজভিত্তিক প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ভুল বোঝাবুঝি ও মানসিক দূরত্ব অবসানের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকেন।১৩ বলাবাহুল্য নিজস্বতার খোঁজে তাঁর রচিত রচনাগুলো মূল্যবান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে।
‘বাঙালি মুসলমান : আপন ভুবনের সন্ধানে’ নামাঙ্কিত এই গ্রন্থের বিষয়সমূহের মর্মবস্তু সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকার পুরো জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিল ইসলামধর্মী। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর জনবিন্যাসের পরিবর্তন হয়ে যায়।১৪ এর ফলে নানা মুসিবতের জন্ম নেয়। বস্তুত বর্তমান গ্রন্থটিতে নিজস্বতার খোঁজে, মর্যাদার সন্ধান, আত্মচেতনার বিকাশ আর স্বরূপ সন্ধান প্রয়াসী হয়েছেন বর্তমান গবেষক ও লেখক। এ বিষয়ে ড. রফিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন ‘A Quest for Identity ; Preface’ ‘দ্য বেঙ্গল মুসলিমস’, ১৮৭১-‘০৬। Richard M. Eaton ‘The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760’ নামক গ্রন্থে (Copyright: The Regents of the University of California) লিখেছেন, ‘In 1984 about 93 million of the 152 of the estimated 96.5 million people inhabiting Bangladesh, 81 million or 83 percent. Were Muslims in fact, Bengalis today comprise the second largest Muslim ethnic population in the world, after the Arabs.’ উপাদানের সূত্র: Richard V. Weekes, Ed. Muslim Peoples: A World Ethnographic Survey, 2nd Ed. (Westport Green Wood Press). (Page-2). এমন বিশাল সংখ্যক বাঙালি মুসলমানদের বেদনার কথাটি ডক্টর এ আর মল্লিক প্রকাশ করেছেন এইভাবে, ‘বাঙালি মুসলমানদের বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে তাদের মন্থর ও বিলম্বিত অভ্যুত্থান। এখনও সেই বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গে অনেকাংশে প্রযোজ্য।’ সেই ‘পরাভব; চেতনা’ থেকে মুক্ত হবার পথ সন্ধান করা হয়েছে ‘বাঙালি মুসলমান : আপন ভুবনের সন্ধানে। অসাধারণ মননদীপ্ত এই প্রবন্ধগুলো খাজিম আহমেদের স্বীয় মনস্বিতার দ্বারা অর্জিত সম্পদের এবং তদজাত ওজস্বীতার ফসল। ‘চতুরঙ্গ’- সম্পাদক, আবদুর রাউফ; ‘মাসিক কাফেলা’- সম্পাদক আবদুল আজিজ আল্-আমান; ‘বর্তিকা’-সম্পাদক, মহাশ্বেতা দেবী; ‘কলম’ এবং ‘পুবের কলম’- সম্পাদক, আহমেদ হাসান; ‘জনমত’-সম্পাদক, রাধারঞ্জন গুপ্ত; ‘গণকণ্ঠ’-সম্পাদক, প্রাণরঞ্জন চৌধুরী; ‘অণীক’ এবং ‘মুর্শিদাবাদ বীক্ষণ’-সম্পাদক, দীপঙ্কর চক্রবর্তী; ‘আবার এসেছি ফিরে’, ‘এবং পুনশ্চ’-সম্পাদক, এবাদুল হক, সর্বোপরি ‘উদার আকাশ পত্রিকা’য় বিভিন্ন সময়ে প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হয়েছিল। সম্পৃক্ত পত্রিকার পরম শ্রদ্ধেয় সম্পাদক মহোদয়দের ‘উদার আকাশ প্রকাশন’-এর পক্ষ থেকে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। ‘মৌলানা আজাদ এক নিঃসঙ্গ পদাতিক’ অতিসম্প্রতি মুদ্রিত হয়েছিল জাইদুল হক সম্পাদিত দৈনিক ‘আপনজন’ পত্রিকায়। ‘উদার আকাশ প্রকাশন’, উদার জীবনের অন্বেষণ আর ‘কম্পোজিট কালচার’ (মিশ্র সংস্কৃতির আবহমান ধারা)-এ বিশ্বাস করে। সেই সুবাদে ‘বাঙালি মুসলমান : আপন ভুবনের সন্ধানে’ গবেষণা গ্রন্থটি সুজন পাঠকদের দরবারে হাজির।২৫ বলা সংগত যে, দেশ বিভাগের পর মুসলমানদের জীবন সাধারভাবে দিন যাপনের গ্লানিতেই আচ্ছন্ন ছিল। দেশ গঠন ও নির্মাণের জন্য তারাও যে কিছু করতে পারে সে ভাবনাটিকে তারা রূপ দিতে পারছিলেন না।উদার আকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে খাজিম আহমেদ-এর এই ঐতিহাসিক গ্রন্থ। পাঠক দরবারে সমাদৃত হয়েছে। ইতিমধ্যে বেস্টসেলার গ্রন্থ দুটো সংগ্রহ করতে গবেষকদের মধ্যে চাহিদা তৈরি হয়েছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct