রাজনীতির লোকেরা জানে মানুষের স্মৃতি বড় দুর্বল। দু-চার জন নথি-পত্র খুলতে চাইলেও বেশির ভাগ মানুষ ভুলে মেরে দেয় অতীতের ঘটনা। সেই যে কবি বলেছেন, ‘অতীতের কথা কহি বর্তমান যদি যায় / সে কথাও কহিব না’। হয়তো এই সুযোগটা নিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি দুম করে বলে বসলেন, ন্যানো প্রকল্পের মাথা টাটাদের সিঙ্গুর থেকে সরিয়েছে সিপিএম। ব্যস, আর যায় কোথা ! ঢাল-তলোয়ার নিয়ে লাফিয়ে পড়লেন সিপিএমের মাথারা। পুরানো খবরের কাগজের কাটিং তুলে দেখাতে লাগলেন আসল কারণটা।। এ নিয়ে লিখেছেন দিলীপ মজুমদার।
রাজনীতির লোকেরা জানে মানুষের স্মৃতি বড় দুর্বল। দু-চার জন নথি-পত্র খুলতে চাইলেও বেশির ভাগ মানুষ ভুলে মেরে দেয় অতীতের ঘটনা। সেই যে কবি বলেছেন, ‘অতীতের কথা কহি বর্তমান যদি যায় / সে কথাও কহিব না’। হয়তো এই সুযোগটা নিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি দুম করে বলে বসলেন, ন্যানো প্রকল্পের মাথা টাটাদের সিঙ্গুর থেকে সরিয়েছে সিপিএম। ব্যস, আর যায় কোথা ! ঢাল-তলোয়ার নিয়ে লাফিয়ে পড়লেন সিপিএমের মাথারা। পুরানো খবরের কাগজের কাটিং তুলে দেখাতে লাগলেন আসল কারণটা। জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিল তৃণমূল। ধর্নামঞ্চ বানিয়েছিল সিঙ্গুরে। সেখানে বক্তিমে, নাচ, গান আরও কত কি। সে মঞ্চে শুনেছি কালারফুল মদন মিত্রের গান। হেঁড়ে গলায় স্লোগান শুনেছি বেচারামের। মধ্যরাতে দেখা গেছে প্রাতঃভ্রমণ করতে বেরিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দীগ্রামের মতো সিঙ্গুরও মমতার ক্ষমতায় ওঠার সিঁড়ি। এ সব কথা আমজনতার মনে ধূসর হয়ে এসেছে। তাই মমতাও বলে যাচ্ছেন। প্রতিবাদও করে যাচ্ছে বামেরা। সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো গাড়ি তৈরির প্রকল্প। রতন টাটার স্বপ্নের প্রকল্প। ইনস্টাগ্রামে রতন টাটা জানিয়েছেন সেই স্বপ্নের কথা। তিনি দেখতেন স্কুটারে চেপে যাচ্ছে বাপ-মা। তাদের মাঝে তাদের সন্তান। স্যান্ডউইচের মতো চেপ্টে আছে। বড় বেদনাদায়ক দৃশ্য। মনে হল রতনবাবুর। তিনি তো রতন টাটা। পায়দলে হাঁটা মানুষরা চোখে পড়ে না তাঁর। সাইকেলে চাপা মানুষও নয়। দেখতে পান শুধু স্কুটার। বাবা চালাচ্ছে। বাচ্চা মাঝে। পেছনে মা। আহা রে, স্যাণ্ডউইচ হয়ে যাচ্ছে বাচ্চটা।
শুধু স্বপ্ন দেখেন না রতনবাবু। স্বপ্নকে কাজে রূপ দিতে জানেন। তাঁর মন বলল, সাধারণ মানুষের জন্য সস্তা গাড়ি তৈরি করো। লেগে পড়লেন তিনি। এদিকে তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, সাহিত্যরসিক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মাথায়ও নতুন নতুন ভাবনা। শিল্পায়ন চাই। কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানটা তাঁকে ক্রমাগত খোঁচাচ্ছে : ‘নতুন কিছু করো ওহে, নতুন কিছু করো’। তাঁদের পলিটবুড়োকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে বাবু বুদ্ধদেব টাটাদের সঙ্গে কথা শুরু করে দিলেন। সেখানকার চাষিদের সঙ্গে কথা না বলে, তাদের না বুঝিয়ে করতে গেলেন জমিঅধিগ্রহণ। সুযোগটা নিতে দেরি করলেন না মমতার দল। রাজনীতি যে সুযোগসন্ধানের নীতি। অমন যে বিশাল মাপের শিল্পপতি, বুক কেঁপে গেল তাঁরও। রাজনৈতিক আন্দোলনের পীঠস্থান যে বাংলা। সেআন্দোলনকে দমায় সাধ্য কার? এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে? তাই পাততাড়ি গোটাতে হল টাটাদের। কোথায় যাবেন, কোথায় যাবেন--- ভাবছেন যখন, ডাক এসে গেল ৫৬ ইঞ্চি ছাতিবিশিষ্ট নরেন্দ্র মোদীর। আরে রতনভাই, ঘাবড়াও মৎ , চলে আসুন আমার গুজরাটে। সানন্দা প্ল্যান্টে তৈরি শুরু করুন ন্যানো। আহা, গরিবের রথ। শুধু জমি নয়, ৩৪ হাজার কোটি টাকাও দেব প্রকল্পের জন্য। গুজরাট চলে গেল ন্যানো। হায় হায় ধ্বনি তুলেছিল সিপিএম। কিন্তু তখন যে তাদের যায় যায় অবস্থা। ন্যানো গুজরাট গিয়ে কি হল? লাভের গুড় পিঁপড়ে খেল? রতন টাটা ভেবেছিলেন মাত্র ১ লক্ষ টাকা দামের এই গাড়ি তিনি বছরে ২ লক্ষ ৫০ হাজার তৈরি করবেন। হু হু করে বিক্রি হবে। এত চাহিদা হবে যে যোগান দেওয়া মুশকিল হবে। তাই খুলতে হবে অনেক ইউনিট।
আখেরে কি হল?
২০০৯-১০ সালে বিক্রি হয়েছে ৩০ হাজার, পরের বছর ৭০ হাজার ৪৩২, পরের বছর ৭৪ হাজার ৫২৭, পরের বছর ৫৩ হাজার ৮৪৮, পরের বছর ২১ হাজার ১২৯, পরের বছর ১৬ হাজার ৯০৩, পরের বছর ৭ হাজার ৫৯১, পরের বছর ১৫০২। আর তার পরের বছর, মানে ২০১৮ সালে বিক্রি হল মাত্র ১টি। তাই বাজাতে হল মৃত্যুঘণ্টা। ন্যানো বেঘোরে মারা গেল। গরিবের গাড়ি। সস্তার গাড়ি। বাঃ, বেশ ভালো। কিন্তু জানেন তো মশাই, সস্তার মাল বস্তা বস্তা। চালু হওয়ার পর থেকে ন্যানো প্রবলেম চাইল্ড। তার হর্ন ঠিক ঠিক বাজে না। স্টার্টার মোটর বন্ধ হয়ে যায়। পাওয়ার উইন্ডো কাজ করে না। এসি চলে না। স্পিডোমিটার কাজ করে না। চলতে চলতে আগুন ধরে যাওয়ার ঘটনাও আছে। তাছাড়া, ততদিনে বাজারে এসে গেছে তিয়াগো, হেক্সা, নিক্সন –এসব গাড়ি। এতসব চাপে ন্যানো কি বাঁচতে পারে?আমি ভাবি অন্য কথা। যদি সিঙ্গুরেই ন্যানো থেকে যেত তাহলে কি হত? মরতে তো তাকে হতোই। কিন্তু তখন কে কাকে দোষ দিত? তৃণমূল সিপিএমকে, না কি সিপিএম তৃণমূলকে!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct