বিষাদ সিন্ধু মীর মশাররফ হোসেনের লেখা এক মহাকাব্য
এস ডি সুব্রত
বাংলা সাহিত্যের এক নন্দিত প্রতিভা মীর মশাররফ হোসেন। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা গদ্য সাহিত্যের ধারায় মুসলিম লেখকদের তেমন কোন পদচারণা পরিলক্ষিত হয় না। মীর মশাররফ হোসেন যখন সাহিত্য সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত করেন তখন বাঙালি মুসলমান সমাজ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকে হারাম মনে করত । মীর মশাররফ হোসেনই বাংলা সাহিত্যের এই শূন্যতাকে পূর্ণতা দানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন । বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হােসেনের অমর সৃষ্টি ‘বিষাদ সিন্ধু । উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ মীর মশাররফ হােসেন। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক। বাংলার মুসলমান সমাজের দীর্ঘ অর্ধ-শতাব্দীর জড়তা দূর করে আধুনিক ধারায় ও রীতিতে সাহিত্য চর্চার সূত্রপাত ঘটে তার শিল্পকর্মের মাধ্যমেই। মশাররফ হােসেনের খ্যাতি মূলত ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থটির জন্যেই। বিষাদ সিন্ধু গ্রন্থের মূল বিষয় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর দৌহিত্র ইমাম হােসেনের সঙ্গে দামেস্ক অধিপতি মাবিয়ার একমাত্র পুত্র এজিদের কারবালা প্রান্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং
হাসান-হােসেনের করুণ মৃত্যু। এটি বাংলা সাহিত্যের একটি ধ্রুপদী উপন্যাস । শিল্পবােধ ও জীবনানুভূতি অনন্য প্রকাশে গ্রন্থটি মীর মশাররফ হােসেনের এক স্মরণীয় কীর্তি। কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাসের কাহিনি।বিষাদ সিন্ধু নামটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত। মানুষের নিয়তির এক নিষ্ঠুর বেদনাবহ পরিণতিই এ গ্রন্থের মূল উপজীব্য । এ উপন্যাসের তিনটি পর্ব রয়েছে । ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস বিষাদ সিন্ধু মােট তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ড মহরম পর্ব (১৮৮৫), দ্বিতীয় খণ্ড উদ্ধার পর্ব (১৮৮৭) এবং তৃতীয় খণ্ড এজিদ বধ পর্ব (১৮৯১); মােট ৬৩টি ভাগ নিয়ে গ্রন্থটি রচিত। মহরম পর্বে ২৬টি ভাগ, উদ্ধার পর্বে ৩০টি ভাগ এবং এজিদ বধ পর্বে ৫টি ভাগ; তাছাড়া উপক্রমণিকা ও উপসংহার রয়েছে। মহরম পর্বে এজিদের জয়নবকে না পাওয়ার বিরহ, আব্দুল জব্বার কতৃক জয়নবের তালাকপ্রাপ্তির সংবাদ এবং শেষ পর্বে হযরত হােসেনের মর্মান্তিক শাহাদত বরণকে লেখক বিষাদ সিন্ধুর সাথে তুলনা করেছেন। ইমাম হাসানকে হত্যা করা হয় বিষপ্রয়ােগে আর ইমাম হােসেনসহ অনেক নিকটাত্মীয়দের নির্মমভাবে হত্যা করা হয় কারবালা প্রান্তরে। বিষাদ সিন্ধু জাদুকরী রচনাগুণের জন্যে ও ধর্মের স্পর্শকাতরতার জন্য সাহিত্যরসিকদের কাছে জনপ্রিয়। জয়নবের রূপে বিমােহিত এজিদ এবং এই রূপতৃষ্ণার পরিণামে বহু মানুষের বিপর্যয় ও ধ্বংসের কথা বর্ণিত হয়েছে, যা বিষাদ সিন্ধু গ্রন্থটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সেই সাথে তা গ্রন্থটিকে সর্বজনীন করে তুলেছে। বিষাদসিন্ধুর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন-” বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সীতার বনবাস’ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে যেমন এককালে পঠিত হইয়াছিল, ‘বিষাদ সিন্ধু তেমনই আজও পর্যন্ত জাতীয় মহাকাব্যরূপে বাঙলা মুসলমানের ঘরে ঘরে পঠিত হয়; বাংলা সাহিত্যের অপূৰ্ব্ব সম্পদ হিসাবে সকল সমাজেই এই গদ্যকাব্যখানির সমান আদর। “ তিন পর্বে বিভক্ত বিষাদ সিন্ধুর মহরম পর্বে বর্ণিত হয়েছে দামেস্ক অধিপতি মাবিয়া পুত্র এজিদের প্রণয়াসক্তি ব্যর্থতা এবং তার পরিণাম। উদ্ধারপর্বে আছে বিপন্ন হােসেন পরিবারের অস্তিত্বরক্ষা এবং ক্রোধান্ধ দুর্জয় বীর মােহাম্মদ হানিফার প্রতিশােধ গ্রহণের বিবরণ। শেষখণ্ড এজিদবধ পর্বে হানিফার এজিদ হত্যার প্রচেষ্টা,এজিদের ভূ-গর্ভস্থ গুপ্ত কক্ষে পলায়ন ও জলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নারকীয় কষ্টভােগ, দৈব নির্দেশে বহু প্রাণক্ষয়কারী হানিফার প্রাকৃতিক বন্দিত্ব এবং হােসেন বংশধর জয়নাল আবেদীনের রাজ্য লাভের কাহিনি বিবৃত হয়েছে। এজিদ চরিত্রে নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা, দানবীয় পৈশাচিকতা ও অমানবিক আচরণ সবকিছুর ব্যাখ্যা ঐ জয়নব প্রেম। প্রণয়ে ব্যর্থতা ও দয়িতার প্রত্যাখ্যানের মর্মপীড়া এজিদের অন্তরে যে প্রতিহিংসার আগুন জ্বেলেছে তাতেই ভস্মীভূত হয়েছে সকল মানবিক গুণাবলি, নীতিবােধ ও সহজাত বিবেচনা শক্তি। এজিদের কন্ঠে তাই শুনা যায় ---- ‘আমি যাহার জন্য প্রাণ পর্যন্ত পরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত, আমি যাহার জন্য রাজ্যসুখ তুচ্ছ করিয়া এই কিশাের বয়সে জীবন পর্যন্ত বিসর্জন করিতে অগ্রগামী, যাহার জন্য এতদিন কষ্ট সহ্য করিলাম, সেই জয়নবকে হাসান বিবাহ করিবে? এজিদের চক্ষে তাহা কখনই সহ্য হইবে না’। পুঁথির জগৎ থেকে মীর মশাররফ বিষাদ সিন্ধুর কাহিনি চয়ন করলেও এই উপাখ্যানে তিনি যে শিল্পবােধের স্বাক্ষর রেখেছেন তা বিশেষ উল্লেখযােগ্য। বিষাদ সিন্ধু ঐতিহাসিক উপন্যাস, মহাকাব্য না রােমান্টিক কাহিনি এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে । মুহম্মদ আবদুল হাই বিষাদ সিন্ধুর আঙ্গিক বিষয়ে বলেছেন— ‘বিষাদ সিন্ধু খাঁটি ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, তেমনি আটঘাট বিধিবদ্ধ organic plot-এর উপন্যাসও নয়। এ ইতিহাস, উপন্যাস, সৃষ্টিধর্মীয় রচনা ও নাটক ইত্যাদি সাহিত্যের সর্ববিধ সংমিশ্রণে রােমান্টিক আবেগ মাখানাে এক সংকর সৃষ্টি।
বিষাদ সিন্ধু’র কাহিনিতে মীর মশাররফ হােসেনের কিছু অসঙ্গতি ও অনিয়ন্ত্রিত আবেগ, কিংবা ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও তা মার্জনীয়। মূল ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতা থাকলেও গ্রন্থটিতে ইতিহাসের অন্ধ অনুসরণ করা হয় নি। এবং বিষাদ সিন্ধু গ্রন্থই মীর মশাররফ হােসেনকে অমর করে রেখেছে। সমসাময়িক বঙ্গবাসী পত্রিকা বলেছে- “যেরূপ সুন্দর, সুললিত, হৃদয়গ্রাহী ভাষায় গ্রন্থখানি রচিত, তাহাতে হোসেন সাহেবকে বাহাদুর বলিতে হয়। “এক্কেবারে তাই। মধুসূদন-বঙ্কিম- দীনবন্ধুর সমকালে মীর মশাররফ হোসেন যেরূপ সুললিত গদ্যে ‘বিষাদসিন্ধু’ রচনা করেছেন তা বিস্ময়করই বটে। তাঁর সুচারু বাক্য- নির্মিতিতে বঙ্কিমের প্রভাব সুস্পষ্ট। নাটকোপন সংলাপ বিনির্মাণে দীনবন্ধুর প্রভাবও অস্পষ্ট নয়। তবে ‘বিষাদসিন্ধু র গদ্যে বিশেষত ‘মহররম পর্ব্বে’ মীর মশাররফ হোসেন সর্বদাই মধুসূদনকে মনে রেখেছেন এবং যুগপৎ অনুসরণ করেছেন। সে কারণেই গদ্যে রচিত হয়েও তাঁর ভাষা হয়ে উঠেছে কাব্যময়। গদ্যের খরখরে দেহ হয়ে উঠেছে সৌষ্ঠবময় কোমল তনু। ‘বিষাদসিন্ধু’ তাই হয়ে উঠেছে গদ্যে লেখা এক মহাকাব্য। ‘বিষাদসিন্ধু’র ভাষিক দেহ নির্মাণ ছাড়াও চরিত্রনির্মিতিতেও মাইকেল মধুসূদনের প্রভাব মীরের উপর পরিলক্ষিত হয়। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র কেন্দ্রীয় চরিত্র নির্মাণে মাইকেল যেভাবে রামায়ণকে অতিক্রম করেছেন, মীর মশাররফ হোসেনও ঐতিহাসিকতাকে উপেক্ষা করে এজিদ চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন। কথিত খল চরিত্রকে সাহিত্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে চিত্রণ করার মধ্যে বাহাদুরি আছে বৈকি। সীতার কারণে রাবণের সোনার লঙ্কা যেভাবে ছারখার হয়, ঠিক তদ্রূপ জয়নাবের কারণে কারবালার করুন কাহিনী ঘটে, ঘটে এজিদের চরম পরিণতি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct