পৃথিবীর মোট তেল উৎপাদনের ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ওপেকভুক্ত দেশগুলো। পুরো বিশ্বের তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণ তাদেরই হাতে। গত ৫ অক্টোবর সৌদি নেতৃত্বাধীন ওপেক এবং এই জোটের মিত্র দেশ রাশিয়া এক বৈঠকে একমত হয়ে তেল উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে বিশ্ববাজারে সৃষ্টি হয়েছে উত্তেজনা এবং বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে বিরাজ করছে ব্যাপক ক্ষোভ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। ক্ষুব্ধ মোর্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ নিয়ে লিখেছেন ফারিহা জেসমিন। আজ শেষ কিস্তি।
গত জুলাইয়ের শেষে সৌদি যুবরাজকে প্যারিসের এলিসি প্রাসাদে রাজকীয় সংবর্ধনা দেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ। একই অনুরোধ নিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর রিয়াদে গিয়েছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসও। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন টেলিফোনে কথা বলেছেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। এসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ওপেকের তেল উৎপাদন কমানোসংক্রান্ত ঘোষণা আসে। গত ৫ অক্টোবর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় মাত্র ৩০ মিনিটে ওপেক প্লাস জোটের বৈঠকে তেল উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে স্পষ্ট যে সৌদি আরব পশ্চিমাদের এসব দাবিকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। ২৪টি দেশের জোটে এই প্রস্তাব নিয়ে কোনো মতবিরোধই ছিল না। ওপেক প্লাসের এমন আচরণে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হয়ে ওপেকের অন্যতম প্রধান সিদ্ধান্ত প্রণয়নকারী দেশ সৌদি আরবের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক পুনরায় বিবেচনা এবং দেশের স্বার্থে এই সম্পর্ক কতটুকু কার্যকর, তা ভেবে দেখা দরকার বলে মন্তব্য করেছে। অন্যদিকে ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তটি সম্পূর্ণরূপে অর্থনৈতিক এবং এর সদস্য দেশগুলো সর্বসম্মতভাবে নিয়েছে বলে দাবি করেছেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান। তিনি মনে করেন, জোটের সদস্যরা দায়িত্বশীলভাবে কাজ করেছে এবং যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির চেয়ারম্যান ও ডেমোক্র্যাট সিনেটর বব মেনেনডেজ বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবিলম্বে অস্ত্র বিক্রিসহ সৌদি আরবের সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতা বন্ধ করতে হবে। সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাইডেন তাঁর সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলো নিয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল কমোডিটি ইনসাইটের অভিজ্ঞ ওপেক পর্যবেক্ষক রজার দিওয়ান বলেছেন, ‘তেল উৎপাদন বা সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া তেল অস্ত্রায়নের শামিল। ’ একে ইচ্ছাকৃত ঘটনা হিসেবে অভিহিত করে দিওয়ান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও চুক্তির সময় রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রীর উপস্থিত থাকার বিষয় কিংবা আসন্ন শীত সামনে রেখে তেল সরবরাহ সীমিত করার বিষয়ে চুক্তি করার মানে হলো, রাশিয়া এরই মধ্যে ইউরোপে তার গ্যাস রপ্তানিকে অস্ত্র বানিয়েছে। ’
দিওয়ান বলছেন, সামরিক সহায়তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও সৌদি আরবের এই নতুন আত্মবিশ্বাস থেকে এটি পরিষ্কার বোঝা যায় যে দেশটি নিজেকে মুক্ত কিংবা শক্তিশালী মনে করছে! এমনকি আমেরিকাকে চাপের মধ্যে রাখার পাশাপাশি নিজস্ব বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক স্বার্থে কাজ করতে উদ্যত হয়েছে সৌদি আরব। বাইডেন প্রশাসন তেল সরবরাহ না কমানোর বিষয়ে জোটকে আহ্বান জানানোর পরও প্রেসিডেন্টের আহ্বানকে উপেক্ষা করে ওপেক প্লাস তেল উৎপাদন বিষয়ে যে ঐকমত্যে পৌঁছেছে, তা ওয়াশিংটনকে হতবাক করেছে। হোয়াইট হাউস এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে যে ওপেক রাশিয়ার সঙ্গে একত্র হয়েছে। এ ছাড়া রিয়াদ মস্কোর হয়ে কাজ করছে বলে অভিযোগ করেছে আমেরিকা। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) সতর্কবাণী দিয়েছে যে ওপেক প্লাস দেশগুলো তেলের উৎপাদন কমানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম আরো বেড়ে বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ক্রমাগত বাড়তে থাকা মুদ্রাস্ফীতির চাপ, সুদের হার বৃদ্ধি এবং জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্যের কারণে এরই মধ্যে মন্দার দ্বারপ্রান্তে থাকা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এই সিদ্ধান্ত আরো খারাপ পরিণতি বয়ে আনবে। ওপেক প্লাসের এই সিদ্ধান্ত এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, বিশ্ব জ্বালানি যনিরাপত্তার সব অঙ্ক যেন ওলটপালট করে দিয়েছে। তেলের বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। (সমাপ্ত...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct