সুব্রত রায়, কলকাতা, আপনজন: বাংলার বুকে বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক দীর্ঘ কয়েক দশকে কার্যত নীরবেই বেড়ে উঠেছে। বাম জমানায় এই ভোটব্যাঙ্ককেই কাছে পেতে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোট গড়েছিলেন বিজেপির সঙ্গে। তাও এক আধ বার নয়, দু দু বার। এমনকি বিজেপি পরিচালিত এনডিএ শিবিরে যোগ দিয়ে মমতা ১ বার দেশের রেলমন্ত্রীও হয়েছিলেন। যদিও মমতার সঙ্গে বিজেপির সেই জোট সম্পর্ক দীর্ঘায়িত হয়নি। কংগ্রেসের সঙ্গেও মমতা বা তৃণমূলের জোট সম্পর্ক ভাল নয়, তবে এই কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়েই মমতা ২০১১ সালে বাংলার বুকে ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। মোদি জমানায় সেই মমতা তথা তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক কার্যত আদায় কাঁচকলায় পরিণত হয়েছে। কংগ্রেস কখনও মমতার কাছে এসেছে কখনও বা দূরে সরে থেকেছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সবাইকে চমকে দিয়ে বাংলার বুকে ১৮টি আসন দখল করেছিল। সেই জয়ের ওপর ভর দিয়েই গেরুয়া শিবির ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলা দখলের ডাক দিয়েছিল। যদিও সেই ডাকে সাড়া দেননি বঙ্গবাসী। কিন্তু বিজেপি এখন ঘুরপথে বাংলার আদিবাসী সমাজের ওপর নিজেদের প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট হয়েছে। আর সেই ক্ষেত্রে তাঁরা হাতিয়ার বানাচ্ছে একলব্য স্কুলগুলিকে।২০১৮ সাল থেকেই বাংলার বুকে বিজেপির রমরমা চোখে পড়ছে। সেই বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচনে জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকায় একের পর এক গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করে চমক দিয়েছিল পদ্মশিবির। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বুকে পঞ্চায়েতের নীচু তলায় কার্যত গেরুয়া ঝড় বয়ে গিয়েছিল। এমনকি এই ৩টি জেলার প্রায় ১২টি ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতিতেও তাঁরা বোর্ড গঠনের জায়গায় চলে গিয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত তাঁরা কোথাও বোর্ড গঠন করতে পারেনি। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বাংলা থেকে যে ১৮টি আসন দখল করেছিল তার মধ্যে যেমন ছিল আদিবাসী প্রভাবিত জঙ্গলমহলের ৫টি আসন তেমনি ছিল উত্তরবঙ্গের ৪টি আসনও। অর্থাৎ আদিবাসী প্রভাবিত রাজ্যের ৯টি লোকসভা আসন গিয়েছিল বিজেপির দখলে, যা কার্যত তাঁদের বাংলা থেকে প্রাপ্ত আসনের অর্ধেক। সেই জয়ের ওপর ভর দিয়েই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও বঙ্গ নেতৃত্ব বাংলা দখলের ডাক দিয়েছিল। শ্লোগান উঠেছিল, ‘আপ কে বার ২০০ পার’। যদিও বাংলার রাজনৈতিক সচেতন মানুষ গেরুয়া শিবিরের সেই চেষ্টা রুখে দিয়ে বাংলার মেয়ের হাতেই তৃতীয়াবারের জন্য বাংলার দায়দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল।
সেই হার থেকে গেরুয়া শিবির কিন্তু কোনও শিক্ষা নেয়নি। উল্টে বাংলার সরকারকে নাজেহাল করতে নানান সময়ে নানান অভিযোগ তুলে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন মোদি সরকার নানা সরকারি প্রকল্পের টাকা আটকে রেখেছে নাহলে নানা প্রকল্প থেকে বাংলাকে বঞ্চিত করছে। এই অবস্থায় এখন সামনে এসেছে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন ও ২০২৬ সালে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে গেরুয়া শিবির বাংলার আদিবাসী সমাজে ক্রমশ তাঁদের প্রভাব বাড়াতে চাইছে একলব্য স্কুলগুলির মাধ্যমে। মোদি সরকার দেশের প্রতিটি আদিবাসী অধ্যুষিত ব্লকগুলিতে ১টি করে মডেল স্কুল গড়ার কথা আগেই ঘোষণা করেছিল। বিগত ৭-৮ বছর ধরে সেই কাজ চলছে। বাংলার বুকেও ২০১২১ সালের নির্বাচনে বিজেপি ইস্তাহারে এই স্কুলের কথা বলা হয়েছিল ‘মডেল স্কুল’ হিসাবে। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, ভোটে জিতলে আদিবাসী অধ্যুষিত প্রতিটি ব্লকে শুধুমাত্র এই জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের জন্য মডেল আবাসিক স্কুল গড়ার। সেই প্রয়াস ধাক্কা খাওয়ায় এখন মোদি সরকার চাইছে বাংলার একলব্য স্কুলগুলি রাজ্যের হাত থেকে নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার। কিন্তু কেন? বঙ্গ বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, মোদি সরকার চাইছে এই একলব্য স্কুলগুলির মাধ্যমে বাংলার বুকে আদিবাসী শিক্ষায় গেরুয়াকরণের জোয়ার আনতে। সেই কারণেই বাংলার সমস্ত একলব্য আবাসিক স্কুলের রাশ সরাসরি নিজেদের হাতে নিতে চাইছে কেন্দ্র। রাজ্যকে বাদ দিয়ে নিজেরাই ঠিক করতে চাইছে পাঠ্যক্রম। এই দাবি যে খুব একটা ভুল নয়, তার প্রমাণ মিলেছে নবান্ন থেকেও। রাজ্যে এই মুহূর্তে মোট সাতটি একলব্য মডেল আবাসিক স্কুল রয়েছে। ঝাড়গ্রাম, নাগরাকাটা, বুনিয়াদপুর, মুকুটমনিপুর, মানবাজার, বোলপুর এবং কাঁকসার মতো আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় রয়েছে স্কুলগুলি। নতুন একটি স্কুল তৈরি হচ্ছে কালিম্পংয়ে। এর মধ্যে ঝাড়গ্রামের স্কুলের পরিচালনার দ্বায়িত্ব রামকৃষ্ণ মিশনকে দিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাতটি স্কুলের প্রায় তিন হাজার ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনো করে রাজ্যের সিলেবাস মেনেই। শিক্ষক নিয়োগও করে রাজ্য। এবার সেই একলব্য স্কুলগুলি নিয়েই রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়েছে মোদি সরকার। কী আছে সেই চিঠিতে? দেশের সব মডেল আবাসিক স্কুলগুলি কেন্দ্রীয় ভাবে পরিচালনার জন্য একটি সোসাইটি গঠন করেছে মোদির সরকার। এই সোসাইটির মাধ্যমেই একলব্য স্কুলগুলিতে আদিবাসী পড়ুয়াদের ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ, মায় পাঠ্যক্রম সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় নির্ধারণ করতে চাইছে কেন্দ্র। এই উদ্দেশ্য সফল করতে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে মোদি সরকার। বাংলার সরকারকে পাঠানো কেন্দ্রের চিঠিতে বলা হয়েছে, এই সোসাইটির অধীনে এলে একলব্য স্কুলগুলির প্রতি পড়ুয়ার জন্য বছরে এক লক্ষ টাকা করে দেবে কেন্দ্র। নচেৎ সন্তুষ্ট থাকতে হবে ৬০ হাজার টাকাতেই। রাজ্যের হাতে এই স্কুলগুলির পরিচালন ক্ষমতা থাকলে পড়ুয়াদের জন্য ৪০ হাজার টাকা করে কম বরাদ্দ করা হবে। কেন্দ্রের প্রস্তাব মেনে নিলে, রাজ্যের হাতে আর কোনও ক্ষমতাই থাকবে না এই স্কুলগুলির ক্ষেত্রে। যদিও নবান্ন সূত্রে খবর, কেন্দ্রের এই প্রস্তাব নাকচ করে পাল্টা চিঠি পাঠিয়েছে রাজ্য সরকারও।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct