ইউক্রেন যুদ্ধের রাশিয়ার সৈন্য, সামরিক মজুত, অর্থনীতি ও কূটনৈতিক সম্পর্ক সব ক্ষেত্রেই বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধে জয়ের জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইরানের শরণাপন্ন হন। ইরানের শাসকদের এখন স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে পুতিনের কর্মকাণ্ড, ইরানের নেতৃত্ব যেটিকে জাতীয় স্বার্থ বলছে, তা অর্জনে বড় ধরনের সহায়তা করবে। তাই যদ্ধে যেন বিজয়ীর ভূমিকায় ইরান। এ নিয়ে লিখেছেন অ্যারন পিলকিংটন। আজ শেষ কিস্তি।
জাতীয় স্তরে ইরান কোনো দেশের সঙ্গেই স্থায়ী যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি করে না। ইরানের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত মিত্র হল সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা, উত্তর কোরিয়া, চীন ও রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার বিপরীত বিকল্প রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এ দেশগুলো একে অন্যকে সহযোগিতা করে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থকে খর্ব করতে এবং পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার চাপ থেকে বের হয়ে আসতে এই সহযোগিতা কাজে লাগানো হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার প্রতি সমব্যথী দেশের সংখ্যা কমতে কমতে এখন হাতে গোনা কয়েকটিতে এসে ঠেকেছে। রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক সব সময়ই জটিল। সিরিয়ার ক্ষেত্রে ইরান ও রাশিয়া দুই দেশই সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার–আল আসাদকে সহায়তা করে আসছে, যদিও তাদের জাতীয় স্বার্থ পুরোপুরি ভিন্ন। মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য রাশিয়া আসাদ সরকারকে সহায়তা করছে। অন্যদিকে ইরানের জন্য বন্ধুভাবাপন্ন সিরিয়া মানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলবিরোধী জোট শক্তিশালী হওয়া। এ ছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া পুনর্গঠন ও অবকাঠামো উন্নয়নের লাভজনক কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে ইরান ও সিরিয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতাও রয়েছে। নিজেদের পক্ষে যায়, এমন একটা পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টা দুই দেশই অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখন পর্যন্ত কোনো দেশই সিরিয়া সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মতো প্রভাব তৈরি করতে পারেনি।যা–ই হোক, শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনে রাশিয়ার বিপর্যয় ভ্লাদিমির পুতিনকে বাধ্য করেছে ইরানের শরণাপন্ন হতে। তেহরান মস্কোকে দুইভাবে সহায়তা করছে। প্রথমত, ইউক্রেন যুদ্ধে সেনাসংকটে পড়েছে রাশিয়া। সে কারণে সিরিয়ায় মোতায়েন করা সেনাদের সরিয়ে ইউক্রেনে মোতায়েন করছে রাশিয়া। ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের সেনারা শূন্যস্থান পূরণ করে রাশিয়াকে সহযোগিতা করছে। দ্বিতীয়ত, ইরান থেকে রাশিয়া সস্তায় ও অত্যন্ত কার্যকর ড্রোন নিচ্ছে। প্রতিপক্ষ ইউক্রেনকে পশ্চিমারা অগ্রসর প্রযুক্তির ড্রোন দিচ্ছে। ইরানের ড্রোন রাশিয়ার যুদ্ধ করার সামর্থ্য বাড়িয়ে দিচ্ছে।
গত জুলাই মাসে ইরানে রাশিয়ার সেনা কর্মকর্তাদের শহীদ-১২৯ ও শহীদ-১৯১ ড্রোন পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আগস্ট মাসের শুরুর দিকেই ইরানের ড্রোন রাশিয়ার কাছে পৌঁছাতে যাচ্ছে বলে গোয়েন্দা সূত্রগুলো নিশ্চিত করে। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে ইরানের ড্রোন হাতে পায় রাশিয়া। এর পর থেকে ইউক্রেনে শতাধিক শহীদ-১৩৬ ও মোহাজের-৬ ড্রোন দিয়ে হামলা চালায় রাশিয়া। এই হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল, ইউক্রেনের বিশেষ বাহিনী, গোলন্দাজ ও সাঁজোয়া ইউনিট, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, জ্বালানি সংরক্ষণাগারসহ সামরিক ও জ্বালানি অবকাঠামো এবং বেসামরিক স্থাপনা। যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদেশগুলোর নিরাপত্তা কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছে, ইরান থেকে রাশিয়া শিগগিরই স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পেতে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেন যুদ্ধ ইরানের স্বার্থ বিকশিত করার সুযোগ করে দিয়েছে। ইরান-রাশিয়ার মধ্যকার বর্তমান উষ্ণতম সম্পর্ক ইউক্রেনকে পরাজিত করতে মস্কোকে খুব বেশি সহায়তা করতে পারবে না। কিন্তু এই সম্পর্ক ইরানের জাতীয় স্বার্থসিদ্ধিতে অনেকটাই সহায়তা করবে। প্রথমত, সিরিয়া থেকে রাশিয়া সেনা সরিয়ে নেওয়ায় দেশটিতে এখন ইরানের প্রভাব অনেক বাড়বে। আসাদবিরোধী বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ইরানি বাহিনী সিরিয়ার বড় একটা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে। সে ক্ষেত্রে ইরান এমন একটা মুক্ত করিডর তৈরি করতে সক্ষম হবে, যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীর অভয়ারণ্য হবে। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার অস্ত্রের চাহিদা ইরানের অস্ত্রশিল্প বিকাশের বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এ পর্যন্ত ইরান বড় কোনো দেশে অস্ত্র বিক্রি করতে পারেনি। রাশিয়া সেই সম্ভাবনা তৈরি করেছে। (সমাপ্ত...)
লেখক মার্কিন সামরিক বিশ্লেষক...
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct