শান্ত নীল লেকের পাড়ে আগুনে লাল কিংবা উজ্জ্বল গোলাপি রঙের পাখির ঝাঁকের জলভূমিতে চরে বেড়ানোর দৃশ্য আনমনে ইন্টারনেট দুনিয়ায় বিচরণ করার সময় আপনার চোখে পড়ে গেল। এরপর ফ্ল্যামিঙ্গো নামের এই পাখির মায়াবী রুপে মুগ্ধ হয়ে এই জলচরকে দেখতে যদি ক্যারিবিয়ানের কোনো দ্বীপ বা দক্ষিণ আমেরিকায় আপনি চলেও যান, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অবশ্য সৌন্দর্যেই শুধু নয়, ফ্ল্যামিঙ্গোর জীবনাচারও আপনাকে এদের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে পারে। আজকে এই প্রাণী নিয়েই নানা আলোচনা করেছেন ফৈয়াজ আহমেদ.....
ফ্ল্যামিঙ্গোর আগুনে লাল গায়ের রঙ, বাঁকা ও পুরু ঠোঁট, সরু গলা, অস্বাভাবিক লম্বা পা হাজারো জলচরের ভিড়ে একে দিয়েছে অনন্যতা। হেরন, স্পুনবিল, ক্রেনের সমগোত্রীয় এই পাখিকে ক্যারিবিয়ান থেকে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের মিঠা বা নোনাজলতে বাস করতে দেখা যায়। উপকূলীয় লেগুন, অগভীর লেক ও অন্যান্য জলাভূমিতে বাস করে এরা। ক্রান্তীয় অঞ্চলের উষ্ণ পরিবেশ বসবাসের জন্য প্রথম পছন্দ ফ্ল্যামিঙ্গোর।ফ্ল্যামিঙ্গোর সবচেয়ে আলোচিত বৈশিষ্ট্য এর রঙ। শরীর ঢেকে রাখা গোলাপি রঙের পালকের জন্যই পাখিটি এত মনোমুগ্ধকর। গোলাপি পালকের জন্য ফ্ল্যামিঙ্গো বিখ্যাত হলেও সবসময় পালক কিন্তু গোলাপি হয় না! সাদা, কমলা বা লালও হতে পারে। একটি ফ্ল্যামিঙ্গো কী খাবার খাচ্ছে এবং সেই খাবারে কোন পিগমেন্ট বেশি- তার উপর নির্ভর করে পালকের রঙ কেমন হবে। বাচ্চা একটি ফ্ল্যামিঙ্গো গোলাপি রঙ নিয়ে জন্মায় না। দুই তিন বছর লেগে যায় খেয়েদেয়ে এদের গোলাপি হতে। সাধারণত ফ্ল্যামিঙ্গোর নিয়মিত খাদ্যতালিকায় থাকে শৈবাল আর চিংড়ি। এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন থাকে। এই বিপুল পরিমাণ বিটা ক্যারোটিন তাদের শরীরকে লাল বা গোলাপি বানিয়ে দেয়। বিটা ক্যারোটিনের জন্যই টমেটো লাল আর গাজর কমলা হয়! ফ্ল্যামিঙ্গো যদি বিটা ক্যারোটিনযুক্ত খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে এদের গোলাপি পালকগুলো ঝরে যায়। নতুন গোলাপি পালক আর তৈরি হয় না। তখন এদের শরীর সাদা বা ধূসর দেখায়। ফ্ল্যামিঙ্গো কী খাবার খাচ্ছে তা নির্ভর করে এর ঠোঁটের উপর। যেমন- আন্দিয়ান জাতের ফ্ল্যামিঙ্গো শৈবাল খায়, এরা ঠোঁট কাদার গভীরে নিয়ে যেতে পারে। আবার গ্রেটার, চিলিয়ান, পুনা ফ্ল্যামিঙ্গো অগভীর জলতে যা পাওয়া যায় তা-ই খেয়ে সন্তষ্ট থাকে। এরা খায় মাছ, পোকামাকড়, অমেরুদন্ডী প্রাণীদের। ফ্ল্যামিঙ্গোর ঠোঁট যে খুবই দর্শনীয় তা এর চেহারার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। কালো রঙের ঠোঁট খুবই পুরু ও মজবুত। এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঠোঁট এদের খাদ্যগ্রহণের ধরনকে চমকপ্রদ করেছে। প্রথমে ফ্ল্যামিঙ্গো লেগুনের তলদেশে এর লম্বা পা দিয়ে নাড়া দেয়। তারপর আন্দোলিত জল বা কাদার মধ্যে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। ডুবন্ত ঠোঁট উল্টো করে এর মাঝে বেলচার মতো করে ছুড়ে দেয় খাবার। ফ্ল্যামিঙ্গোর মুখে ছাকনির মতো একটা অংশ আছে যা প্রয়োজনীয় খাবার ছেঁকে পেটে চালান করে দেয়। ক্রাস্টেশিয়া, প্ল্যাঙ্কটন, শৈবাল, চিংড়ি, মলাস্ক, মাছ- মোটামুটি সবই খায় এরা। ফ্ল্যামিঙ্গো সর্বভূক। একটি প্রাপ্তবয়স্ক ফ্ল্যামিঙ্গো ৩-৪ ফুট উঁচু হয়। ওজন হয় ৯ পাউন্ড যা আপনার পোষা বিড়ালের ওজনের সমান। গ্রেটার ফ্ল্যামিঙ্গো সবচেয়ে লম্বা হয়, প্রায় পাঁচ ফুট। আর লেসার ফ্ল্যামিঙ্গো সবচেয়ে ছোট আকারের, ৩ ফুটের মতো।
ফ্ল্যামিঙ্গোকে সবসময় এক পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এরা ঘুমায়ও এভাবে! শরীরের তাপমাত্রা বাঁচাতে যখন এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার আরেকটি পা তখন থাকে পালকাচ্ছাদিত শরীরের উষ্ণতায়। মাঝে মাঝে পা বদল করে দাঁড়ায় সে। ফ্ল্যামিঙ্গোর পায়ের উপরের দিকে হাঁটু থাকে, একটু বাঁকানো কালো জায়গা। এরা সাঁতরাতে, দৌড়াতে, এমনকি উড়তেও পারে। ফ্ল্যামিঙ্গো দলবেঁধে বাস করে। একটি দল বা ঝাঁককে বলে কলোনি। একটি কলোনিতে হাজার হাজার পাখি থাকতে পারে। কলোনিতে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস এদেরকে অসংখ্য সুবিধা দেয়। প্রজনন থেকে শিকারির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা- প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজে আসে ফ্ল্যামিঙ্গোর কলোনি জীবন। সম্ভাব্য কোনো শিকারীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র তাদের কলোনি। কলোনির সদস্যরা কোনো শিকারী এলে ঝাঁক বেধে তাড়া করে। এজন্য ফ্ল্যামিঙ্গোর বড় কোনো ঝাঁককে সমঝে চলে একা কিন্তু শক্তিশালী কোনো শিকারী। প্রজনন মৌসুমে ফ্ল্যামিঙ্গোর ডিম চুরি বা নষ্ট হয়ে যাওয়াও ঠেকায় তাদের কলোনি। একেকজন পালা করে পাহারা দেয় সবার ডিম। হয়তো প্রতিবেশী ফ্ল্যামিঙ্গোই পাহারা দিল একদিন! ফ্ল্যামিঙ্গো একগামী। একজন সঙ্গীর সাথেই জীবন কাটিয়ে দেয়, ডিম ফুটায়, বাচ্চা দেয়। পুরো কলোনি একই সময়ে প্রজননের কাজ সারে। ডিম পাড়ে একই সময়ে, সবার বাচ্চাও ফোটে একই সময়ে। এতে তাদের বাচ্চার দেখাশোনা ও লালনপালনে সুবিধা হয়। ডিম ও বাচ্চাদের শিকারির হাত থেকে রক্ষা করতে পুরো কলোনির সবাই একসাথে কাজ করে। হ্রদ বা লেগুনের তীরে কাদা দিয়ে ঢিবির মতো করে বাড়ি তৈরি করে ফ্ল্যামিঙ্গো পরিবার। মা ফ্ল্যামিঙ্গো ঢিবির মাথায় অগভীর গর্ত করে তাতে ডিম পাড়ে। টানা ত্রিশ দিন তা দেয়। তারপর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। একবারে শুধু একটা ডিম পাড়ে ফ্ল্যামিঙ্গো। বাচ্চা ফ্ল্যামিঙ্গো সোজা আর ছোট ঠোঁট নিয়ে জন্মায়। বড় হওয়ার পর ঠোঁট বড় ও বাঁকা হয়। বড় হওয়ার পর নিজে জলতে খাবার খুঁজতে গিয়ে ঠোঁট বাঁকা হয়ে যায়। সদ্যোজাত ফ্ল্যামিঙ্গোর গায়ে থাকে নরম সাদা পালক। বাচ্চাকে বাবা-মা দুজনই দেখাশোনা করে। দুজনেরই পরিপাকতন্ত্রে তৈরি একধরনের তরল খাওয়ায় বাচ্চাকে।
দিন পাঁচেক পর বাচ্চা নিজে চলাফেরা করার মতো শক্তসমর্থ হয়। তারপর বাবা-মা বাচ্চাকে বাচ্চা ফ্ল্যামিঙ্গোদের ছোট একটা দলে দিয়ে আসে। বাচ্চা দলের সাথে ঘুরে বেড়ায় আর খাওয়ার সময় হলে ফিরে আসে বাবা-মার কাছে। ফ্ল্যামিঙ্গোর বাচ্চার কিঁচকিঁচ শব্দ শুনে বাবা-মা তাকে চিনতে পারে। প্রত্যেকটা বাচ্চার গলার আওয়াজ আলাদা হয়। মানুষের মতোই! সপ্তাহ তিনেক পর একটু শক্তপোক্ত হওয়া ফ্ল্যামিঙ্গো নিজের খাবার নিজেই যোগাড় করে। দু-তিন বছর পর তরুণ ফ্ল্যামিঙ্গো স্বাধীন জীবনযাপন করে। ফ্ল্যামিঙ্গো শান্তশিষ্ট, ঠান্ডা মেজাজের প্রাণী। তবে এই নিরীহ ফ্ল্যামিঙ্গোরাই বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে প্রচন্ড হিংস্র হয়ে ওঠে। খাবার নিয়ে বা প্রজননের মৌসুমে সঙ্গী খোঁজা নিয়ে নিজেদের মাঝে মারামারি লাগিয়ে দেয়। ফ্ল্যামিঙ্গো সহজেই বিচিত্র শিকারীর শিকারে পরিণত হতে পারে। ঈগল, বুনো কুকুর বা মানুষের শিকারে পরিণত না হলে বুনো পরিবেশে এরা ২০-৩০ বছর বাঁচে। খাবার, আরামদায়ক বাসস্থান এবং প্রজননের সুবিধার জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায় এরা। ঘন্টায় ৩৫ কি.মি. বেগে ছুটতে পারে। পৃথিবীতে ফ্ল্যামিঙ্গোর মোট ছয়টি প্রজাতি আছে। আন্দিয়ান ফ্ল্যামিঙ্গো প্রজাতিটি সবচেয়ে বিরল এবং বিলুপ্তপ্রায়। লেসার, পুনা, চিলিয়ান এই তিনটি ফ্ল্যামিঙ্গো প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে। ফ্ল্যামিঙ্গোর ঝুঁকিতে থাকার কারণ জলদূষণ, লেড পয়জনিং, বাসা নষ্ট হওয়া, ডিম চুরি যাওয়া, মানুষের শিকার এবং পর্যটকদের অতিরিক্ত আনাগোনায় পরিবেশ নষ্ট হওয়া।
আমেরিকান ফ্ল্যামিঙ্গো বাস করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইউকাতান উপদ্বীপ, দক্ষিণ আমেরিকা আর গ্যালাপোগাস দ্বীপে। পুনা ও আন্দিয়ান ফ্ল্যামিঙ্গো পাওয়া যায় পেরু, চিলি, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা ও আন্দিজের পার্বত্য এলাকায়। চিলিয়ান ফ্ল্যামিঙ্গো বাস করে দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণ এলাকায়। আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপ, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল গ্রেটার ফ্ল্যামিঙ্গোর নিরাপদ আবাস। আর লেসার ফ্ল্যামিঙ্গোর বাস আফ্রিকা ও ভারতে। বাহামায় ফ্ল্যামিঙ্গো জাতীয় পাখি। আমেরিকায় বাগান সাজাতে প্লাস্টিকের ফ্ল্যামিঙ্গো ব্যবহার করা হয়। উজ্জ্বল রঙের পালক আর সৌন্দর্যের জন্য চিড়িয়াখানায় দেখতে পাওয়া যায় এদের। চিড়িয়াখানার ঘরোয়া পরিবেশে একটি ফ্ল্যামিঙ্গো ৫০-৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। চিড়িয়াখানার কৃত্রিম পরিবেশে প্রথম যে ফ্ল্যামিঙ্গোর বাচ্চা ফোটানো হয় সেটি ছিল চিলিয়ান জাতের। চিড়িয়াখানাটি সুইজারল্যান্ডের, নাম ব্যাসেল জু। পৃথিবীতে বেঁচে থাকা সবচেয়ে বয়স্ক ফ্ল্যামিঙ্গোর বয়স ছিল ৮৩ বছর! জেনে আশ্চর্য হবেন, ফ্ল্যামিঙ্গো চরম প্রতিকূল পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে। যেমন- উত্তর তানজানিয়ার লেক নেট্রনে ৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা আর চামড়া ঝলসানো জলর মাঝে বাস করে লেসার ফ্ল্যামিঙ্গো। শুধু বাসই করে না, দিব্যি বংশবৃদ্ধি করে বেড়ায়। দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় লবণাক্ত হ্রদ মার চিকুইটাতে এভিস আর্জেন্টিনাস ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় ন্যাশনাল পার্ক হতে যাচ্ছে। এখানে তিনটি বিপদাপন্ন প্রজাতির ফ্ল্যামিঙ্গো বাস করে। ফ্ল্যামিঙ্গো শব্দটি এসেছে স্প্যানিশ ‘flemenco’ থেকে যার অর্থ আগুন। আগুনের মতো লাল রঙের জন্যই করা হয়েছে এমন নামকরণ। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর পাখিগুলো বেঁচে থাক তাদের নিজস্ব আবাসে, প্রাকৃতিক পরিবেশে। এমন সুন্দর একটি প্রাণীপ্রাজতি বিপন্ন বা বিলুপ্ত হয়ে পরিবেশে বিপর্যয় সৃষ্টি না হোক কিংবা নিসর্গের বিপুল সৌন্দর্যে কোনো ঘাটতি না পড়ুক।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct