নিজস্ব প্রতিবেদন, আপনজন: গরমের ছুটিতে সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল আশপাশের আরো সাতটি স্কুল নিয়ে সম্প্রতি মাধ্যমিক পড়ুয়াদের জন্য আয়োজন করেছিল চার দিনের এক বিশেষ কর্মশালা। শুধু মাধ্যমিকের বিষয় ভিত্তিক প্রস্তুতি নয় বরং ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ নানা দিক নিয়ে আলোচনা ছিল এই কর্মশালার এক নতুন অভিমুখ। ছাত্র-ছাত্রীদের কর্মশালার পাশাপাশি রাখা হয়েছিল অভিভাবকদের জন্য প্যারেন্টিং স্টাইল নিয়ে বিশেষ আলোচনা।
১৮ থেকে ২১ অক্টোবর চার দিনের এই কর্মশালা এবং অভিভাবক সভার আয়োজন করা হয়েছিল সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে। ২০০ বছর ছুঁতে যাওয়া এই বিদ্যালয়ের প্রাজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষিকা সহ আরো বেশ কিছু বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষিকারা সক্রিয়ভাবে ছিলেন এই কর্মশালার আয়োজন, পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে। কর্মশালায় অংশ নিয়েছিল আটটি স্কুলের ১৪৩ জন ছাত্রছাত্রী। হেয়ার স্কুল, হিন্দু স্কুল, সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল, বেথুন কলেজিয়েট স্কুল, স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল, ব্রাহ্ম গার্লস স্কুল, গভর্নমেন্ট স্পন্সরড মাল্টিপারপাস ফর বয়েজ টাকি হাউস, বাগবাজার মাল্টিপারপাস গার্লস হাই স্কুল। শেষ দিন অভিভাবক সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন এদের ১৩৭ জন অভিভাবক-অভিভাবিকা। ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহ দিতে এই সমস্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং বহু শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রায় প্রতিদিন উপস্থিত হয়েছিলেন এই কর্মশালায়। অভিভাবকদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততাও ছিল দেখার মতো। চার দিনের এই কর্মকান্ডের মূল উদ্যোক্তা সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক ড.দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। এই কর্মসূচি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বললেন, কোভিড অতিমারির পর কিশোরমতি ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুব স্বাভাবিকভাবেই ধৈর্য, একাগ্রতা ইত্যাদি বেশ কমে গেছে। এ থেকে মুক্তি কীভাবে, তা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে নানাভাবে আলোচনা চলছিলই। এই প্রেক্ষিতেই পূজোর ছুটির মধ্যে চার দিনের এই কর্মশালা আয়োজনের মূল ভাবনা। স্নেহের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এ সমস্ত প্রয়োজনীয় গুণাবলী বিশেষ করে শৃঙ্খলা বোধের জাগরণ ঘটুক, এটা ছিল আমাদের এই আয়োজন-এর মূল লক্ষ্য। এছাড়াও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নিজেদের বিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করার মানসিকতা ও নিজের আইডেন্টিটি তৈরির বোধ গড়ে তুলতে এবং কিছুটা গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে এই আটটি বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা ঐক্যের বাতাবরণ গড়ে উঠুক, এটাও ছিল আমাদের একটা বড় উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য কিন্তু অনেকখানি সফল হয়েছে বলে ড.দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের অভিমত। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও এই কর্মশালায় অংশ নিয়ে তাঁরাও তাঁদের সন্তোষের কথা জানিয়েছেন বলে তিনি জানান। তিনি আরো বলেন সমস্ত বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাই এই কর্মশালায় বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছে বলে তারা জানিয়েছে। অনেকে এ বছর পরীক্ষা দেওয়ার সাহস পাচ্ছিল না, তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে বলেও জানিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকেরাও জানিয়েছেন তাদের সন্তুষ্টির কথা। ভবিষ্যতে এ ধরনের আরো কর্মশালা এবং অভিভাবকদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভা আয়োজনের অনুরোধও তাঁরা ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন।দেবব্রতবাবু জানালেন, বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তাঁদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানে এ' ধরনের আয়োজন করতে উৎসাহ প্রকাশ করেছেন। মাধ্যমিক ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এ ধরনের কর্মসূচি অত্যন্ত সময়োপযোগী বলে তাঁরা মনে করছেন। এই সমস্ত বিদ্যালয়ের অংশগ্রহণকারী ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়িতে ফিরে এবং তাদের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলোচনার ফলেই এ ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তিনি। বিশেষ করে শেষ দিন অর্থাৎ শুক্রবার অভিভাবক সভায়
বিশিষ্ট মনোবিদ ও শিক্ষক তাপস সেন-এর আলোচনা সকলের মন ছুঁয়ে গেছে। 'সন্তানদের সাথে পজিটিভ হন' এই বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, যুগের পরিবর্তনকে সামনে রেখে অভিভাবকদের নিজেদেরকেও কিছু পরিবর্তন করা প্রয়োজন। সন্তানের সাথে পজিটিভলি কথা বলুন। তাদের অসুবিধের সামাজিক কারণ, বায়োলজিক্যাল কারণ, দৈহিক কারণ নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় বসুন। দেখবেন, তারা অনেক ভালো পারফরম্যান্স করতে পারছে। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে চার দিনের এই কর্মশালার শুভ সূচনা করেন পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ভাইস চ্যান্সেলর বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. বাসব চৌধুরী। তিনি নিজের জীবনের নানা ঘটনা তুলে ছাত্র-ছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করেন এবং সকলের জন্য আসন্ন মাধ্যমিক ও পরবর্তী জীবনের শুভ কামনা করেন। এদিন প্রারম্ভিক অধিবেশনে বিশিষ্টদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন হিন্দু স্কুলের প্রধান শিক্ষক শুভ্রজিত দত্ত, বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শাশ্বতী অধিকারী, হেয়ার স্কুলের প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত ভট্টাচার্য, স্যান্ডফোর্ড অ্যাকাডেমির এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর পান্থ মল্লিক প্রমুখ। চার দিনের কর্মশালায় বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করেন বিভিন্ন বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষক শিক্ষিকারা। বাংলায় উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানবেন্দ্র রায়। ইংরেজিতে রাহুল সেনগুপ্ত, নীলাদ্রি সেন, পার্থপ্রতিম সরকার, উজ্জ্বল মুখার্জি ও সন্দীপন রায়। ইতিহাসে শাহাবুল ইসলাম গাজী, সঞ্জয় পাল ও শহিদুর রহমান। ভূগোলে কল্যাণ বিশ্বাস, কিংশুক মন্ডল ও শান্তনু ভট্টাচার্য। জীবন বিজ্ঞানে ড. সন্দীপ রায়, ড. স্বাগতা বসাক, পলাশ দে ও তমাল গড়াই। ভৌতবিজ্ঞানে ড.দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, আনিসুর আলী জমাদার, রবি শংকর পাল, সঞ্জয় মন্ডল, বংশীলাল ঘোষ ও অরিজিতা শীল। গণিতে গৌরাঙ্গ সরখেল ও নায়ীমুল হক। শেষ দিনের কর্মশালায় ছাত্র-ছাত্রীদের সাতটি বিষয়ে অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের পরীক্ষা নেওয়া হয় এবং সবশেষে অনুষ্ঠিত হয় অভিভাবক-সভা। এই সভায় বিশিষ্ট অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাগবাজার মাল্টিপারপাস গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা দেবিকা বসু, কসবা হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক বংশীবদন চট্টোপাধ্যায়, বিশিষ্ট মনোবিদ তাপস সেন, বোটানির বিশিষ্ট অধ্যাপক ড. আকরামুল হক প্রমূখ। চার দিনের এই কর্মশালার শেষে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক সকলের মুখে একই কথা, এই ধারা যেন মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত অন্তত অব্যাহত থাকে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct