নিজস্ব প্রতিবেদক, বহরমপুর, আপনজন: রবিবার মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে হয়ে গেল এক সম্পূর্ণ অন্য ধরনের নাগরিক সভা। উদ্যোক্তা বাংলা পক্ষ। সভার আলোচ্য বিষয় ছিল: “তিনটি ভাষা আন্দোলনের উত্তরাধিকার ও বাঙালির সামনে নতুনতর ভাষা সংস্কৃতি স্বাধিকার রক্ষার লড়াই”। সভায় আমন্ত্রিত বক্তাদের তালিকাটি ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ ও আকর্ষণীয়। প্রধান বক্তা ছিলেন জেলার বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ খাজিম আহমেদ। ৭৬ বছরের এই তরুণ আলোচনা করলেন বাঙালির বিপন্নতার, ক্রমপতনের ইতিহাস ও কারণসমূহ। রীতিমত তথ্য উপস্থাপিত করে প্রমাণ করলেন যেখানে ভারতের দক্ষিণের উত্তরের বিভিন্ন শহরে স্থানীয় মানুষের সংখ্যাধিক্য; যা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়, সেখানে কলকাতায় বাঙালির সংখ্যা, তাঁর পর্যবেক্ষণে, ৫০ শতাংশও নয়। তাঁর সুদীর্ঘ ৪৬ মিনিটের বক্তব্যে তথ্য এবং তথ্যের যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাঙালির পতন এবং উত্থানের সম্ভাবনা দুটোই তিনি শ্রোতাদের বুঝিয়ে দেন। শ্রোতাদের তিনি আবিষ্ট করে রাখেন, তাঁর বাচনভঙ্গি ও যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে। জেলার খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী কৃষ্ণজিত সেনগুপ্ত, সম্পূর্ণ অন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রমাণ করেন যে শিশুরা যে ছবি দেখতে দেখতে বড় হয়; অর্থাৎ যে ছবি শিশুকে তার মাতৃভাষা মাতৃ সংস্কৃতি কৃস্টি ঐতিহ্য খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে ভবিষ্যতের পেশা প্রবেশ সবকিছুতেই নিজ জাতির ছোঁয়াচ লাগিয়ে দেয় সেখানে, বর্তমানে প্রতিনিয়ত বাংলায় হিন্দি ভাষিক অগ্রাসন বাঙালির দেখা এবং মেনে চলার ধারণাকেই সম্পূর্ণ বদলে দিচ্ছে। তাঁর আক্ষেপ, আমরা যথাযথ এর বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুলছি না কেন? বিভিন্ন উদাহরণ সহযোগে তিনি প্রমাণ করেন বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব। তার আলোচনায় পন্ডিত আলাউদ্দিন খাঁ থেকে কাফী খাঁ; সকলেই উঠে আসেন।
কবি লেখক অরূপ চন্দ্র জানান, ইতিহাস খুঁজে দেখতে হবে, পড়তে হবে, তবেই নিজ ভাষা সংস্কৃতি ও জাতির প্রতি গর্ববোধ তৈরি হবে। কিন্তু বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিরন্তর যেন বাঙালিকে বোঝানো চলছে যে তার সংস্কৃতি যথেষ্ট আধুনিক নয়; এবং ধীরে ধীরে বাঙালিকে হীনমন্যতায় ডুবিয়ে দেওয়ার একটা সুচিন্তিত চক্রান্ত যেন চারপাশে রচিত হচ্ছে। তিনি বাংলা ভাষার প্রাচীনত্ব বিষয়ে আলোচনা করেন। বাংলা সাহিত্যে সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় শ্রেষ্ঠত্ব সুললিত আলোচনায় তুলে ধরেন। পরবর্তী আলোচক মৃণাল নন্দী সুচিন্তিত একটি আলোচনা উপহার দেন, কিভাবে বিপণন পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়ে বাঙালির খাদ্যাভ্যাস থেকে সাংস্কৃতিক অন্বেষণ সবকিছুকেই বদলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তিনি দুঃখের সঙ্গে জানান মাতৃভাষা না শিখেও অনেকে রবীন্দ্র সংগীত গাইছে যেখানে স্ক্রিপ্ট লেখা থাকছে হিন্দিতে আর উচ্চারণ তথৈবচ। উদাহরণ হিসেবে তিনি ভারতের জাতীয় সংগীত যা এক বাঙালি কবির লেখা, তার গায়নে উচ্চারণে হিন্দি উচ্চারণ পদ্ধতির অনুপ্রবেশ বিষয়ে আলোচনা রাখেন। তিনি বলেন নিজের ভাষার প্রতি অবহেলার বীজ বড়রাই ছোটদের মনে পুঁতে দিচ্ছেন। এর থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। বর্তমানের অন্যতম এক শক্তিশালী গল্পকার সাইদুর রহমান, পেশায় যিনি বাংলা ভাষার শিক্ষক, তিনি জানান বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে বাংলা বলার জন্য হেনস্থা হতে হচ্ছে বাঙালিকে। “বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশী” এই ভাবনার প্রবল পৃষ্ঠপোষনা চলছে চারিদিকে। তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ডালি খুলে মেলে ধরেন শ্রোতাদের সামনে। স্পষ্ট বুঝিয়ে দেন কিভাবে তার পরিচিত বিভিন্ন জনকে শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য বিভিন্ন জায়গায় হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। দর্শকরা তার এই মতের স্বপক্ষে মত দিয়েছেন কারণ কমবেশি প্রত্যেক বাঙালির অভিজ্ঞতাই প্রায় বর্তমানে এক।
কবি শিল্পী ও লেখক সুশান্ত বিশ্বাস তাঁর আলোচনায় তুলে ধরেন, এতগুলি ভাষা আন্দোলন পার করে এসেও বাঙালিকে প্রতিনিয়ত নিজের ভাষা সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার যে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে, তার থেকে বেরিয়ে আসার বেশ কিছু পন্থা। শেষ বক্তা ছিলেন ইউনুস আলী, তিনি স্পষ্ট ভাষায় এই সমস্ত অগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক দেন, তিনি বলেন আমাদের ভবিষ্যতের সুরক্ষার জন্যেই এই সব ভাষিক সাংস্কৃতিক অগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। তিনি দীর্ঘ প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, দখল অন্যায় কিন্তু পুনঃর্দখল ন্যায়। বাঙালির যা কিছু বেহাত হয়েছে, দখল করেছে স্বার্থন্বেষীরা, তার সবকিছুই পুনর্দখল করতে হবে। তাঁর বক্তব্যের শেষ বাক্য ছিল অত্যন্ত প্রত্যায়ী-- “একদিন সব বাঙালির হবে।” আলোচনায় বহরমপুর শহরের বিদগ্ধ জনদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন রানীনগর সাগরদিঘি থেকে আসা ব্যক্তিরা। কবি শুভঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, বর্তমানে কলকাতা নিবাসী, এবং মৃণাল নন্দী বর্তমানে ব্যারাকপুর নিবাসী হয়েও ছুটিতে একদিনের জন্য বাড়ি এসেও আলোচনা সভায় এসেছিলেন। অংশগ্রহণ করেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে।আলোচনার শেষে ঘরোয়া আলাপচারিতায় সকলেই স্বীকার করেন বাংলা ও বাঙালির দুর্দিনে বাঙালিকে যাবতীয় শক্তি সঞ্চয় করে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে ভাষিক সাংস্কৃতিক অগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তাঁরা এক বাক্যে স্বীকার করেন এরকম আলোচনা সভা রাজ্যের প্রতিটি জেলায়, গ্রামে শহরে ছড়িয়ে দেওয়া হোক। আয়োজক সংগঠন ‘বাংলা পক্ষ’র অরিন্দম চন্দ্র, নুরুল হাসান, প্রকাশ চন্দ্র সাহা, ওফেলিয়া দত্ত, শুভম ধর, ইউনুস আলী সকলেই বাংলা জাতীয়তাবাদী ভাবনা চিন্তার বিকাশে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বিকেল সোয়া চারটেয় সভা শুরু হয়ে, শেষ হয় সন্ধ্যা সাতটায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct