ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি এবং ক্লাসের ভূগোল বইয়েও পড়েছি, ভারতবর্ষের ম্যাপে ও দেখেছি আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। শুধু ভূগোল বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলাম না। ইতিহাসেও পড়েছি। ছোটবেলা থেকে বড়দের মুখে শুনে এসেছি রবি রামের দ্বীপ চালান আর ক্ষুদিরামের ফাঁসি। কথাগুলো শুনে মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন জেগে উঠতো। শুধু রবিরাম কেন? রবি রামের মতো আমাদের এই জন্মভূমি ভারতবর্ষের শতশত স্বাধীনতা সংগ্রামীকে দানব ব্রিটিশ ইংরেজ দ্বীপ চালান বা দ্বীপান্তর পাঠিয়ে দিতো আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। অনেকে আবার আন্দামান কে কালাপানির দেশও বলে থাকে। সেই আন্দামান-নিকোবর সম্পর্কে জানার কৌতূহল অনেকদিনের। সরেজমিনে দেখার সেই সৌভাগ্য এসেই গেল। লিখেছেন মোঃ ইসরাইল সেখ
আবার প্রশ্ন করি এখানে কি হরিণের মাংস পাওয়া যায়?
তখন বলেন-- বতর্মানে সরকার হরিণ মারা নিষিদ্ধ করেছে। তাই কেউ মারলে জরিমানা হবে। এই গ্রামে প্রাইমারি স্কুল এবং স্ব্যাস্থ কেন্দ্র, আই সি ডি এস সব কিছু আছে। এই গ্রামের মানুষের প্রধান জীবিকা নারকেল ও সুপারি চাষ হলেও কৃষি কাজ নেহাত কম নয়। গ্রামে কিছু বাড়ি ছোট ছোট পাহাড়ের উপর। এর জন্য বাড়ি বাড়ি যেতে অনেকটা কষ্ট হচ্ছিলো। পরের দিন কৃষ্ণপুর গ্রামে। এই গ্রামের মানুষদের কাছ হতে জানতে পারি অধিকাংশ মানুষের আদি বাড়ি বাংলাদেশে। আরোও জানতে পারি গ্রাম হতে কিছু দূরে রয়েছে পাহাড়। এই পাহাড়ে রয়েছে ঝর্ণা। এই ঝর্ণার জল শোধন করে তিনটি পঞ্চায়েতের মানুষকে জল জীবন মিশনে স্কিমের আওতায় বাড়ি বাড়ি পাইপের মাধ্যমে জল পৌছিয়ে দিচ্ছে। আরো এক অজানা তথ্য জানতে পারি। গভীর জঙ্গলের মধ্যে ঝর্ণা ধারা অবস্থিত। আর এই গভীর জঙ্গলে এক ডজনেরও বেশি হস্তি রয়েছে। প্রশ্ন করি এতো হস্তি কোথায় থেকে আসলো? গ্রামবাসীরা জানায় জাপানি ফৌজ যখন ইংরেজদের কাছে পরাস্ত হয়, তখন এই জঙ্গলে হাতির দল ছেড়ে চলে যায়। জঙ্গলে হাতি থাকার কারণে জল শোষণের ট্যাংকের পাইপ গ্রীষ্মকালে ভেঙে দিয়ে জল খায়। তাই পাইপ খারাপ বা পরিবর্তনের দরকরা হলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন সঙ্গে করে নিয়ে মেরামত করতে হয়।। কখনো কখনো হাতির দল চলে এলে পুলিশকে শূন্যে গুলি ছুড়তে হয়।
আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি এই জেলায় অবস্থিত। যা ডিগলিপুর খুবই কাছে। যার উচ্চতা সাতশো একত্রিশ মিটার। এই উত্তর ও মধ্য আন্দামান জেলার অন্যান্য গ্রামেও গিয়েছি সময়ের অভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। ডিগলিপুরে দশ দিন থাকার পরে একটি জিনিস দেখে মনে হলো আমরা নিজের দেশেই পরবাসি। এখানে যে দশ দিন ছিলাম সেই দশ দিন বাড়ির সাথে বা অফিসের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। কারণ এখানে 24 ঘন্টাই মোবাইল এমারজেন্সি। এখানে জিও, এয়ারটেল,ভোডা কোন সিমেই ঠিকমতো টাওয়ার পায়না। জিও একদম চলে না। ভোডা এবং এয়ারটেল কখনো কখনো একটু-আধটু সিগনাল দেয়। এখানকার মানুষ সবচেয়ে বেশি বিএসএনএল সিম ব্যবহার করে। বিএসএনএল সিগন্যাল অন্যান্য নেটওয়ার্ক থেকে ভালো। এবার ডিগলিপুর হতে পোর্ট ব্লেয়ারের উদ্দেশে ফেরার পালা। দশ দিন কাজ করার পর সন্ধ্যা পাঁচটায় পোর্ট ব্লেয়ারের বাসে চেপে রওনা হই। সন্ধ্যা পাঁচটার সময় বাস ছেড়ে রাত্রি একটার মধ্যে কদমতলা চেকপোষ্টে পৌঁছাই। দীর্ঘ দু’ঘণ্টার বেশি বাস দাঁড়িয়ে থাকার পর এখান থেকে আবার চলতে থাকে। আর দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কারণ বাস জারোয়া এরিয়ার ভেতর দিয়ে আসতে হবে। আর আসতে গিয়ে জারোয়ারা আক্রমণ করতে পারে। তাই বাসসহ অন্যান্য গাড়ি সব সারি সারি রওনা হলো পোর্ট ব্লেয়ারের দিকে। সকাল পাঁচটার সময় বারার্টাং জেটি ঘাটে এসে থামল। সকালের অপূর্ব দৃশ্য দেখে আনন্দে মন ভরে গেল। মনে হচ্ছে সূর্য যেন এখান হতে উদিত হচ্ছে। ভেজালে উঠে সিড়ি বেয়ে উপর তলায় উঠে পড়ি। আর সকালের অপূর্ব দূশ্য উপভোগ করি। এই ভাবে ভেসালে করে মিডল স্ট্রেট জেটিতে এসে নামি। তারপর আবার বাসে উঠে জানালার পাশে বসি। কারণ ডিগলিপুর যাবার সময় অতি উৎসুক ছিলাম একবার জারোয়া দেখার জন্য, কিন্তু দেখা পাইনি। তাই ফেরার পথে সেই আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। কথায় বলে আশা কখনো কখনো সত্য হয়। তাই বাসে জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছি, যদি একবার দেখা পাই। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ লক্ষ্য করি রোডের পাশে চার পাঁচ জনের একটি দল বসে আছে।বাসে ভিতরে বসে তাদের লক্ষ্য করি তারা আমাদের মতো পরিবেশের মানুষ নয়। দেখতে একবারে কদাকার। মাথা চুলের রঙ আর মুখ ও দেহের রঙের পার্থক্য করা মুশকিল। এই জারোয়াদের এরিয়া পঞ্চাশ কিমির মতো। তাদের বতর্মান সংখ্যা খুবই কম। যতদূর জেনেছি তাদের সংখ্যা প্রায় পাঁচশো মতো। তাদের খাদ্য প্রধাণত বনের ফল, নদীর মাছ, বুনো শুয়োর প্রভূতি। এরা প্রধাণত তীরধিনুক ব্যবহার করে শিকার করে থাকে। পর্যটকদের জারোয়াদের সাথে ছবি তোলা, খাবার দেওয়া, পাটিতে নৃত্যের আয়োজন ইত্যাদি কাজ বিভিন্ন টুরেস্ট কোম্পানি সুযোগ করে দিতো। এই সব কাণ্ড দেখে আন্দামান সরকারের পর্যটন বিভাগ 2008 সালে আদিবাসী উপজাতি রক্ষা রেগুলেশন 1956 এর অধীনে জারোয়াদের সাথে ছবি তোলা, কথা বলা, খাবার দেওয়া, এমনকি জারোয়া এরিয়ায় গাড়ি থামানো কঠোর ভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তাদের জন্য সরকার স্ব্যাস্থের কথা চিন্তা করে পোর্ট ব্লেয়ারে হাসপাতাল তৈরী করেছে। সরকার থেকে বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা করেছে। স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে শুনেছি জারোয়াদের মধ্যে অনেকেই সভ্য মানুষের এবং সমাজের ছোয়া লেগেছে। কারণ তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভালো জামাপ্যান্ট পড়ে বাজারে আসে। আবার কেউ কেউ সরকারি চাকরি করে, নিজেদের ভাষা ছাড়াও অনেকেই হিন্দ বলতে পারে।
আন্দামানের দ্বীপ গুলোর মধ্যে অন্যতম দ্বীপ রসল্যান্ড। এই দ্বীপে কোন পর্যটক একবার গেলে দ্বীপের সৌন্দর্য দেখে হৃদয় ভরে যাবে। এই দ্বীপে যে সকল বাসিন্দা বসবাস করে সেই সমস্ত বাসিন্দাদের আমাদের বাংলায় কাছে পাওয়া মুসকিল। এই দ্বীপে প্রবেশ করলে স্বাগত জানিয়ে বাসিন্দারা কাছে চলে আসবে। সেই বাসিন্দা হলো হরিণ ও ময়ূর। দ্বীপে প্রবেশ করলে হরিণ কাছে চলে আসবে। পর্যটকা গায়ে হাত দিলে আরো কাছে চলে আসে আবার কখনো কখনো ময়ূর পেকম তুলে স্বাগত জানাবে। দ্বীপে গেলে জাপানিদের ছাপাখানা, জলশোধনাগার, ক্লাব, গির্জা সহ আরো অনেক কিছু দেখতে পাওয়া যাবে। এবার আন্দামানের অন্যতম জেলা নিকোবর। এই নিকোবর জেলা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করছি। আন্দামানের দুটি জেলা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জেলা। এই জেলায় যাওয়ার জন্য সড়ক পথের কথা মাথায় আনা যাবেনা। এখানে যেতে গেলে দুটি পথ ব্যবহার করা হয়। এক নং আকাশ পথ, দুই নং জলপথ। কিন্তু আকাশ পথে গেলেও বিমানে যাওয়া যাবে না। কারণ পোর্ট ব্লেয়ার এয়ারপোর্ট থেকে কোন পাবলিক বিমান চলাচল করে না। তাই আকাশ পথে যাওয়ার একমাত্র ভরসা হেলিকপ্টার। আর জল পথে জল জাহাজ। পোর্ট ব্লেয়ার হতে হেলিকপ্টারে সময় লাগে এক ঘন্টা কুড়ি মিনিট আর জল জাহাজে গেলে সময় লাগে দশ ঘন্টার মতো।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct